ইসলামো-বামপন্থীবাদ (ইংরেজি: Islamo-leftism; ফার্সি: چپ اسلامی; ফরাসি: islamo-gauchisme, স্পেনীয়: Islamo-izquierdismo),[১] বিশেষণে ইসলামো-বামপন্থী (ইংরেজি: Islamo-leftist ফরাসি: islamo-gauchistes);[২] হচ্ছে একটি নব্যসৃষ্ট শব্দ যা বামপন্থী (বামপন্থী) ও ইসলামবাদীদের রাজনৈতিক মৈত্রীর ক্ষেত্রে প্রয়োগ করা হয়।
শব্দটির ইতিহাস
এই শব্দটির ইতিহাস নিয়ে রচিত Libération এবং ফ্রান্স ২৪ -এ প্রকাশিত রচনাগুলোতে শব্দটি সম্পর্কে নির্দিষ্ট উৎস্য পাওয়া যায় না, বরং উভয় প্রকাশনীই ২০০২ সালের পিয়েরে আঁদ্রে ট্যাগুয়েফ এর একটি গ্রন্থ New Judeophobia এর কথা বলে। পিয়েরে আঁদ্রে ট্যাগুয়েফ হচ্ছেন একজন ধারণা বিষয়ক ঐতিহাসিক, যিনি ইসলামো-ফ্যাসিজমকে প্রতি-জায়নবাদের একটি ধরন হিসেবে বর্ণনা করেন, এবং এটিকে নতুন তৃতীয়-বিশ্ববাদী, নব্য-সাম্যবাদী এবং নব্য-বামপন্থীদের মধ্যে বিখ্যাত হিসেবে উল্লেখ করেন। এটি প্রতি-বিশ্বায়ন আন্দোলন নামে বেশি পরিচিত, একথাও তিনি উল্লেখ করেন।[৩][৪] Liberation এর সাংবাদিক সোনিয়া ফয়ের এবং ফ্রাঞ্জ ডুরাপ্ট এর নেয়া ২০১৬ সালে এক সাক্ষাতকারে ট্যাগুয়েফ বলেন, তিনি নিশ্চিত নন যে তিনিই এই শব্দটি তৈরি করেছিলেন, নাকি অন্য কোথাও শুনে এটাকে ব্যবহার করেছিলেন। তিনি বলেন, ১৯৮০ এর দশকে ফরাসী বামপন্থীগণ নিজেদের বর্ণনা করবার ক্ষেত্রে ইসলামো-প্রোগ্রেসিভ এবং প্যালেস্টিনো-প্রোগ্রেসিভ শব্দগুলো ব্যবহার করতেন।[৩]
এলেইন বাজিউ এবং এরিক হাজান এর মতে, ইসলামো-বামপন্থী শব্দটিকে সরল সুবিধার জন্য ফরাসী পুলিসেরাই প্রথম ব্যবহার করেন।[৫] আল জাজিরা দাবি করে যে এই শব্দটি প্রথম ব্যবহার করেন মেরিন লা পেন, যিনি ইসলামী ধর্মান্ধ এবং ফরাসী বামপন্থীদের অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক বর্ণনা করার জন্য শব্দটির প্রচলন করেন।[৬]
সংজ্ঞা
ফরাসী দার্শনিক প্যাসকেল ব্রুকনার মনে করেন, ইসলামো-বামপন্থীবাদ হচ্ছে "নাস্তিক অতিবাম এবং ধার্মিক মৌলবাদের এর একটি মিলন।"[৭] ব্রুকনারের মতে, ইসলামো-বামপন্থীবাদকে প্রধাণত সোশ্যালিস্ট ওয়ার্কারস পার্টি এর ব্রিটিশ ট্রটস্কিপন্থীরাই প্রথম গ্রহণ করেছিলেন। কারণ এই নিবেদিতপ্রাণ বামপন্থীগণ সামজিক অস্থিরতা তৈরির জন্য ইসলামের সম্ভাবনাকে বুঝতে পেরেছিলেন। তারা তাই প্রতিক্রিয়াশীল মুসলিম দলগুলোর সাথে কৌশলী ও অস্থায়ী মৈত্রী স্থাপন করেন। ব্রুকনারের মতে, তৃতীয়-বিশ্ববাদের বামপন্থী অনুগামীগণ ইসলামবাদকে মুক্ত-বাজার পুঁজিবাদ এর পতনের জন্য অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করবার আশা করেন, এবং তারা ব্যক্তি অধিকার, বিশেষ করে নারী অধিকারের বিষর্জনকে পুঁজিবাদের ধ্বংসের বৃহত্তর লক্ষ্যের জন্য গ্রহণযোগ্য লেনদেন বলে মনে করেন। ব্রুকনার বলেন, ইসলামবাদীগণ বর্ণবাদ, নব্যউপনিবেশবাদ এবং বিশ্বায়নের বিরোধিতার জন্য কৌশলী এবং অস্থায়ীভাবে বামপন্থীদের দলে যোগ দেবার ভান করেন, যেখানে তাদের সত্যিকারের লক্ষ্য হচ্ছে ইসলামবাদী সরকারের সমগ্রবাদী ধর্মতন্ত্র আরোপ করা।[৭][৮]
