আন-নাওয়াউই, যিনি "ইমাম নববি" হিসেবে পরিচিত, হলেন হাদীস গ্রন্থ চল্লিশ হাদিস ও রিয়াদুস সালিহিনের রচয়িতা এবং একজন মুহাদ্দিস, বহু গ্রন্থের লেখক, বিখ্যাত হাদীস বিশারদ ও ইসলামী চিন্তাবিদ। তার পুরো নাম শাইখ মুহিউদ্দিন আবু যাকারিয়া ইয়াহইয়া ইবন শারাফ আল-নাওয়াউই (নববি) আল-দিমাশকি। তার ডাকনাম যাকারিয়া, মূলনাম ইয়াহইয়া এবং উপাধি মুহিউদ্দিন।
জীবন ও কর্ম
আন-নববি দামেস্কের অধীন "নববি" গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। সে গ্রামেই তিনি লালিত-পালিত হন। শৈশবকাল তাঁর নিজের পল্লীতে অতিবাহিত করেন। তাঁর লেখা-পড়ার শুরুও এখানে হয়। [আরবি ভাষা] বর্ণমালা শিক্ষা, আল কুরআন তিলাওয়াত ও হিফযুল কুরআনের মধ্য দিয়ে তিনি তাঁর শিক্ষা জীবনের উদ্বোধন করেন। শৈশব থেকেই এই মহান ব্যক্তি অত্যন্ত ভদ্র এবং শান্তশিষ্ট ছিলেন। খেলাধূলার প্রতি তাঁর কোন মনােযােগ ছিল না। যৌবনের প্রারম্ভে পিতা তাঁকে নিজের সাথে ব্যবসায়ে লাগাবার চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। পিতা অনুভব করেন পুত্র যাকারিয়ার মধ্যে জ্ঞানার্জনের ব্যাকুলতা। পুত্রের উন্নত মানসিক বৃত্তি ও অসাধারণ ধীশক্তি তাঁকে অনুপ্রাণিত করে। তিনি পুত্রের উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে তাকে নিয়ে তৎকালীন জ্ঞান-বিজ্ঞানের কেন্দ্র দামিশকে চলে আসেন। এখানে ইমাম নববি প্রসিদ্ধ উস্তাদ কামাল ইবনে আহমাদের কাছে শিক্ষা লাভ করতে থাকেন।
ইমাম নববি র. নিজেই লিখেছেনঃ “আমার বয়স যখন ১৯ বছর তখন আব্বাজান আমাকে [দামেস্ক|দামেস্কে] নিয়ে গেলেন। সেখানে পৌঁছে আমি রওয়াহা মাদ্রাসায় ভর্তি হলাম। দুই বছর এখানেই অবস্থান করলাম। খাবার-দাবারের ব্যবস্থা ছিল মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষের দায়িত্বে"। জ্ঞানানুশীলনের প্রতি তাঁর গভীর অনুরাগ উস্তাদদেরকেও তাঁর প্রতি আকৃষ্ট করে। তার স্মরণশক্তি, প্রতিভা ও জ্ঞান অন্বেষণের প্রতি অণুরাগ তার শিক্ষকদেরকে আকৃষ্ট করেছিল। ৬৫০ হিজরীতে তিনি পিতার সাথে হজ্জে যান এবং দেড় মাস মদীনা মুনাওয়ারায় অবস্থান করেন। আতাউদ্দীন ইবনে আতা বর্ণনা করেন, শায়খ নববী তাঁকে বলেছেন যে, তিনি নিজের উস্তাদের কাছে প্রতিদিন ১২টি বিষয় পড়তেন। তার মধ্যে প্রধান বিষয়গুলাে ছিল ও আল-জাম্উ বাইনাস সহীহাইন, সহীহ মুসলিম, নাহু, সরফ, মানতিক, উসূলে ফিক্হ ও আসমাউর রিজাল। স্মরণশক্তিও তাঁর ছিল অসাধারণ। ফলে কোন বিষয় একবার পড়লে তা তাঁর স্মৃতিপটে অক্ষয় হয়ে থাকত। হাদীস ও ফিকহের জ্ঞানানুশীলনের মধ্যে তিনি আত্মার তৃপ্তি অনুভব করতেন। তিনি নিজের যুগের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিসদের থেকে হাদীসের জ্ঞান লাভ করেন এবং একই সাথে ফিক্হ উসূলে ফিক্হ ও মানতিকেও পারদর্শিতা অর্জন করেন। ইবাম নববী বহুসংখ্যক উস্তাদের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
