অ্যালাস্টেয়ার ডানকান ব্রাউন (ইংরেজি: Ali Brown; জন্ম: ১১ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭০) কেন্টের বেকেনহাম এলাকায় জন্মগ্রহণকারী সাবেক ইংরেজ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। ইংল্যান্ড ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৯৬ থেকে ২০০১ সময়কালে সংক্ষিপ্ত সময়ের জন্যে ইংল্যান্ডের পক্ষে আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অংশগ্রহণ করেছেন।
ঘরোয়া প্রথম-শ্রেণীর ইংরেজ কাউন্টি ক্রিকেটে নটিংহ্যামশায়ার ও সারে দলের প্রতিনিধিত্ব করেন। দলে তিনি মূলতঃ ডানহাতি ব্যাটসম্যান হিসেবে খেলতেন। এছাড়াও, মাঝে-মধ্যে ডানহাতে অফ ব্রেক বোলিংয়ে পারদর্শী ছিলেন লর্ডি ডাকনামে পরিচিত আলী ব্রাউন।
শৈশবকাল
সারেভিত্তিক ক্যাটারহাম স্কুলে ভর্তি হন। ১৯৮৬ সালে বিদ্যালয় ক্রিকেটে সর্বাপেক্ষা প্রতিশ্রুতিশীল অল-রাউন্ডার হিসেবে ক্রিকেট সোসাইটি উইদারল পুরস্কার লাভ করেন। তার এ প্রতিশ্রুতিশীলতার স্বীকৃতিস্বরূপ ১৯৮৮ সালে সারের পক্ষে দ্বিতীয় একাদশের খেলার জন্যে মনোনীত হন। ‘লর্ড টেড’ ডাকনামে পরিচিত টেড ডেক্সটারের অনুসরণে তিনি ‘লর্ডি’ ডাকনামে আখ্যায়িত হন। মারমুখী ভঙ্গীমা ও আত্মবিশ্বাসী ব্যাটিংশৈলীর কারণে এ ডাকনাম পান।
প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেট
১৯৯২ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত আলী ব্রাউনের প্রথম-শ্রেণীর খেলোয়াড়ী জীবন চলমান ছিল। ১৯৯২ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে তার। ১৯৯৪ সালে কাউন্টি ক্যাপ লাভ করেন। খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে সারে দলের পক্ষে খেলতে শুরু করেন। এরপর, ২০০৯ সালে নটিংহ্যামশায়ারের দিকে ধাবিত হন।
সারে দলের মধ্যমণি হিসেবে মাঝারিসারিতে ব্যাটিং করতেন। স্লিপ ফিল্ডার হিসেবেও বেশ সফল ছিলেন। কাউন্টি খেলাগুলোয় দর্শকদের অন্যতম আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দুতে উপনীত হয়েছিলেন। অফ সাইডে বলে উপর দিয়ে ঝটপট রান তুলতে তার জুড়ি মেলা ভার ছিল। এ রান সংগ্রহে শক্তি প্রয়োগের পাশাপাশি নিজস্ব ব্যাটিংয়ের ধরন ক্ষাণিকটা জড়িত ছিল।
১৯৯৮ সালে নর্দাম্পটনশায়ারের বিপক্ষে মাত্র ৭২ বলে মৌসুমের দ্রুততম শতরানের ইনিংসের কল্যাণে কার্ল হুপারের সাথে যৌথভাবে ওয়াল্টার লরেন্স ট্রফি লাভ করেন। ওভালে অনুষ্ঠিত ঐ খেলায় তিনি ১০টি চার ও ৬টি ছক্কা হাঁকিয়েছিলেন।
