আব্রাহাম মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব, মৌলিক চাহিদাগুলো একটি পিরামিডের সাথে তুলনা করে নিচের দিকে দেয়া হয়েছে
মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব, মৌলিক চাহিদাগুলো একটি পিরামিডের সাথে তুলনা করে নিচের দিকে দেয়া হয়েছে

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব হচ্ছে আব্রাহাম মাসলোর একটি মনস্তাত্ত্বিক তত্ত্ব। ১৯৪৩ সালে মাসলো ‘সাইকোলজিকাল রিভিউ’ তথা ‘মনস্তাত্ত্বিক পর্যালোচনা’ পত্রিকায় তার ‘মানব প্রেষণা তত্ত্ব’ নামক গবেষণা পত্র প্রকাশ করেন। এই তত্ত্বটির বৈজ্ঞানিক ভিত্তি ছিল খুবই সামান্য: এটা মাসলো নিজেও উল্লেখ করেছিলেন। পরে মাসলো মানুষের জন্মগত কৌতূহল সম্পর্কে তার পর্যবেক্ষণগুলি অন্তর্ভুক্ত করার জন্য ধারণাটি প্রসারিত করেছিলেন। তার তত্ত্বগুলো মানুষের মনোস্তাত্ত্বিক বিকাশের অন্যান্য অনেক তত্ত্বের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ। তার তত্ত্বে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক বিকাশে কয়েকটি ধাপ দেখানো হয়েছে। এসব ধাপের প্রতিই মাসলো বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। তারপর তিনি তার তত্ত্বে ভিত্তিতে সমাজের সর্বজনীন চাহিদাকে ভাগ করেন।

হায়ারারকিকে আমরা স্তর-পারম্পর্য বলতে পারি। মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বকে মানুষ কীভাবে স্বতঃস্ফূর্তভাবে আচরণ করে তা খুঁজে বের করতে অধ্যয়ন করা হয়। মাসলো কিছু শব্দ ব্যবহার করেছেন, যেমন, ‘জৈবিক’, ‘নিরাপত্তা ও ভালোবাসা’, ‘সামাজিক চাহিদা’ বা ‘সম্মান’, এবং ‘আত্ম উপলব্ধি’। এসব শব্দের মাধ্যমে মাসলো বলতে চেয়েছেন, মানুষের অনুপ্রেরণা কাজ করে। এগুলোর মাধ্যমে মাসলো মানুষের প্রেরণা কাজ করার একটি পদ্ধতি বের করেছেন। এ তত্ত্ব মতে, একজন ব্যক্তির মধ্যে পরবর্তী ধাপে প্রেরণা কাজ করতে হলে এর আগের ধাপকে অবশ্যই পূরণ করে যেতে হবে। এছাড়াও, মানুষের আচরণের ক্ষেত্রে চেষ্টা ও প্রেরণা কীভাবে সম্পৃক্ত তা নিয়ে আলোচনা করতে এ স্তর-পারম্পর্য বা চাহিদার সোপান তত্ত্বকে মূল ভিত্তি হিসাবে ধরা হয়। চাহিদার সোপান তত্ত্বের প্রতিটি ধাপে যেতে হলে আগের ধাপে ব্যক্তিকে সন্তুষ্ট হতে হয়। তারপরই পরের ধাপে যাওয়া হয়। প্রতিটি ধাপেরই কিছু অভ্যন্তরীণ উপাদান থাকে যা ব্যক্তিকে পূরণ করে পরের ধাপে অগ্রসর হতে সাহায্য করে। মাসলোর স্তর-পারম্পর্যের লক্ষ্য হচ্ছে পঞ্চম ধাপ বা স্তর অর্জন করা। পঞ্চম ধাপ হচ্ছে আত্ম উপলব্ধি।

মাসলোর এ তত্ত্বটি ১৯৫৪ সালে তার মোটিভেশন ও পারসোনালিটি তথা অনুপ্রেরণা ও ব্যক্তিত্ব বইয়ে পুরোপুরি প্রকাশিত হয়েছিল। এ স্তর-পারম্পর্য সমাজ বিজ্ঞানের গবেষণা, ব্যবস্থাপনা বিষয়ক প্রশিক্ষণ, মাধ্যমিক ও উচ্চতর মনোবিজ্ঞান বিষয়ক নির্দেশনার ক্ষেত্রে জনপ্রিয় কাঠামো হিসাবে ব্যবহৃত। মাসলোর স্তর-পারম্পর্য বা শ্রেণিবদ্ধকরণ শ্রেণিবিন্যাসকে সময়ের সাথে সাথে সংশোধন করা হয়েছে। আসল শ্রেণিবিন্যাসে বলা হয়েছে যে উচ্চতর ধাপ বা স্তরে যাওয়ার আগে এর পূর্বের স্তরকে অবশ্যই সম্পূর্ণরূপে সন্তুষ্ট ও পরিপূর্ণ হতে হবে। যাই হোক, আজকের গবেষকরা এসব স্তরকে ক্রমাগত একে অপরের সাথে মিশিয়ে কাজ করাকেই বেশি পছন্দ করেন। এর মানে হলো, নিম্নস্তরের যেকোনো স্তর যেকোনো সময় অন্যান্য স্তরের চেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে।

মাসলোর এ ধারণা বা আইডিয়ার জন্ম হয়েছিল ব্ল্যাকফিট তথা কালোপা জাতির সাথে তার কাজ করার সুবাদে। তিনি কালোপা জাতির বয়স্ক ব্যক্তিদের সাথে আলাপ-আলোচনা করেন। এ জাতির সদস্যরা চামড়ার তৈরি তাবুর মধ্যে থাকেন। তাদের সাথে কথা বলতে গিয়ে মাসলো এ তত্ত্বে ধারণা পান। যাই হোক, মাসলোর তত্ত্বকে সমালোচনা করা হয়। কারণ তার আইডিয়ার মধ্যে কালোপা জাতির আসল তত্ত্বকে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে। আসল তত্ত্ব ছিল, আত্ম উপলব্ধির মূল ভিত্তি হচ্ছে সামাজিক উপলব্ধি এবং সামাজিক উপলব্ধির মূল হচ্ছে সাংস্কৃতিক চিরস্থায়ীত্বতা। এই সাংস্কৃতিক বাস্তবায়ন বা চিরস্থায়ীত্বতাকে কালোপা জাতি দর্শনের সর্বোচ্চ ধাপ হিসাবে ধরা হয়।

হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্য

একই সাথে বিভিন্ন স্তরের বিভিন্ন চাহিদা একই সময়ে অন্যান্য চাহিদার সাথে গতিশীল হিসাবে চিত্রিত করা হয়েছে