রাজনৈতিক বিজ্ঞানী মরিস ফ্রেসার বলেন, ইসলামো-বামপন্থীবাদ হচ্ছে রাজনৈতিক বামপন্থা, বিশেষ করে নব্য বামপন্থার বিশ্বায়ন-বিরোধী কর্মীদের "মানবাধিকার, স্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, বিজ্ঞান ও প্রগতি থেকে সাম্প্রতিক ও আকর্ষণীয় পদত্যাগ"।[৯]
বারনার্ড-হেনরি লেভি ইসলামো-বামপন্থীবাদকে "লাল এবং নব্য বাদামীদের মধ্যকার নতুন মহামৈত্রী হিসেবে উল্লেখ করেন যা Le Monde diplomatique (একটি ফরাসী সংবাদপত্র) থেকে শুরু করে ডেথ স্কোয়াড পর্যন্ত পরিচালনা করে,[১০] এবং একটি আমেরিকা-বিদ্বেষী ধর্ম হিসেবে কাজ করে।"[১১]
ইউনাইটেড স্টেটস আর্মি ওয়ার কলেজ এর মার্ক সিলিনস্কি এর মতে, ইসলামো-বামপন্থীবাদ হচ্ছে পাশ্চাত্যের মূল্যবোধের বিরোধিতার জন্য তৈরি ইসলামবাদী ও বামপন্থীদের একটি মৈত্রী যাকে একই সাথে "লাল-সবুজ অক্ষ" হিসেবেও চিহ্নিত করা যেতে পারে।[১২] সিলিনস্কি ইসলামো-বামপন্থীবাদ এর উদাহরণ হিসেবে ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার এবং কাউন্সিল অন আমেরিকান-ইসলামিক রিলেশন্স এর মধ্যকার কালো-সবুজ মৈত্রীর কথা বলেন।[১২]
রবার্ট এস. উইস্ট্রিচ এর মতে, "মার্ক্স, ফোরিয়ার এবং প্রুদোঁ এর মধ্যে একটি বিষাক্ত ইহুদি বিরোধী উত্তরাধিকার পাওয়া যেতে পারে যা সনাতন সাম্যবাদী এবং "অ-অনুগামী" ট্রটস্কিপন্থী থেকে আজকের ইসলামো-বামপন্থী সংকরদের মধ্যে পাওয়া যাবে যারা হামাসের ইহুদি-বিদ্বেষী ইসলামবাদীদের মিত্র।[১৩]
আলভিন হার্শ রোজেনফিল্ড ইসলামো-বামপন্থীবাদকে "একটি বৈপ্লবিক অংশের পোষণ করা একটি আশা হিসেবে দেখেন যেখানে ইসলামকে নব্য বিদ্রোহের বর্ষার ফলক হিসেবে দেখা হয় যা বৈশ্বিক পুঁজিবাদের বিরুদ্ধে একটি ধর্মযুদ্ধে অংশগ্রহণ করবে।"[১৪]
ইরানে "ইসলামো-বামপন্থীবাদ"
শিরিন হান্টার ১৯৭০ এর দশকে মার্ক্সবাদী তত্ত্বের আলোয় ইসলামকে তুলে ধরবার জন্য মাহমুদ তেলেঘানিকে কৃতিত্ব দান করেন, যিনি মুজাহিদিন-ই-খালক নামের একটি "ইসলামো-বামপন্থী" দলের অনুপ্রেরণায় এই কাজটি করেছিলেন।[১৫] হান্টারের মতে, সেই সময়ে মুসলিম বিশ্বে ইসলামো-বামপন্থীবাদের উদ্দেশ্যগুলোর মধ্যে একটি ছিল বামপন্থার কিছু উপাদানকে নিজেদের মধ্যে নিয়ে এসে বামপন্থার বিরুদ্ধেই যুদ্ধ করা, এবং এর মাধ্যমে শিয়াদের মত অর্থনৈতিকভাবে নিগৃহীত দলগুলোকে ইসলামী রাজনীতিতে আসতে আকৃষ্ট করা। এর ফলে বামপন্থায় "ইসলামী মৌলবাদ প্রবেশ করে" এবং "নতুন এক রাজনৈতিক ধারার জন্ম হয় যাকে বামপন্থী ইসলাম হিসেবে বর্ণনা করা যায়"।