১৯৯২ সালে প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক ঘটার পর পনেরো হাজারের অধিক রান সংগ্রহ করেছিলেন। একদিনের খেলায়ও এ ধারা অব্যাহত রাখেন। এগারো হাজারের অধিক রান তুলেন। এছাড়াও, লিস্ট-এ ক্রিকেটে ২৬৮ রান তুলে বিশ্বরেকর্ডের অধিকারী তিনি। লিস্ট এ ক্রিকেটের ইতিহাসের প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে দুইবার দ্বি-শতরানের ইনিংস খেলেছেন।
স্বর্ণালী সময়
২০০২ সালের চেল্টেনহাম এন্ড গ্লুচেস্টার ট্রফি প্রতিযোগিতার ৪র্থ রাউন্ডে ওভালে অনুষ্ঠিত খেলায় গ্ল্যামারগনের বিপক্ষে ২৬৮ রান তুলেন। এ পর্যায়ে একদিনের ক্রিকেটে বিশ্বরেকর্ড গড়েন।[১] তার এ ইনিংসটি ১৬০ বল মোকাবেলায় ৩০টি চার ও ১২টি ছক্কা সহযোগে হয়েছিল। সারে দল ৫০ ওভারে ৪৩৮/৫ তুলে। গ্ল্যামারগন দলও ৪২৯ রান তুলতে সক্ষমতা দেখায় ও কাউন্টি ক্রিকেটের ইতিহাসের একদিনে সর্বোচ্চ রানের কারণে স্মরণীয় হয়ে থাকে।[২] এ পর্যায়ে গ্রেইম পোলকের ২২২ রানের সংগৃহীত ২৭ বছরের পুরনো রেকর্ড ভঙ্গ করেন। ইয়ান ওয়ার্ডের সাথে ২৮৬ রান তুলে একদিনের ক্রিকেটে সারে দলের যে-কোন উইকেটে সর্বোচ্চ রানের রেকর্ড গড়েন। পরবর্তীতে, ২০০৭ সালে গ্লুচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে জেমস বেনিংয়ের সাথে ২৯৪ রান করেন। এ পর্যায়ে তিনি মাত্র ৯৭ বলে ১৯৮ রান তুলেন। ব্রাউনের দূর্দান্ত ইনিংসের কারণে ওভালে মাঠে ‘২৬৮ বার’ নামে নামকরণ করা হয়েছিল।[৩]
অধিকাংশ সময়ই সারের একদিনের খেলায় ব্যাটিং উদ্বোধনে নামতেন। তবে, চ্যাম্পিয়নশীপের খেলায় সচরাচর ৫ নম্বরে ব্যাটিংয়ে নামতেন তিনি। সানডে লীগে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত রানের রেকর্ড ধারণ করে আছেন। ১৯৯৭ সালে ৪০ ওভারের খেলায় গিল্ডফোর্ডের উডব্রিজ রোড গ্রাউন্ডে হ্যাম্পশায়ারের বিপক্ষে ২০৩ রান তুলেন। ৫৬ বলে ১০০, ৮৪ বলে ১৫০ ও ১১৮ বলে ২০০ রান তুলেন। এই ইনিংসে ১৯টি চার ও ১১টি ছক্কার মার ছিল। ট্রেন্ট ব্রিজে ২০০৩ সালের টুয়েন্টি২০ কাপের উদ্বোধনী আসরের চূড়ান্ত খেলায় মাত্র ৩৪ বলে অপরাজিত ৫৫ রান তুলে ওয়ারউইকশায়ারের বিপক্ষে দলকে জয়ে প্রভূতঃ সহায়তা করেন। এজবাস্টনে ২০০৪ সালের টুয়েন্টি২০ কাপের চূড়ান্ত খেলায় ৪১ বলে ৬৪ রান তুলেন। এরফলে, সারে দল লিচেস্টারশায়ারকে পরাজিত করে। ২০০৬ সালে একদিনের ক্রিকেটে ৩০টি ছক্কা হাঁকান। কেবলমাত্র ক্যামেরন হোয়াইট তার তুলনায় এগিয়েছিলেন।