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বকে প্রায়ই পিরামিডের সাথে তুলনা করা হয়। প্রাথমিক চাহিদাগুলো থাকে পিরামিডের নিচের স্তরে। এরপর চাহিদাগুলো উচ্চতর স্তরে উঠতে থাকে। সবার উপরে হলো আত্মোপলব্ধির স্তর। অন্য কথায় বলতে গেলে, ব্যক্তির মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরেই সে উচ্চতর চাহিদা পূরণের পথে পা বাড়াতে পারে। উচ্চতর চাহিদা পূরণের প্রেরণা পায় আগের স্তরের চাহিদাগুলো পূরণ করার মাধ্যমে। যদিও পিরামিড সদৃশ এ হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্যের স্তরগুলো মাসলোর আইডিয়া, কিন্তু মাসলোর প্রকৃত তত্ত্বে এভাবে পিরামিড সদৃশ আকারে সাজানো ছিল না।

পিরামিড সদৃশ এ স্তর-পারম্পর্যের প্রথম চারটি স্তরকে মাসলো বলতেন, ‘ন্যূনতম চাহিদা’। সম্মান, বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা, নিরাপত্তা ও জৈবিক চাহিদা এর মধ্যে পড়ে। যদি এ ‘ন্যূনতম চাহিদা’ পূরণ না হয় তবে মৌলিক (জৈবিক) চাহিদা ব্যতীত, অন্য চাহিদাগুলোর জন্য হয়তো কোনো শারীরিক ইঙ্গিত দেখা যাবে না, কিন্তু ব্যক্তি ভিতর থেকে উদ্বেগ ও দুশ্চিন্তা বোধ করবে। মাসলোর তত্ত্ব মতে, মৌলিক চাহিদাগুলো আগে পূরণ হতে হবে। তারপর ব্যক্তির মধ্যে উচ্চতর চাহিদার জন্য আকাঙ্ক্ষা শক্তিশালী হবে (বা একাগ্রভাবে মনোযোগ দিতে পারবে)। ভিন্নভাবে বলা যায়, পূর্বের চাহিদা পূরণ হওয়ার পরই পরবর্তী স্তরের প্রতি ব্যক্তির আকাঙ্ক্ষা শক্তিশালী হবে। মাসলো ‘মেটামোটিভেশন’ বলে একটি শব্দের উল্লেখ করেন। এর মানে হচ্ছে যারা আত্মোপলব্ধি অর্জনের পথে অগ্রসর হয়, তারা পূর্বে নিজেদের মৌলিক চাহিদাগুলো পূরণ করার পরেই অগ্রসর হয়। মৌলিক (জৈবিক) চাহিদা ও অন্যান্য স্তরের চাহিদা পূরণ করার পরেই লোকজন আরও উন্নত ধাপে উন্নীত হতে সংগ্রাম করে।

মানব মস্তিষ্ক একটি জটিল সিস্টেম এবং একই সময়ে সমান্তরাল প্রক্রিয়ায় চলতে থাকে, সুতরাং মাসলোর হায়ারারকির বিভিন্ন স্তরে বিভিন্ন প্রেরণা একই সময়ে ঘটতে পারে। মাসলো এই স্তরগুলোর "আপেক্ষিক", "সাধারণ" এবং "প্রাথমিকভাবে" এদের মধ্যকার সম্পর্ক ও সন্তুষ্ট হওয়ার শর্ত সম্পর্কেও বলে গেছেন। একজন ব্যক্তি নির্দিষ্ট সময়ে নির্দিষ্ট প্রয়োজনের দিকে মনোনিবেশ করে-তার পরিবর্তে, মাসলো বলেছিলেন যে একটি নির্দিষ্ট প্রয়োজন মানবজীবনের ওপর "আধিপত্য" করে। এভাবে মাসলো স্বীকার করেন যে একই সময় বিভিন্ন স্তরের প্রেরণা ক্রিয়া করতে পারে। তবে তিনি মূলত অনুপ্রেরণার মূল ধরনগুলি এবং তাদের স্তরগুলোর পর্যায়ক্রম চিহ্নিত করার দিকে মনোনিবেশ করেছিলেন।

জৈবিক চাহিদা

জৈবিক চাহিদাকে আমরা শারীরবৃত্তীয় চাহিদাও বলতে পারি। জৈবিক চাহিদা হলো এক ধরনের ধারণা বা তত্ত্ব যা অনুপ্রেরণা তত্ত্বের ব্যাখ্যা ও ব্যবহার থেকে উদ্ভূত হয়। এই ধারণার মূল হচ্ছে মানুষকে বেঁচে থাকতে  হলে শারীরিক যেসব প্রয়োজন মেটাতে হয় তা। এর মানে হচ্ছে শারীরিক তথা জৈবিক চাহিদা একটি বিশ্বব্যাপী চাহিদা। এটা মানুষের প্রাথমিক চাহিদা। এ অনেকটা মানুষের জন্মের সাথে সাথে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই থাকে। একে বলা যায় একটি জেলার নির্বাহী কার্যক্রম চালানোর জন্য জেলা প্রশাসকের মতো। এ প্রশাসক মানুষের উচ্চতর চাহিদাগুলো পূরণের প্রয়োজনীয় দিকনির্দেশনা দেয়। ব্যক্তি যখন উচ্চতর চাহিদা পূরণ করতে যায় তখন প্রাথমিক চাহিদা পূরণ না হলে উচ্চতর চাহিদা পূরণ বাধাগ্রস্ত হয়। প্রাথমিক চাহিদা, যেমন, খাবার বা বাতাসের অভাব। জৈবিক চাহিদাগুলোকে মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব মতে অভ্যন্তরীণ প্রেরণা বলে বিবেচনা করা হয়েছে। মাসলোর তত্ত্ব মতে, মানুষ এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। ব্যক্তি যদি উচ্চতর চাহিদার খোঁজেও যায়, তবুও সে আগে এসব জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে বাধ্য। যদি এসব চাহিদা পূরণ না হয়, তবে ব্যক্তির মধ্যে এক ধরনের অতৃপ্তির জন্ম হয়। এর বিপরীতে, ব্যক্তির মধ্যে যখন অতৃপ্তির জন্ম হয়, তখন ব্যক্তির মধ্যকার প্রেরণা হ্রাস পায় এবং অতৃপ্তির বৃদ্ধি ঘটে। জৈবিক চাহিদাকে একই সাথে এক ধরনের বৈশিষ্ট্য ও অবস্থা বলা যেতে পারে। জৈবিক চাহিদাকে বৈশিষ্ট্য হিসাবে উল্লেখ করলে বলতে হয় এটা দীর্ঘমেয়াদি বৈশিষ্ট্য, অপরিবর্তশীল চাহিদা, যা মানুষের জীবন ধারণের জন্য অত্যাবশ্যক। আর জৈবিক চাহিদাকে অবস্থা হিসাবে উল্লেখ করলে বলতে হয় এটা আনন্দের অপ্রীতিকর হ্রাস ঘটায় এবং একটি প্রয়োজন পূরণের দিকে তাগাদ দেয়। ব্যক্তির মধ্যে নিহিত তথা সহজাত প্রেরণা রয়েছে উচ্চতর চাহিদা পূরণের। তবে এ চাহিদা পূরণ করতে হলে আগে ব্যক্তিকে অবশ্যই জৈবিক চাহিদা পূরণ করতে হবে। তার মানে, একজন মানুষকে যদি তার জৈবিক চাহিদা পূরণে সংগ্রাম করতে হয়ে, তবে সে পরের স্তরের চাহিদাগুলোর দিকে, যেমন নিরাপত্তা, সামাজিক চাহিদা (বন্ধুত্ব ও ভালোবাসা), সম্মান ও আত্মোপলব্ধির স্তরের দিকে ধাবিত হওয়ার সম্ভাবনা নেই।