[১৬] হান্টার বর্ণনা করেন, "ইসলামো-বামপন্থী বুদ্ধিজীবীগণ (মুহাহিদিন-ই-খালক) এবং ইসলামো-লিবারাল বুদ্ধিজীবীগণ (ন্যাশনাল ফ্রন্ট এর ইসলামী শাখা এবং পরবর্তীতে স্বাধীনতা আন্দোলন) পাহলাভি বিরোধী কার্যক্রম পরিচালনা করে" যার মধ্যে গেরিলা যুদ্ধও ছিল।[১৭] পরবর্তিতে ইরানি বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন ইসলামী দলের মধ্যে সংঘাতের সৃষ্টি হয়, এবং মোরতেজা মোতাহিরি নামে খামেনেই এর একজন সামাজিক প্রগতিশীল মিত্র আলী শারিয়াতির ইসলামো-বামপন্থী অনুসারীদের দ্বারা গুপ্তহত্যার শিকার হন।[১৭] অলিভার রয় এর মতে ইরানে ১৯৭০ এর দশকে কোন উদারপন্থী গণতান্ত্রিক মতাদর্শের বদলে তিন ধরনের প্রধান ইরানীয় রাজনৈতিক দল সক্রিয় ছিল - বামপন্থী, ইসলামবাদী এবং ইসলামো-বামপন্থী।[১৮]
কথাসাহিত্যে ব্যবহার
মিশেল হোয়েলবেক এর ২০১৫ সালের উপন্যাস সাবমিশন-এ রবার্ট রেডিগার নামে একটি কাল্পনিক চরিত্র আছে। তিনি একজন ইসলামে ধর্মান্তরিত ব্যক্তি এবং তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর থেকে একজন রাজনীতিবিদ হন। এই উপন্যাসে ইসলামো-বামপন্থীবাদকে "ইতিহাসের আস্তাকুঁড় থেকে নিজেদেরকে উত্তোলন করে ইসলামের কোট-টেইলে সুরক্ষিত রাখতে চান এরকম নষ্ট, বিকৃত, মস্তিষ্কমৃত মার্ক্সবাদীদের মরিয়া চেষ্টা" হিসেবে বর্ণনা করা হয়।[১৯][২০]
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র
- ↑ Hermosa, Borja (২৬ জানুয়ারি ২০১৭)। "Finkielkraut, contra el "neoprogresismo" y el "islamo-izquierdismo""। El País। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Guibert, Philippe (৭ অক্টোবর ২০১৫)। "Il faut inventer la "politique musulmane" de la France"। Slate। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ ক খ Faure, Sonya (১৪ এপ্রিল ২০১৬)। "Islamo-gauchisme, aux origines d'une expression médiatique"। Liberation। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১৭।
- ↑ "Qu'est ce que cet "islamo-gauchisme" dont le camp Valls accuse Hamon ?"। France 24। ২৫ জানুয়ারি ২০১৭। সংগ্রহের তারিখ ২৮ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Alain Badiou, Eric Hazan (২০১৩)। "Anti-Semitism is Everywhere" in France Today, Chapter in, Reflections On Anti-Semitism। Verso Books। পৃষ্ঠা 41।