২০০৭ সালে মাত্র ৫০ বলে সেঞ্চুরি করে মৌসুম শুরু করেন। ওভালে ফ্রেন্ডস প্রভিডেন্ট প্রতিযোগিতায় ৫০ ওভারের খেলায় গ্লুচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে এ সফলতা পান। এরফলে, ইংল্যান্ডে একদিনের ক্রিকেটে ৭ম ও সামগ্রীকভাবে ১২শ দ্রুততম সেঞ্চুরি করার গৌরব অর্জন করেন। ৩৪ ওভারেরও কম বল খরচ করেন ২৯৪ রানের নতুন জুটি রেকর্ড গড়তে অংশ নেন। সারে দলের পক্ষে এটি যে-কোন উইকেটে নতুন রেকর্ডে তার সাথে ছিলেন জেমস বেনিং। ১৯টি একদিনের ক্রিকেটে সেঞ্চুরির অধিকারী হিসেবে সমসাময়িক স্বল্প কয়েকজন ইংরেজ ব্যাটসম্যানের অন্যতম হিসেবে লিস্ট-এ ক্রিকেটে ১০০০০ রান করেছেন।
২০০৮ মৌসুম শুরুর পূর্ব-পর্যন্ত আলী ব্রাউন প্রথম-শ্রেণীর ক্রিকেটে ৪৪ সেঞ্চুরি সহযোগে ৪৩.৫০ গড়ে ১৪,৭০৫ রান তুলেন। তন্মধ্যে, ২০০০ সালে ওকহাম স্কুলে লিচেস্টারশায়ারের বিপক্ষে ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ অপরাজিত ২৯৫ রানের ইনিংস খেলেন। তিনি তার অফ স্পিন বোলিং প্রয়োগ করে দুইটি প্রথম-শ্রেণীর উইকেট লাভ করেছিলেন। ২৩৬টি ক্যাচ তালুবন্দী করেন। অধিকাংশই স্লিপ অঞ্চলে দণ্ডায়মান অবস্থায় এ সাফল্য পান। এছাড়াও, বিকল্প উইকেট-রক্ষক হিসেবে একটি প্রথম-শ্রেণীর স্ট্যাম্পিং করেন। ২০০৪ সালে ল্যাঙ্কাশায়ারের বিপক্ষে একটি সেঞ্চুরি করার মাধ্যমে প্রত্যেকটি ইংরেজ কাউন্টি দলের বিপক্ষে সেঞ্চুরি করার কৃতিত্ব প্রদর্শন করেন।
১৯৯৯, ২০০০ ও ২০০২ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের পাশাপাশি ১৯৯৬ ও ২০০৩ সালের ইংরেজ ঘরোয়া একদিনের লীগ এবং ১৯৯৭ ও ২০০১ সালের বেনসন এন্ড হেজেস কাপের শিরোপা বিজয়ী সারে দলের অন্যতম সদস্য হিসেবে অংশ নেন। ২০০৬ সালের কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের দ্বিতীয় বিভাগের শিরোপা বিজয়ী দলের সদস্য ছিলেন ও নতুনভাবে চুক্তিলাভের সুযোগ পান। দলীয় কোচ অ্যালান বুচার তাকে ক্লাবের অন্যতম সেরা শুভাকাঙ্খীর মর্যাদায় ভূষিত করেন।[৪]
দল-বদল
২০০৮ সাল শেষে সারে দল থেকে আলী ব্রাউনকে ছাড়পত্র দেয়া হয়।[৫] সারের নির্বাহী মন্তব্য করেন যে, ‘অ্যালাস্টেয়ার ব্রাউন সারের অন্যতম শুভাকাঙ্খী হিসেবে খেলেন। আমাদের সাথে থেকে বর্ণাঢ্যময় খেলোয়াড়ী জীবন অতিবাহিত করেছেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় সর্বাপেক্ষা রান সংগ্রহকারীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। একদিনের ক্রিকেটেও তার রেকর্ড প্রায় অতুলনীয়। তার এ সকল কৃতিত্বে ক্লাব কর্তৃপক্ষ চীর ঋণী হয়ে থাকবে।’[৫]