জৈবিক চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

নিরাপত্তার চাহিদা

ব্যক্তির জৈবিক চাহিদা যখন তুলনামূলকভাবে সন্তুষ্ট হয়, তখন তার দরকার নিরাপত্তার চাহিদা। নিরাপত্তা তথা সুরক্ষার চিন্তাই তার আচার-আচরণে কর্তৃত্বশীল ও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। যেখানে শারীরিক নিরাপত্তার অভাব থাকে, যেমন, যুদ্ধ, প্রাকৃতিক দুর্যোগ, পারিবারিক সহিংসতা তথা গৃহ নির্যাতন, শিশু নির্যাতন ইত্যাদি, অথবা অর্থনৈতিক সুরক্ষার অভাব থাকে, যেমন, কোনো অর্থনৈতিক সঙ্কট এবং কাজের সুযোগের অভাব থেকে এ ধরনের নিরাপত্তা তথা সুরক্ষার অভাব সৃষ্টি হয়। এই সুরক্ষার প্রয়োজনীয়তাগুলো নিজেকে প্রকাশ করে চাকরির সুরক্ষার পক্ষে কথা বলা, যেসব চাকরিতে সুরক্ষার বিষয় আছে সেসব চাকরিকে অগ্রাধিকার দেয়া, কর্তৃপক্ষের একতরফা আচরণ থেকে ব্যক্তিকে রক্ষার জন্য অভিযোগের পদ্ধতি তৈরি করা, সঞ্চয়ী একাউন্ট খোলা, বীমা নীতিমালা তৈরি, প্রতিবন্ধীদের জন্য সুরক্ষার ব্যবস্থা ইত্যাদি। এ চাহিদা সবচেয়ে বেশি দেখা যায় শিশুদের মধ্যে। কারণ তাদের নিরাপদ বোধক করার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি থাকে। এ চাহিদার মধ্যে অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে আশ্রয়, চাকরির সুরক্ষা, স্বাস্থ্য ও নিরাপদ পরিবেশ। যদি কোনো ব্যক্তি কোনো পরিবেশে নিরাপদ বোধ না করে, তবে বেঁচে থাকার উচ্চতর স্তরের চাহিদায় যাওয়ার আগে তারা নিরাপত্তা তথা সুরক্ষা খুঁজবে।

নিরাপত্তা চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

সামাজিক চাহিদা (বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার চাহিদা)

জৈবিক এবং নিরাপত্তার চাহিদা পূরণের পরে, মানুষের প্রয়োজনের তৃতীয় স্তরটি আন্তঃব্যক্তিক এবং এতে ভালোবাসা ও একাত্মতার অনুভূতি জড়িত। মাসলোর মতে, এই বলয়গুলো বড় বা ছোট যাই হোক না কেন, মানুষ এসব সামাজিক বলয়গুলোর মধ্যে স্বীকৃতি ও গ্রহণযোগ্যতার অনুভূতি অনুভব করতে চায়। উদাহরণস্বরূপ, কিছু বড় সামাজিক গোষ্ঠীতে ক্লাব, সহকর্মী, ধর্মীয় গোষ্ঠী, পেশাদার সংগঠন, ক্রীড়া দল, সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং অনলাইন সম্প্রদায় অন্তর্ভুক্ত থাকতে পারে। ছোট সামাজিক সংযোগের কয়েকটি উদাহরণের মধ্যে রয়েছে পরিবারের সদস্য, অন্তরঙ্গ জীবনসঙ্গী, পরামর্শদাতা (মেনটর), সহকর্মী এবং একই বিশ্বাসে বিশ্বাসী লোকজন। মানুষ অন্যকে ভালোবাসতে চায় এবং অন্যের ভালোবাসা চায়। এটা যৌনভাবে এবং যৌনতা ছাড়াও প্রয়োজন।[] এই সামাজিক চাহিদা তথা বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার চাহিদা পূরণের অভাবে অনেক লোক নিঃসঙ্গ থাকে, সামাজিকভাবে উদ্বেগ বোধ করে এবং মারাত্মক হতাশার (গুরুতর অবসাদজনিত ব্যাধি) দিকে ঝুঁকে পড়ে। এই চাহিদাটি বিশেষত শৈশবকালে বেশি দরকার হয়। অনেক সময় সামাজিক এ চাহিদা নিরাপত্তার চাহিদার চেয়েও বেশি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দিতে পারে, যেমনটি শিশুদের মধ্যে দেখা যায় যারা শিশু নির্যাতনের পরেও বাবা-মাকে আঁকড়ে থাকে। আতিথেয়তা, অবহেলা, দূরে সরে যাওয়া, একঘরে করা ইত্যাদির কারণে গুরুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গঠনের ক্ষেত্রে ব্যক্তির দক্ষতার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে।

সামাজিক চাহিদাগুলোর (বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার চাহিদা) মধ্যে রয়েছে:

সামাজিক তথা বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার চাহিদা অনেক সময় জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদাকেও ছাপিয়ে যায়। অবশ্য তা নির্ভর করে বন্ধুবান্ধবের চাপের শক্তির ওপর। বিপরীতে, কিছু কিছু ব্যক্তির জন্য ভালোবাসার চাহিদার চেয়েও বড় হচ্ছে সম্মানের চাহিদা। আর অন্যদের ক্ষেত্রে সৃজনশীল চাহিদার গুরুত্ব অন্য সবকিছুর চেয়ে বেশি, এমনকি মৌলিক চাহিদার চেয়েও বেশি।

সম্মানের চাহিদা

সম্মান পাওয়ার ক্ষেত্রে বেশির ভাগ মানুষের দরকার এক ধরনের নিরবচ্ছিন্ন ও স্থিতিশীল সম্মান। এর মানে হচ্ছে এ সম্মান তিনি কোনো একটি বাস্তবিক ক্ষমতা বা কৃতিত্বের ভিত্তিতে পাবেন। মাসলো দুই ধরনের সম্মানের চাহিদার কথা উল্লেখ করেছেন। নিম্ম ও উচ্চ ধরনের সম্মান। সম্মানের ‘নিম্ন’ সংস্করণটি হচ্ছে অন্যের কাছ থেকে সম্মান প্রত্যাশার চাহিদা, এতে থাকতে পারে মর্যাদা, স্বীকৃতি, খ্যাতি, প্রতিপত্তি এবং মনোযোগ পাওয়ার চাহিদা। সম্মানের ‘উচ্চতর’ সংস্করণ হলো আত্ম-সম্মানের চাহিদা, এতে থাকতে পারে শক্তি, কর্মদক্ষতা, [] কর্তৃত্ব, আত্মবিশ্বাস, মুক্তি এবং স্বাধীনতার চাহিদা। এই ‘উচ্চতর’ সংস্করণটি জীবনের দিক-নির্দেশনা দেয়। সোপান তত্ত্বে স্তরগুলো একে অপরের থেকে একেবারে পৃথক পৃথক বলার চেয়ে ‘একে অপরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত’ বলা যায়। [] এর মানে এই যে সম্মানের চাহিদা এবং পরবর্তী স্তরগুলো কঠোরভাবে একে অপরের থেকে পৃথক নয়; বরং একে অপরের সাথে নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত।