ইমাম নববী তাঁর পাঠ্যজীবনের কথা আলােচনাক্রমে বলেন, আমি দৈনিক বারটি বিষয়ে সবক হাসিল করতাম। কঠিন ক্ষেত্রে নােট লিখতাম। শাব্দিক বিশ্লেষণের সাথে সুক্ষ্ম বিষয়ের প্রতিও আলােকপাত করতাম। এতেই অবশেষে সকল জটিলতার অবসান হয়ে যেত। তিনি বলেন, একবার আমার মনে ধারণা হল যে, চিকিৎসা বিজ্ঞানের ‘আলত্বানুন' নামক গ্রন্থখানা পাঠ করা উচিত। অতএব আমি গ্রন্থখানা খরিদ করলাম। এরপর আমি নিজে নিজেই অনুভব করতে লাগলাম যে, দৈনিক আমার অন্তর অন্ধকারাচ্ছন্ন হয়ে পড়ছে এবং বিদ্যার্জনের আকাক্ষা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তারপর আমি গ্রন্থখানা বিক্রয় করে দিলাম। এরপর আমার অন্তর উজ্জ্বল হয়ে যায়।
কর্মজীবনে তিনি শিক্ষাদানকে আদর্শ হিসাবে গ্রহণ করেন। ইবনূল আক্তারের এক ছাত্র। বর্ণনা করেন, আল্লামা নববী সর্বদা শিক্ষাদান কাজে ব্যস্ত থাকতেন। দিন বা রাত, বাজার অথবা মাদ্রাসা সর্বক্ষেত্রেই শিক্ষার্থীরা তাঁর সাথে থাকত। শাইখ কুতুব ইউনানী তাঁর রচিত গ্রন্থে লেখেন, ইমাম নববী বিদ্যা, আল্লাহভীতি, ইবাদত, কম খাবার ও সাধারণ জীবন যাপনে একক বৈশিষ্ট্যের অধিকারী ছিলেন । ইমাম হাফেজ ইবনু কাসীর তাঁর রচিত গ্রন্থ ‘আলবিদায়া' নামক গ্রন্থে বলেন, শাইখ মুহিউদ্দিন ইমাম নববী তাঁর যুগের বড় ফকীহদের মধ্যে গণ্য হতেন। তিনি কখনাে নফল রােযা ছাড়তেন না, তাঁর খাবারে কখনাে দু' প্রকারের তরকারি পরিবেশিত হত না ।
ইমাম নববী শুধুমাত্র একজন উন্নত চরিত্র ও অনাড়ম্বর জীবন-যাপনেও মুসলিম সমাজে তিনি সর্বজনগ্রাহ্য আদর্শ পুরুষ হিসাবেও সম্মানের পাত্র ছিলেন। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর জীবন যাপন প্রণালীকে তিনি আদর্শ হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। সর্বমহলে তিনি সুসম্মানের পাত্র ছিলেন। দুনিয়ার এত বড় সুসম্মানের পাত্র হওয়া সত্বেও তিনি কখনাে রাজা-বাদশাহদের অনুগ্রহ লাভের চেষ্টা করেন নি। সরকারের কোন পুরস্কার তথা অর্থ-সম্পদ লাভের বাসনা তাঁর ছিলনা। নিজে মােটা কাপড় পরিধান করতেন এবং সাদাসিদে জীবন যাপন করতেন। খাবার-দাবারের ব্যাপারেও তিনি কৃচ্ছ্রতা সাধন করতেন। ইমাম আবু বকর ইবনু হিব্বাতুল্লাহ হাওরানী “তাবাকাতে শাফিয়ি’য়্যা” নামক গ্রন্থে লেখেন, ইমাম নববী রাতে একবার খানা খেতেন এবং ভােরে একবার পানি পান করতেন। এটাই ছিল তাঁর দিন ও রাতের খাবার। |