- ↑ Ryan, Yasmine (৬ এপ্রিল ২০১২)। "French right focuses on 'radical' Muslims"। Al Jazeera। সংগ্রহের তারিখ ৩ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ ক খ Bruckner, Pascal (২০১০)। The Tyranny of Guilt: An Essay on Western Masochism। Princeton University Press। পৃষ্ঠা 25। আইএসবিএন 978-1400834310।
- ↑ Pascal, Julia (২২ সেপ্টেম্বর ২০১১)। "The Tyranny Of Guilt: An Essay On Western Masochism, By Pascal Bruckner, trans by Steven Rendall"। The Independent। সংগ্রহের তারিখ ২ নভেম্বর ২০১৫।
- ↑ Fraser, Maurice (১১ নভেম্বর ২০১০)। "Is the Decline of the West Reversible?"। European View। 2 (2): 149। ডিওআই:10.1007/s12290-010-0128-0।
- ↑ George Walden (৫ ডিসেম্বর ২০১১)। "Public Enemies; Two French intellectuals fight it out."। New Statesman। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Bernard-Henri Lévy (২০০৯)। Left in Dark Times: A Stand Against the New Barbarism। Random House। পৃষ্ঠা 114। আইএসবিএন 978-0812974720।
- ↑ ক খ Silinsky, Mark (২০১৬)। Jihad and the West: Black Flag over Babylon। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 49। আইএসবিএন 978-0253027207।
- ↑ Robert, Wistrich (২০১২)। From Ambivalence to Betrayal: The Left, the Jews, and Israel। University of Nebraska Press। পৃষ্ঠা xii। আইএসবিএন 978-0803240834। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Rosenfeld, Alvin (২০১৫)। Deciphering the New Antisemitism। Indiana University Press। পৃষ্ঠা 12। আইএসবিএন 978-0253018694।
- ↑ Hunter, Shireen (২০১০)। Iran's Foreign Policy in the Post-Soviet Era: Resisting the New International Order। ABC-CLIO। পৃষ্ঠা 27। আইএসবিএন 978-0313381942। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মার্চ ২০১৭।
- ↑ Shireen Hunter (১৯৯৮)। The Future of Islam and the West। Greenwood Publishing Group। পৃষ্ঠা 94। আইএসবিএন 978-0275962883।
- ↑ ক খ Shireen Hunter (২০১৪)। Reformist Voices of Islam: Mediating Islam and Modernity। Routledge। পৃষ্ঠা 42, 45। আইএসবিএন 978-1317461241।
- ↑ Olivier Roy, chapter in book edited by Larry Diamond, Marc F. Plattner (২০১৪)। Democratization and Authoritarianism in the Arab World। Johns Hopkins University Press। পৃষ্ঠা 41। আইএসবিএন 978-1421414164।
- ↑ Houellebecq, Michel (২০১৫)। Submission। Farrar, Straus, Giroux। পৃষ্ঠা 223।
- ↑ Brass, Tom (২০১৭)। Labour Markets, Identities, Controversies: Reviews and Essays, 1982-2016। Brill। পৃষ্ঠা 79। আইএসবিএন 978-9004337091। সংগ্রহের তারিখ ১৯ মার্চ ২০১৭।