আত্মোপলব্ধির চাহিদা

‘একজন মানুষ যা হতে পারে, তাকে অবশ্যই তা হতে হবে।’ [] :৯১ এই উদ্ধৃতিটি হচ্ছে আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাহিদার মূল কথা। এই স্তরের চাহিদার দরকার হয় একজন ব্যক্তি তার পূর্ণ সম্ভাবনাকে উপলব্ধি করবেন। মাসলো একে বলেছেন, একজন ব্যক্তি যা কিছু অর্জন করতে পারে তার আকাঙ্ক্ষা করা, একজন ব্যক্তি যা কিছু হতে পারে তার সবটুকু হওয়া। :৯২ মানুষের হয়তো আদর্শ পিতামাতা হওয়ার ইচ্ছা থাকে, সফল খেলোয়াড় বা ছবি আঁকা অথবা কিছু উদ্ভাবন করার আকাঙ্ক্ষা থাকে। :৯৩ চাহিদার এই স্তরটিকে বুঝতে হলে একজন ব্যক্তিকে কেবল পূর্বের চাহিদাগুলো পূরণে সফল হলেই হবে না, বরং সেগুলোর ওপর কর্তৃত্ব করতে হবে। অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রে যদি আত্মোপলব্ধির কথা বলতে যাই, তবে বলতে হবে এ এক ধরনের মূল্যবোধভিত্তিক ব্যাপার। আত্মোপলব্ধি তথা আত্ম-প্রতিষ্ঠার ব্যাপারটি বলতে বোঝায় এক ধরনের লক্ষ্য বা স্পষ্টভাবে ব্যক্ত উদ্দেশ্যে এবং মাসলোর সোপান তত্ত্বে পূর্ববর্তী স্তরগুলো ধাপে ধাপে পূরণ করার মাধ্যমে আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা সম্ভব। একটি সুস্পষ্ট উদ্দেশ্য হলো এক ধরনের বস্তুগত পুরস্কারভিত্তিক ব্যবস্থার মতো, যেখানে কিছু নির্দিষ্ট মূল্যবোধ বা লক্ষ্য পূরণের জন্য অভ্যন্তরীণভাবে তাড়না বা প্রেরণা কাজ করে। [] এই লক্ষ্যগুলি অনুসরণ করতে উত্সাহিত ব্যক্তিরা তাদের আচরণের মাধ্যমে কীভাবে তাদের চাহিদা, সম্পর্ক এবং নিজের বোধের প্রকাশ ঘটে তা সন্ধান করে এবং বুঝতে পারে। আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাহিদাগুলোর মধ্যে রয়েছে:

  • অংশীদার অধিগ্রহণ
  • অভিভাবকত্ব গ্রহণ
  • প্রতিভা ও দক্ষতা ব্যবহার এবং বিকাশ
  • লক্ষ্য অনুসরণ করা

ট্রান্সেডেন্স চাহিদা তথা স্বাভাবিক বা দৈহিক অবস্থাকে অতিক্রম করে এমন অবস্থা বা অভিজ্ঞতার চাহিদা

তার পরবর্তী বছরগুলোতে, আব্রাহাম মাসলো অনুপ্রেরণার ক্ষেত্রকে আরও বৃহৎ পরিসরে আবিষ্কার করেন। তিনি তার আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠার মূল তত্ত্বের সমালোচনা করার সময় অনুপ্রেরণার আরও একটি মাত্রা আবিষ্কার করেছিলেন। [] [] [] [] পরবর্তী ধারণাগুলো দ্বারা, কেউ নিজের স্বাভাবিক বা দৈহিক অবস্থাকে অতিক্রম করে এমন অবস্থা বা অভিজ্ঞতার খোঁজ পায়। সে নিজেকে এমন এক অবস্থার প্রতি সমাপর্ন করে যা তার নিজের অবস্থার অতীত। উদাহরণস্বরূপ, পরোপকার বা আধ্যাত্মিকতা। তিনি এটিকে অসীমের কাছে পৌঁছানোর আকাঙ্ক্ষার সাথে সমান বলে উল্লেখ করেন। [] ‘ট্রান্সেডেন্স বলতে বোঝায় মানব চেতনা, আচরণ এবং সম্পর্ককে অত্যন্ত উচ্চতম ও সর্বাধিক অন্তর্ভুক্তিমূলক বা সামগ্রিক স্তর। যার অর্থ জগতের সবকিছুর সমাপ্তি নয়, বরং সবকিছুর মধ্যে সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া, নিজের কাছে, অন্যের কাছে, মানুষ হিসাবে, অন্যান্য প্রজাতির কাছে, প্রকৃতির কাছে এবং এ মহাবিশ্বের মহাজাগতিক চেতনার সাথে সঙ্গতি খুঁজে পাওয়া’। [১০]

সমালোচনা

যদিও সাম্প্রতিক গবেষণায় সর্বজনীনভাবে মানুষের এসব চাহিদার অস্তিত্বকে স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে, তবে মাসলো প্রস্তাবিত চাহিদার সোপান তত্ত্ব বা স্তর-পারম্পর্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করা হয়। [১১] [১২]

বেশির ভাগ বৈজ্ঞানিক তত্ত্বগুলোর মতো মাসলোর তত্ত্ব নয়। তার তত্ত্ব প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়ের বাইরে একটি বড় প্রভাব বিস্তার করতে সক্ষম হয়েছে। যেমন ইউরিয়েল আবুলফ যুক্তি দিয়েছেন, ‘মানুষের কল্পনায় মাসলোর তত্ত্বের অব্যাহত অনুরণন রয়েছে। যদিও এটি অবৈজ্ঞানিক বলে মনে হতে পারে, তবুও এটাই এর তাৎপর্য ও গুরুত্বের সবচেয়ে বড় প্রমাণ হতে পারে। এর দ্বারা মানবপ্রকৃতিকে এমন সহজভাবে ব্যাখ্যা করা যায় যে এটি বেশির ভাগ মানুষ তাৎক্ষণিকভাবে নিজের এবং অন্যদের মধ্যে খুঁজে পায়।’ [১৩] তবুও, একাডেমিকভাবে, মাসলোর ধারণাটি প্রচণ্ডভাবে প্রশ্নবিদ্ধ।