৬৭৬ হিজরীতে বাইতুল মাকদিস সফরশেষে নিজ গ্রামে ফিরে এসেই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এ অবস্থায় ১৪ রজব বুধবার রাতে ইন্তকাল করেন। ইমাম নববী তাঁর পয়তাল্লিশ বছরের জীবনে ইলমে দীনের তথা ইলমে হাদীসের প্রভূত খিদমত করেছেন। তাঁর শিক্ষকতা জীবনের অনেক ছাত্রই তাঁদের নিজ নিজ জীবনে হাদীস বিশারদ হিসাবে সুখ্যাতি লাভ করেন। ইমাম নববী (র) তাঁর ৪৫ বছরের জীবনকালে অসংখ্য মূল্যবান গ্রন্থ প্রণয়ন করেছেন। ইলমে হাদীসের ব্যাখ্যা গ্রন্থ হিসেবে ইমাম নববী রচিত “আলমিনহাজ” নামক গ্রন্থখানা তৎপরবর্তী মুসলিম সমাজের সর্বযুগে শরহে নববী নামে প্রসিদ্ধি লাভ করেছে এবং কিয়ামত পর্যন্ত এ প্রসিদ্ধি বহাল থাকবে বলে আশা করা যায়। “রিয়াদুস সালেহীন ইমাম নববীর একখানা বিরাট হাদীস সংকলন গ্রন্থ। ইমাম নববী এ গ্রন্থ রচনায় ও বিন্যাসে যে শ্রম ও একনিষ্ঠতার প্রকাশ ঘটিয়েছেন এবং ফিকহ পরিচ্ছেদ নির্ধারণ করে তদুপযােগী কুরআনের আয়াত ও হাদীসে নববীর যে উত্তম ভাণ্ডার বিন্যাস্ত করেছেন । সিহাহ সিত্তার পর ‘রিয়াদুস সালেহীন’ এমন একখানা হাদীস সংকলন গ্রন্থ যাতে শুধু সহীহ হাদীসসমূহ সংকলিত হয়েছে। বিষয়ভিত্তিক যথােপযােগী এমন হাদীস সংকলন ইতঃপূর্বে আর কেউ করেনি। তাই ইমাম নববী সকলের শ্রদ্ধার পাত্র। তাঁর রচিত গ্রন্থখানা বিশ্ব মুসলিমের কাছে সমভাবে সমাদৃত। এ গ্রন্থে প্রায় দু'হাজার সহীহ হাদীস সন্নিবেশিত হয়েছে। [৫]
ইমাম নববীর কয়েকজন উস্তাদের নাম
- আবু ইবরাহীম ইসহাক ইবনে আমহদ আল-মাগরিবী;
- আবু মুহাম্মদ আবদুর রহমান ইবনে নূহ আল-মাকদিসী;
- আবু হা উমার ইবনে আসআদুর রিবঈ;
- আবুল হাসান আরশিলী;
- আবু ইসহাক ইবরাহীম মুরাদী;
- আবুল বাকা খালিদ ইবনে ইউসুফ নাবিসী;
- দিয়া ইবনে তাম্মাম হানাফী;
- আবুল আব্বাস আহমাদ মিসরী;
- আবু আবদিল্লাহ জিয়ানী;
- আবুল ফাহ উমার ইবনে বুন্দার;
- আবু ইসহাক ওয়াসিতী;
- আবুল আব্বাস মাকদিসী;
- আবু মুহম্মদ নূখী;
- আবু আবদির রহমান আনবারী;
- আবুল ফারাজ মাকদিসী;
- আবু মুহম্মদ আনসারী ;
[৬]
রচিত গ্রন্থাবলী
- কিতাবুল ঈমান - كتا ب الايمان (সহিহ বুখারির ব্যখ্যা)
- আল-মিনহাজ ফি শারহু মুসলিম ইবনে আল-হাজ্জাজ - المنهج في شرح مسلم ابن الحجا ج (সহিহ মুসলিমের ব্যখ্যা)
- রিয়াদুস সালিহিন - رياض الصالحين
- কিতাবুর রাওদা - كتاب الروضة
- শারহুল মুহাযযাব - شرح المهذب
- আল-আরবািন আন-নাওয়াউইয়্যাহ (الأربعون النووية) - নববীর চল্লিশ হাদিস।
- তাহযিবুল আসমায়ি ওয়াস সিফাত
- কিতাবুল আযকার
- আল-ইরশাদ ফি উলূমিল হাদিস
- কিতাবুল মুবহামাত
- শারহু সহীহ্ আল-বুখারি (বুখারি শরীফের ব্যাখ্যা)
- শারহু সুনানে আবু দাউদ (সুনানে আবু দাউদের ব্যাখ্যা)
- তাবাকাতু ফুকাহাইশ শাফিয়্যা
- আর-রিসালাতু ফি কিসমাতিল গানাইম
- আল-ফাতাওয়া
- জামিউস সুন্নাহ
- খুলাসাতুল আহকাম
- মানাকিবুশ শাফিয়িয়্যা
- বুসতানুল আরিফিন
- রিসালাতুল ইসতিহবাবুল কিয়ামুলি আহালিল ফাযলি
আরও দেখুন
তথ্যসূত্র