নটিংহ্যামশায়ারের পক্ষে দুই বছর মেয়াদে ২০০৯ ও ২০১০ সালের জন্যে চুক্তিবদ্ধ হন।[৬] ২০১০ সালে দলটি কাউন্টি চ্যাম্পিয়নশীপের শিরোপা জয় করে। পাশাপাশি, সারে দলের সদস্য থাকাকালীন ১৯৯৯, ২০০০ ও ২০০২ সালে তিনটি শিরোপা জয়ে ভূমিকা রাখেন। ৪২ বছর বয়সে ২০১১ সালে নটিংহ্যামশায়ারের পক্ষে খেলা চলাকালে আগস্ট মাসে ঐ মৌসুম শেষে অবসর গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন।[৭]
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট
সমগ্র খেলোয়াড়ী জীবনে ইংল্যান্ডের পক্ষে সর্বমোট ষোলটি ওডিআইয়ে অংশগ্রহণ করেছেন আলী ব্রাউন। ২৩ মে, ১৯৯৬ তারিখে ওভালে সফরকারী ভারত দলের বিপক্ষে একদিনের আন্তর্জাতিকে অভিষেক ঘটে তার। ২১ জুন, ২০০১ তারিখে ওভালে সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে সর্বশেষ ওডিআইয়ে অংশ নেন তিনি। তাকে কোন টেস্টে অংশগ্রহণ করার সুযোগ দেয়া হয়নি।
১৯৯৬ সালে নিজস্ব তৃতীয় ওডিআইয়ে ভারতের বিপক্ষে ১১৮ রানের সেঞ্চুরি হাঁকান। ১৯৯৮ সালে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ৩১ বলে অর্ধ-শতরানের ইনিংস খেলেন। টেক্সাকো ট্রফির ইতিহাসে এ ইনিংসটি সর্বাধিক দ্রুততম ছিল। তবে, টেস্ট খেলায় অংশগ্রহণের সুযোগ পাননি তিনি।
ভারতের বিপক্ষে প্রথম খেলায় ৩৪ রান তোলার পর টাইমসে তাকে ভাঁড় হিসেবে উল্লেখ করেছিল। পরের খেলায় শূন্য রানে বিদেয় নেন। কিন্তু, তৃতীয় ও চূড়ান্ত খেলায় মনোরম সেঞ্চুরি করেছিলেন তিনি। এ সময়েই তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে স্বর্ণালী সময় অতিবাহিত করেন।
১৯৯৮-৯৯ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত মিনি বিশ্বকাপ প্রতিযোগিতা শেষে অনেকটা নিরবে দলের বাইরে রাখা হয়। কিন্তু, ২০০১ সালে প্রচুর রান তুলতে থাকায় ন্যাটওয়েস্ট সিরিজ খেলার জন্যে তাকে পুনরায় দলে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। তবে, তিন খেলায় অংশ নিয়ে তিনি মাত্র ২১ রান তুলেন। এরপর, আর তাকে দলে খেলার জন্যে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
অবসর
৪২.৬৭ গড়ে ১৬,৮৯৮ রান তুলেছেন ও লিস্ট-এ ক্রিকেটে এগারো হাজারের অধিক রান তুলে অন্যতম সর্বাধিক সফলতম ব্যাটসম্যান হওয়া সত্ত্বেও টেস্ট ক্যাপের মর্যাদা পাননি। লরেন্স বুথ তাকে তার সময়কালে অন্যতম সেরা ইংরেজ ক্রিকেটার হিসেবে উল্লেখ করে তার টেস্ট ক্রিকেটে সুযোগ না দেয়ার কথা তুলে ধরেন।
নভেম্বর, ২০১১ সালে সারে দলের দ্বিতীয় একাদশের কোচ হিসেবে নিযুক্তি লাভ করেন।[৮] ২০১৬ সাল শেষে ক্লাব থেকে চলে আসেন।[৯]