পদ্ধতি

মাসলো যাদের নিয়ে গবেষণা করেছেন তাদেরকে তিনি বলেন মানবজাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান। যেমন আলবার্ট আইনস্টাইন, জেন অ্যাডামস, এলিয়ানর রুজভেল্ট এবং ফ্রেডরিক ডগলাস এর মতো সুস্থ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেন। তিনি মানসিকভাবে অসুস্থ বা নিউরোটিক ব্যক্তিদের বাদ দিয়ে সুস্থ ও শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিদের নিয়ে গবেষণা করেন। এ সম্পর্কে মাসলো বলেন, ‘বিকলাঙ্গ, পঙ্গু, অপরিপক্ক ও অসুস্থ নমুনা ব্যক্তিদের নিয়ে করা গবেষণা থেকে বিকলাঙ্গ মনোবিজ্ঞান ও দর্শনের জন্ম হয়।’ [] :২৩৬ মাসলো কলেজের ছাত্রদের মধ্য থেকে সবচেয়ে স্বাস্থ্যকর ১% নমুনা নিয়ে গবেষণা করেন। [১৪]

র‌্যাঙ্কিং

গ্লোবাল র‌্যাঙ্কিং

ওযাহবা ও ব্রিডওয়েল নামক দুই গবেষক মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব নিয়ে বিস্তৃত গবেষণা করেন। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য মাসলো তত্ত্ব বা হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্য যে খুব একটা দরকার তা গবেষকরা খুঁজে পাননি। এর সপক্ষে তেমন একটা প্রমাণও পাননি। [১৫]

মাসলোর এ স্তর-পারম্পর্যকে নৃতাত্ত্বিক ধারা অনুসারে সাজানো হয়েছে বলে সমালোচনা করেন গের্ট হাফস্টেডি। [১৬] আবার হফস্টেডির কাজকেও অন্যরা সমালোচনা করেন। [১৭] মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্ব বা স্তর-পারম্পর্যের ব্যর্থতা হচ্ছে এখান থেকে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদার পর্যাপ্ত তথ্য পাওয়া যায় না। আবার এ তত্ত্ব দিয়ে ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজ ও গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সমাজের মধ্যে সামাজিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক চাহিদা সম্পর্কেও ঠিকভাবে ব্যাখ্যা করা যায় না। ব্যক্তিকেন্দ্রিক সমাজে এসব চাহিদা ও তাড়নাগুলো গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সমাজের চেয়ে বেশি আত্মকেন্দ্রিক প্রবণ। এক্ষেত্রে নিজের উন্নয়ন করার চেষ্টা থাকে বেশি। আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা ঘটে আত্মোন্নয়নের চূড়ান্ত পর্যায় হিসাবে। আর গোষ্ঠীকেন্দ্রিক সমাজে সমাজের চিন্তা ও সমাজের গ্রহণযোগ্যতা (সমাজ মেনে নিল কিনা) ব্যক্তির ব্যক্তিত্ব ও স্বাধীনতার চেয়ে বেশি মূল্যায়ন করা হয়। [১৮]

যৌনতার র‌্যাঙ্কিং

মাসলোর স্তর-পারম্পর্যকে সমালোচনা করার আরও একটি উৎস হচ্ছে পিরামিড সদৃশ এ স্তর-পারম্পর্যে যৌনতার অবস্থান। মাসলোর হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্যে যৌনতাকে রাখা হয়েছে খাদ্য এবং শ্বাস গ্রহণের পাশাপাশি। যৌনতার এ দৃষ্টিকোণ পুরোপুরি ব্যক্তিকেন্দ্রিক। উদাহরণস্বরূপ, কোনো ব্যক্তি যদি ‘উচ্চতর’ স্তরে যেতে চায় তবে তাকে অবশ্যই প্রথমে অন্যান্য জৈবিক চাহিদার সাথে যৌনতাকেও সন্তুষ্ট করতে হবে। কিছু কিছু সমালোচক মনে করেন যে যৌনতার এই অবস্থানটি সমাজের মধ্যে যৌনতার আবেগ, পারিবারিক ও বিবর্তনমূলক প্রভাবগুলোকে উপেক্ষা করেছে। যদিও অন্যরা উল্লেখ করেছেন যে এটি সমস্ত মৌলিক চাহিদার ক্ষেত্রে সত্য। [১৯] [২০]

পরিস্থিতি অনুসারে হায়ারারকি তথা স্তর-পারম্পর্যে পরিবর্তন

মাসলোর চাহিদার সোপান তত্ত্বের উচ্চতর-স্তর (আত্ম-সম্মান ও আত্ম-প্রতিষ্ঠা) এবং নিম্ন-স্তর (শারীরবৃত্তীয়, নিরাপত্তা ও ভালোবাসা) এর শ্রেণিবিন্যাস সার্বজনীন নয় এবং পৃথক পৃথক সংস্কৃতিতে পার্থক্যের দেখা মেলে, কারণ ব্যক্তিগত তফাৎ এবং উক্ত দেশ বা ভূ-রাজনীতিতে প্রাপ্ত সুযোগ ও সম্পদ।

একটি সমীক্ষায় দেখা গেছে, [২১] একটি তের-আইটেম স্কেলের অনুসন্ধানী ফ্যাক্টর বিশ্লেষণ তেরটি বিষয় থাকে এমন মাপকাঠির বিষয়াদির ব্যাখ্যামূলক বিশ্লেষণে দুই ধরনের গুরুত্বপূর্ণ চাহিদার উপাদান পাওয়া যায়। এর সময়কাল ছিল ১৯৯৩ থেকে ১৯৯৪ সাল। এ সময়কালকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তির সময়ও বলা হয়। এ সময়কার দুইটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান ছিল: বেঁচে থাকা (জৈবিক ও নিরাপত্তার চাহিদা) এবং মানসিক (ভালোবাসা, আত্মসম্মান ও আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা)। ১৯৯১ সালে পারস্য উপসাগরীয় যুদ্ধের সময় মার্কিন নাগরিকদের পূর্ববর্তী বছর থেকে চাহিদার বিষয়গুলো বর্তমানে কেমন তা নিয়ে জিজ্ঞাসা করা হয়। আবারও, মাত্র দুটি স্তরের চাহিদা চিহ্নিত করা হয়েছিল। এভাবে দেখা যায় লোকজন এসব চাহিদার গুরুত্ব ও প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছে। মধ্য প্রাচ্যের (মিশর ও সৌদি আরব) নাগরিকদের জন্য, ১৯৯০ সাল ছিল শান্তিপূর্ণ সময়। এ সময় নাগরিকদের জিজ্ঞেস করে তাদের তিনটি চাহিদার ব্যাপারে জানা গেছে, যা মার্কিন নাগরিকের তুলনায় সম্পূর্ণ আলাদা ছিল।

