আইএমসিটিসি বা ইসলামিক মিলিটারি কাউন্টার টেরোরিজম কোয়ালিশন হলো মুসলিম বিশ্বের ৪১টি রাষ্ট্র নিয়ে গঠিত একটি আন্তঃসরকারি সন্ত্রাসী-হামলা প্রতিরোধকারী সামরিক মিত্র-জোট, যা ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর তৎকালীন সৌদি প্রতিরক্ষামন্ত্রী মোহাম্মদ বিন সালমানের নেতৃত্বে ইসলামিক স্টেট অব ইরাকের বিরুদ্ধে যুদ্ধসহ অন্যান্য সন্ত্রাসবাদবিরোধী কার্যকলাপ ও অভিযানে পারস্পরিক সহযোগিতার লক্ষ্যে গঠিত হয়।[২][৩][৪][৫] সৌদি আরবের রিয়াদে এই জোটের একটি যৌথ অপারেশন সেন্টার থাকার কথা ছিল।[৬]
জোটটি ঘোষণার সময় ৩৪ টি সদস্য রাষ্ট্র ছিল। ২০২২ সালের ১ সেপ্টেম্বরে কেনিয়া যোগদান করলে আরো অতিরিক্ত কয়েকটি দেশ যোগ দেয় এবং সদস্য সংখ্যা একচল্লিশে পৌঁছে যায়।[৭] ২০১৭ সালের ৬ জানুয়ারী পাকিস্তানের প্রাক্তন সেনাপ্রধান রাহিল শরীফকে উক্ত জোটের প্রথম কমান্ডার-ইন-চিফ মনোনীত করা হয়।[৮][৯] জোটটির অধিকাংশ অংশগ্রহণকারীই ইসলামি সহযোগিতা সংস্থার সদস্য।
ইতিহাস ও উদ্দেশ্য
সংস্থাটি বলেছে যে, এর প্রাথমিক উদ্দেশ্য হল মুসলিম দেশগুলিকে সম্প্রদায় ও নাম নির্বিশেষে সমস্ত সন্ত্রাসী গোষ্ঠী ও সন্ত্রাসী সংগঠন থেকে রক্ষা করা।[১০][১১][১২] আইএমসিটিসি নিশ্চিত করেছে যে, এটি সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে জাতিসংঘ ও ওআইসি–এর বিধান অনুসারে কাজ করবে।[১৩]
আইএমসিটিসি চালু করার সংবাদ সম্মেলনে মুহাম্মদ বিন সালমান বলেন যে, এটি ইরাক, সিরিয়া, লিবিয়া, মিশর ও আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধের প্রচেষ্টাকে সমন্বয় করবে। এছাড়াও সিরিয়া ও ইরাকে অভিযানের ক্ষেত্রে বড় বড় পরাশক্তি ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর সঙ্গে আন্তর্জাতিক সমন্বয় থাকবে...।"[১৪]
এ জোটে ইরান, ইরাক ও সিরিয়ার মত শিয়া অধ্যুষিত সরকারগুলির কোন দেশ অন্তর্ভুক্ত হয়নি।[১৫]ইউরো নিউজের একটি প্রতিবেদন অনুসারে, কিছু বিশ্লেষক ইরানের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় মধ্যপ্রাচ্য ও মুসলিম বিশ্বে নেতৃস্থানীয় ভূমিকা নিতে সৌদি আরবের প্রচেষ্টার অংশ হিসাবে জোট গঠনকে দেখছেন।[১৬]
সংখ্যাগরিষ্ঠ সুন্নি মুসলিম জনসংখ্যার দেশগুলির এই জোটে আধিপত্যের কারণে, ইরাকীয় পার্লামেন্টের নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষা কমিশনের সদস্য হাকিম আজামেলি এটিকে "একটি সাম্প্রদায়িক জোট " বলে অভিহিত করেছেন।[১৫][১৬][১৭]
তবে ইবাদি-প্রধান দেশ ওমান এ জোটে যোগ দিয়েছে। লেবাননও এই জোটকে সমর্থন দিয়েছে।[১৮] ইরানের সাথে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক রয়েছে এমন অন্য দেশ, যারা জোটের অংশ অথবা সমর্থন করে তাদের মধ্যে রয়েছে বাংলাদেশ, কুয়েত, লিবিয়া ও পাকিস্তান।
২০১৬ সালের মার্চে রিপোর্ট করা হয় যে, সৌদি আরব তৎকালীন পাকিস্তানের সেনাপ্রধান রাহিল শরীফকে আইসিএমটিসির কমান্ডার-ইন-চিফ হওয়ার অনুরোধ করে, যখন তিনি ২০১৬ সালের শেষে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী থেকে অবসর গ্রহণ করেন।[১৯]
সদস্য রাষ্ট্র
২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর সৌদি আরব জোটের মূল ঘোষণায় ৩৪টি দেশকে অংশগ্রহণকারী সদস্য হিসাবে তালিকাভুক্ত করে এবং[২] সকলেই ওআইসির সদস্য এবং তারা সব ওআইসি সদস্য রাষ্ট্রের প্রায় ৬০% গঠন করে। ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে কেনিয়ার যোগদানের সাথে মোট ৪১টি সদস্য দেশ হয়েছে।