শান্তির সময় এবং যুদ্ধের সময়, এ দুই ধরনের পরিস্থিতিতে জনগণ কী ধরনের চাহিদায় সন্তুষ্ট তা জানাই ছিল এ সমীক্ষার কাজ। আমেরিকা বনাম মধ্য প্রাচ্যের জনগণের মধ্যে এ তুলনা করা হয়। আমেরিকার জনগণের জন্য এক ধরনের চাহিদার আকাঙ্ক্ষা দেখা যায়। তা হচ্ছে সব চাহিদাকেই তারা সমানভাবে গুরুত্ব দিচ্ছে। যুদ্ধের সময় মার্কিন নাগরিকদের যেসব চাহিদার দেখা দেয় তা তিন ধরনের: জৈবিক চাহিদা, নিরাপত্তার চাহিদা এবং মানসিক চাহিদা (সামাজিক, আত্মসম্মান ও আত্মোপলব্ধি)। যুদ্ধের সময় জৈবিক চাহিদা ও নিরাপত্তার চাহিদাগুলো আলাদা আলাদাভাবে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দেখা দেয়। কিন্তু শান্তির সময় এগুলো এক হয়ে যায়। মধ্য প্রাচ্যের জনগণের জন্য যুদ্ধের সময় তিন ধরনের চাহিদা বদলে দুই ধরনের চাহিদার উদ্ভব ঘটে। [২২] [২৩]

১৯৮১ সালের একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে কীভাবে মাসলোর শ্রেণিবিন্যাস বা স্তর-পারম্পর্য বিভিন্ন বয়সে এসে বিভিন্নভাবে ক্রিয়া করে। [২৪] একটি সমীক্ষায় বিভিন্ন বয়সের অংশগ্রহণকারীদের নেয়া হয়। তাদের কাছ থেকে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ থেকে কম গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের ব্যাপারে জানতে চাওয়া হয়। এসব ব্যাপারে তাদেরকে একটি নির্দিষ্ট সংখ্যার রেটিং দিতে বলেছিল। গবেষকরা দেখতে পেয়েছেন যে অন্যান্য গ্রুপের তুলনায় বাচ্চাদের শারীরিক চাহিদার স্কোর বেশি ছিল, শৈশব থেকে কৈশোর বয়সে সামাজিক চাহিদার প্রয়োজন বেশি ছিল, কৈশোর বয়সীদের মধ্যে সম্মান পাওয়ার চাহিদার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি ছিল, তরুণ বয়সীদের মধ্যে সর্বোচ্চ আত্ম-প্রতিষ্ঠার চাহিদা ছিল সবচেয়ে বেশি এবং বার্ধক্যে ছিল সবচেয়ে বেশি নিরাপত্তার চাহিদা। এই ছিল তুলনামূলকভাবে সমস্ত স্তর জুড়ে চাহিদার বিস্তার। লেখকরা যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে মাসলো চাহিদার সোপান তত্ত্ব হয়তো পর্যায়ক্রমে বা একের পর এক করে গঠন করা কঠিন বা উন্নতি করার ধাপ হিসাবে ততটা বিবেচনা করা যায় না, কিন্তু বিভিন্ন বয়সে সামাজিক (বন্ধুত্ব ও ভালোবাসার) চাহিদা এবং আত্মসম্মানের চাহিদার তারতম্য বয়স অনুসারে ভিন্ন ভিন্ন হতে পারে।

ব্যবহৃত শব্দের সংজ্ঞা

আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা

‘আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা’ শব্দটি সর্বজনীনভাবে মাসলোর পর্যবেক্ষণ প্রকাশ করতে পারে না; এই অনুপ্রেরণাটি হল সেরা ব্যক্তি হয়ে ওঠার দিকে মনোনিবেশ করে যা একজন সম্ভবত নিজের ও অন্যদের, উভয়ের সেবায় চেষ্টা করতে পারে। []  মাসলোর আত্ম-প্রতিষ্ঠার এই স্তরটি সম্পূর্ণ মাত্রাকে সঠিকভাবে চিত্রিত করতে পারে না; প্রায়শই, যখন কোনো ব্যক্তি আত্ম-প্রতিষ্ঠার স্তরে থাকে, তখন তারা সাধারণত যা সম্পাদন করে তা অনেক সময়ই অন্যের উপকারে হতে পারে বা ‘বৃহত্তর জগতের ভালোর জন্য’ হতে পারে। ]

মানবিক চাহিদা বা মানবিক পর্যায়কে অতিক্রম করে যাওয়া চাহিদা

আবুলফ যুক্তি দেখিয়েছিলেন যে মাসলো জোর দিয়ে বলেছেন যে ‘অনুপ্রেরণার এ তত্ত্বটি প্রাণীকেন্দ্রিক হওয়ার পরিবর্তে নৃতাত্ত্বিক হতে হবে।’ তিনি মনে করেন, প্রাণীকেন্দ্রিক স্তর-পারম্পর্যের শেষ প্রান্তে মানুষের মানবিক গুণাবলির বিকাশ ঘটেছে। ‘মানুষের উচ্চতর প্রকৃতি মানুষের নিম্নতর প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। উচ্চতর প্রকৃতির জন্য একটি ভিত্তি প্রয়োজন। এ ভিত্তি ছাড়া কাঠামো ভেঙে যায় ... দেবতার মতো আমাদের যেসব গুণাবলি আছে সেগুলো মূলত আমাদের প্রাণীকেন্দ্রিক গুণাবলির উপরে অবস্থিত এবং প্রাণীকেন্দ্রিক এসব গুণাবলির প্রয়োজন আছে।’ আবুলফ আরও বলেন, ‘সমস্ত প্রাণী বেঁচে থাকার ও সুরক্ষার সন্ধান করে, বিশেষত স্তন্যপায়ী প্রাণীরাও সামাজিক ও সম্মানের চাহিদা পূরণের চেষ্টা করেন ... মাসলোর ধ্রুপদী পাঁচটি স্তরের প্রথম চারটি স্তর মানুষের জন্য তেমন কোনো বিশেষ স্তর নয়। এটা প্রাণীদের মধ্যেও বিদ্যমান। [২৫] এমনকি যখন এটি ‘আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা’ এর কথা আসে, তখনও আবুলফ যুক্তি দেখান যে, মানুষ কীভাবে নিজেকে উপলব্ধ করবে তা ততটা নির্দিষ্টভাবে পরিষ্কার নয়। সর্বোপরি, মাসলোর মতে, ‘আত্মোপলব্ধি বা আত্ম-প্রতিষ্ঠা’ এর ব্যাপারটি ‘মানবপ্রকৃতির একটি অন্তর্নিহিত, আরও জৈবিক, মানবপ্রকৃতির মূলকেন্দ্রের একটি বিষয়। এটা আসলে একজন ব্যক্তির স্বভাবগত, সহজাত ও প্রকৃত মূল্যবোধকে খুঁজে যাওয়ার একটি বিষয়। [এই খোঁজ ব্যক্তি নিজেই নিজের ভেতর ভেতর চালিয়ে যায়।] ব্যক্তি এভাবে নিজের নির্বাচন করার স্বাধীনতাকে পর্যবেক্ষণ ও তদারকি করে: ‘একজন সংগীতজ্ঞকে অবশ্যই সংগীত তৈরি করতে হবে’, ‘সুতরাং স্বাধীনতা কেবল নির্বাচন করার কিছু ক্ষেত্রের মধ্যে সীমাবদ্ধ।

আরও দেখুন

তথ্যসূত্র

  1. "Maslow's Hierarchy of Needs"simply psychology। সংগ্রহের তারিখ ৮ নভেম্বর ২০১৮ 
  2. Maslow, A.H. (১৯৪৩)। "A theory of human motivation": 370–96। ডিওআই:10.1037/h0054346সাইট সিয়ারX 10.1.1.334.7586অবাধে প্রবেশযোগ্য – psychclassics.yorku.ca-এর মাধ্যমে। 
  3. Deckers, Lambert (২০১৮)। Motivation: Biological, Psychological, and Environmental। Routledge Press। 
  4. Maslow, A (১৯৫৪)। Motivation and personality। Harper। আইএসবিএন 978-0-06-041987-5 
  5. Maslow, Abraham H. (১৯৯৬)। "Critique of self-actualization theory"। Future visions: The unpublished papers of Abraham Maslow। Sage। পৃষ্ঠা 26–32। 
  6. Maslow, Abraham H. (১৯৬৯)। "The farther reaches of human nature": 1–9। 
  7. Maslow, Abraham H. (১৯৭১)। The farther reaches of human nature। The Viking Press। 
  8. Koltko-Rivera, Mark E. (২০০৬)। "Rediscovering the Later Version of Maslow's Hierarchy of Needs: Self-Transcendence and Opportunities for Theory, Research, and Unification" (পিডিএফ): 302–317। ডিওআই:10.1037/1089-2680.10.4.302। ২৫ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৬ মার্চ ২০২১ 
  9. Garcia-Romeu, Albert (২০১০)। "Self-transcendence as a measurable transpersonal construct" (পিডিএফ): 26–47। 
  10. Maslow 1971
  11. Villarica, H. (আগস্ট ১৭, ২০১১)। "Maslow 2.0: A new and improved recipe for happiness"The Atlantic 
  12. Tay, L.; Diener, E. (২০১১)। "Needs and subjective well-being around the world": 354–365। ডিওআই:10.1037/a0023779পিএমআইডি 21688922 
  13. Abulof, Uriel (২০১৭-১২-০১)। "Introduction: Why We Need Maslow in the Twenty-First Century" (ইংরেজি ভাষায়): 508–509। আইএসএসএন 0147-2011ডিওআই:10.1007/s12115-017-0198-6অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  14. Mittelman, W. (১৯৯১)। "Maslow's study of self-actualization: A reinterpretation": 114–135। ডিওআই:10.1177/0022167891311010 
  15. Wahba, M. A.; Bridwell, L. G. (১৯৭৬)। "Maslow reconsidered: A review of research on the need hierarchy theory": 212–240। ডিওআই:10.1016/0030-5073(76)90038-6 
  16. Hofstede, G. (১৯৮৪)। "The cultural relativity of the quality of life concept" (পিডিএফ): 389–398। ডিওআই:10.5465/amr.1984.4279653। ২০১৪-১১-১২ তারিখে মূল (পিডিএফ) থেকে আর্কাইভ করা। 
  17. Jones, M. (২৮ জুন ২০০৭)। "Hofstede - Culturally questionable?" 
  18. Cianci, R.; Gambrel, P. A. (২০০৩)। "Maslow's hierarchy of needs: Does it apply in a collectivist culture": 143–161। 
  19. Kenrick, D. (মে ১৯, ২০১০)। "Rebuilding Maslow's pyramid on an evolutionary foundation"Psychology Today 
  20. Kenrick, D. T.; Griskevicius, V. (২০১০)। "Renovating the pyramid of needs: Contemporary extensions built upon ancient foundations": 292–314। ডিওআই:10.1177/1745691610369469পিএমআইডি 21874133পিএমসি 3161123অবাধে প্রবেশযোগ্য 
  21. Tang, T. L.; West, W. B. (১৯৯৭)। "The importance of human needs during peacetime, retrospective peacetime, and the Persian Gulf War": 47–62। ডিওআই:10.1007/BF02766072 
  22. Tang, T. L.; Ibrahim, A. H. (১৯৯৮)। "Importance of human needs during retrospective peacetime and the Persian Gulf War: Mid-eastern employees": 25–37। ডিওআই:10.1023/A:1022902803386 
  23. Tang, T. L.; Ibrahim, A. H. (২০০২)। "Effects of war-related stress on the satisfaction of human needs: The United States and the Middle East": 35–53। 
  24. Goebel, B. L.; Brown, D. R. (১৯৮১)। "Age differences in motivation related to Maslow's need hierarchy": 809–815। ডিওআই:10.1037/0012-1649.17.6.809 
  25. Abulof, Uriel (ডিসে ২০১৭)। "Be Yourself! How Am I Not Myself?" (ইংরেজি ভাষায়): 530–532। আইএসএসএন 0147-2011ডিওআই:10.1007/s12115-017-0183-0 

আরও পড়ুন

বহিঃসংযোগ

Read other articles:

Strada statale 201dell'Aeroporto di FiumicinoDenominazioni successiveAutostrada A91 LocalizzazioneStato Italia Regioni Lazio DatiClassificazioneStrada statale InizioRoma FineAeroporto di Roma-Fiumicino Lunghezza25,000 km Data apertura1959[1] Provvedimento di istituzioneLegge 16 giugno 1955, n. 513[2] GestoreANAS Manuale La ex strada statale 201 dell'Aeroporto di Fiumicino (SS 201), poi diventata autostrada A91, era una strada statale italiana, successivamente elevata...

 

  هذه المقالة عن الجيش الوطني الشعبي الجزائري. لمعانٍ أخرى، طالع وزارة الدفاع الوطني (الجزائر). الجيش الوطني الشعبي الجزائري شعار الجيش الوطني الشعبي الجزائري علم الجيش الوطني الشعبي الجزائري الدولة  الجزائر التأسيس 1954 (منذ 69 سنة) شعار مكتوب نحن أسود***أسود الغابنحن ...

 

Pakistani politician Shahram Khan TarakaiProvincial Minister of Khyber Pakhtunkhwa for Local Government, Elections, and Rural DevelopmentIn office29 August 2018 – 26 January 2020Chief MinisterMahmood KhanMember of the Provincial Assembly of Khyber PakhtunkhwaIn office13 August 2018 – 18 January 2023ConstituencyPK-47 (Swabi-V)In office29 May 2013 – 28 May 2018Provincial Minister of Khyber Pakhtunkha for EducationIn office18 September 2020 – 18 Januar...