মূলঘোষণার সময় ইন্দোনেশিয়াসহ (যা বিশ্বের বৃহত্তম মুসলিম জনসংখ্যার দেশ) অন্য আরো দশটিরও বেশি ইসলামি দেশ এই জোটের প্রতি তাদের সমর্থন প্রকাশ করেছিল[২] এবং আজারবাইজান এ জোটে যোগদান করার বিষয়ে আলোচনা করছিল।[৩২][৩৩][৩৪] ২০১৮ সালে প্রাক্তন উপপ্রতিরক্ষামন্ত্রী সেযাফরি জমসউদ্দীন মন্তব্য করেছেন যে, ইন্দোনেশিয়ার জোটনিরপেক্ষতা দেশকে একটি সামরিক জোটে যোগ দিতে বাধা দেয়। তিনি আরো বলেন যে, ভাইস প্রেসিডেন্ট জুসুফ কাল্লা ইন্দোনেশিয়ার যোগদানের সাথে একমত ছিলেন না।[৩৫]
২০১৭ সালের জানুয়ারিতে আজারবাইজান বলেছিল যে, এতে যোগদান তার পররাষ্ট্রনীতির এজেন্ডা নয়। [৩৬] সৌদি আরবে তাজিকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিশ্চিত করেন যে, তাজিকিস্তান যোগদানের সম্ভাবনা গুরুত্বের সাথে অধ্যয়ন করছে।[৩৭][৩৮]
বাংলাদেশ : ২০১৫ সালের ১৫ ডিসেম্বর বাংলাদেশ এ জোটে যোগদানকারী প্রাথমিক সদস্যদের মধ্যে একটি ছিল। দেশটি প্রতিষ্ঠাতা দেশগুলির একটি যৌথ বিবৃতিতে ডার সদস্যপদ নিশ্চিত করে, যাতে বলা হয়েছে যে, "সমস্ত সন্ত্রাসীগোষ্ঠীর অনিষ্ট থেকে ইসলামি জাতিকে রক্ষা করা একটি কর্তব্য। কারণ এই সংগঠনগুলি নামে যাই হোক না কেন, পৃথিবীতে তারা মৃত্যু ও ধ্বংস ডেকে আনে এবং নিরপরাধদের ভয় দেখায়। তবে বাংলাদেশ কোন ধরণের সামরিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করে।[৪১][৪২][৪৩]
চীন : চীন সন্ত্রাসবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে এ জোটের সাথে সহযোগিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করে এবং এই জোট গঠনে সৌদি প্রচেষ্টার প্রশংসা করে।[৪৪]
মালয়েশিয়া : মালয়েশিয়ার প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিশাম উদ্দিন হুসেন জোটের প্রতি সমর্থন প্রকাশ করেন। কিন্তু মালয়েশিয়ার পক্ষ থেকে যেকোনো সামরিক সহায়তা প্রত্যাখ্যান করেন।[৪৭]
পাকিস্তান : প্রাথমিক অস্পষ্টতার পর পাকিস্তান এই উদ্যোগকে স্বাগত জানায়। সরকার তার অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে এবং বলে, জোটের বিভিন্ন কর্মকাণ্ডে তার অংশগ্রহণের পরিমাণ নির্ধারণের জন্য দেশটি আরও বিশদ বিবরণের জন্য অপেক্ষা করছে।[৪৮]
তুরস্ক : তুরস্কের প্রধানমন্ত্রী আহমেত দাভুতোগলু এ জোটকে "ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদের যুক্ত করার চেষ্টাকারীদের জন্য সেরা প্রতিক্রিয়া" বলে অভিহিত করেন।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র : এই নতুন জোটকে যুক্তরাষ্ট্র স্বাগত জানায় এবং তৎকালীন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী অ্যাশ কার্টার বলেন, এ জোট গঠনের পরিপ্রেক্ষিতে সৌদি আরবের মনে কী আছে সে সম্পর্কে আমরা আরও জানার অপেক্ষায় রয়েছি। কিন্তু সাধারণভাবে এটিই দেখা যাচ্ছে। এটি এমন কিছুর সাথে সঙ্গতিপূর্ণ, যা আমরা বেশ কিছুদিন ধরেই তাগিদ দিয়ে আসছি।[৪৯]
নকশবন্দি আর্মি: এছাড়া ইরাকের নক্সবন্দি আর্মির নেতা ইজ্জাত ইবরাহিম দৌরি ২০১৬ সালে একটি বিবৃতি প্রকাশ করে জোটের প্রশংসা করেন। ইরান সমর্থিত ইরাকে শিয়া মিলিশিয়াদের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য তিনি তার মুজাহিদদের আহ্বান জানান এবং আরও বলেন যে, "আপনারা বিবেচনা করুন, ইরান থেকে ইরাকে যা কিছু ঘটছে তার সবকিছুর দায় যুক্তরাষ্ট্রের।[৫০]"