2019 Indian filmArticle 15Theatrical release posterDirected byAnubhav SinhaWritten byGaurav SolankiAnubhav SinhaProduced byAnubhav SinhaStarring Ayushmann Khurrana Nassar Manoj Pahwa Kumud Mishra Isha Talwar Sayani Gupta Mohammed Zeeshan Ayyub CinematographyEwan MulliganEdited byYasha RamchandaniMusic bySongs:Anurag Saikia Piyush ShankarDevin ParkarGingger ShankarBackground Score: Mangesh DhakdeProductioncompaniesBenaras Media WorksZee StudiosDistributed byZee StudiosRelease date 28 June...

 

Die Villa, in der 1895 Freiherr d’Orville von Löwenclau wohnte, ist ein Wohnhaus in der Oscar-Pletsch-Straße 1 im Stadtteil Kötzschenbroda der sächsischen Stadt Radebeul. Villa d’Orville von Löwenclau Villa d’Orville von Löwenclau Direkt vor dem breiten Bau des ehemaligen Amtsgerichts (Bildmitte) ist der spitze Turm der Villa zu sehen. Im Hintergrund die Elbwiesen Inhaltsverzeichnis 1 Beschreibung 2 Geschichte 3 Literatur 4 Weblinks 5 Einzelnachweise Beschreibung Die auf einem Eck...

 

German actor Theo LingenPublicity photoBornFranz Theodor Schmitz(1903-06-10)10 June 1903Hanover, Prussia, German EmpireDied10 November 1978(1978-11-10) (aged 75)Vienna, AustriaOccupation(s)Actor, film director, screenwriterYears active1929–1978SpouseMarianne Zoff (1928–78) Theo Lingen (German pronunciation: [ˈteːo ˈlɪŋən] ⓘ; 10 June 1903 – 10 November 1978), born Franz Theodor Schmitz, was a German actor, film director and screenwriter. He appeared in more than...

Presidential Medal of Freedom adalah sebuah penghargaan yang diberikan oleh Presiden Amerika Serikat dan merupakan penghargaan sipil tertinggi Amerika Serikat yang setara dengan Congressional Gold Medal. Penghargaan tersebut diberikan kepada orang-orang yang membuat sebuah kontribusi berjasa secara khusus kepada keamanan atau kepentingan nasional Amerika Serikat, perdamaian dunia, kebudayaan atau dorongan negeri atau swasta signifikan lainnya.[1] Penghargaan tersebut tak dibatasi kepa...

 

Павло Андрійович Бакунець Народився 10 липня 1987(1987-07-10) (36 років)м. Яворів, Львівська областьГромадянство  УкраїнаДіяльність громадський діячполітикAlma mater УКУЛьвівський національний університет ім. І. ФранкаЛьвівська бізнес-школаПосада народний депутат УкраїниПартія...

 

Prof. Dr. Mr.Abdoel Gaffar PringgodigdoAbdoel Gaffar Pringgodigdo, ca. 1950Menteri Hukum dan Hak Asasi Manusia Indonesia ke-4Masa jabatan21 Januari 1950 – 6 September 1950PresidenSoekarno (RIS) Assaat (RI)Perdana MenteriAbdoel HalimPendahuluSoesanto TirtoprodjoPenggantiWongsonegoroMenteri Sekretaris Negara Indonesia ke-1Masa jabatan19 Agustus 1945 – 14 November 1945PresidenSoekarnoPendahuluTidak AdaPenggantiMohammad IchsanAbdul Wahab SurjodiningratRektor Universi...

Swedish singer In this Swedish name, the birth surname is Samuelsson and the pseudonymic surname is Jakobs. Jakobsdotter is a patronymic. Cornelia JakobsJakobs in 2022Background informationBirth nameAnna Cornelia Jakobsdotter SamuelssonBorn (1992-03-09) 9 March 1992 (age 31)Nacka Municipality, SwedenGenresPopOccupation(s)SingersongwriterYears active2010–presentFormerly ofLove GenerationMusical artist Anna Cornelia Jakobsdotter Samuelsson (born 9 March 1992), known professionally as Cor...

 

Former railway station in England Spencer Road HaltThe footbridge over the station in 2018, the line beneath overgrown with treesLocationSouth CroydonLocal authorityCroydonGrid referenceTQ332643OwnerWoodside and South Croydon Joint RailwayNumber of platforms2Key dates1 September 1906 (1906-09-01)Opened15 March 1915 (1915-03-15)ClosedOther information London transport portal Spencer Road Halt railway station was a halt on the Woodside and South Croydon Ra...

 

Indian Army regiment 71 Armoured RegimentActive1971 – presentCountry IndiaAllegianceIndiaBranch Indian ArmyTypeArmoured CorpsSizeRegimentMotto(s)शत्रुनाशShatrunash (Destruction of the enemy)ColorsPurple, Red and GoldEquipmentT-90 tanksCommandersNotablecommandersMajor-General Aneet Singh Sihota, VSM[1]Lieutenant General Kotheneth Surendranath, AVSM**, SM, VSM[2]Major General Amardeep BhardwajInsigniaAbbreviation71 Armd RegtMilitary unit T-90 tanks of the 71 Ar...

Bavarian prince You can help expand this article with text translated from the corresponding article in German. (April 2022) Click [show] for important translation instructions. View a machine-translated version of the German article. Machine translation, like DeepL or Google Translate, is a useful starting point for translations, but translators must revise errors as necessary and confirm that the translation is accurate, rather than simply copy-pasting machine-translated text into the ...

 

Genistein adalah Isoflavonoid yang digambarkan sebagai inhibitor angiogenesis dan fitoestrogen Ini pertama kali diisolasi pada tahun 1899 dari sapu pewarna, 'Genista tinctoria' karenanya, nama kimianya. Struktur majemuk didirikan pada 1926, ketika ditemukan identik dengan Prunetol.[1] Pemurnian Selain berfungsi sebagai antioksidan dan anthelmintik, banyak isoflavonoid telah terbukti berinteraksi dengan reseptor estrogen hewan dan manusia, menyebabkan efek dalam tubuh yang mirip denga...

 

Astas de un macho de ciervo rojo. Las astas —también llamada en ocasiones cornamenta o cuerna— son, en zoología, las formaciones rígidas anejas a la parte superior de la cabeza de cérvidos como son, por ejemplo: el ciervo o el reno. Son exclusivas de los ungulados de la familia Cervidae (familia perteneciente al orden Artiodactyla). Las astas son diferentes de los cuernos,[1]​ los cuales son exclusivos de otro grupo de artiodáctilos, pero de la familia Bovidae. Las astas crecen...

Mappa del Delta del Mississippi. Il Delta del Mississippi, in inglese Mississippi Delta (da non confondere con il delta del fiume Mississippi, ovvero il delta fluviale del fiume Mississippi sfociante nel Golfo del Messico) è una regione situata nella parte nord-occidentale dello Stato del Mississippi (comprendendo anche aree dell'Arkansas e della Louisiana) che si estende tra il fiume Yazoo (est) e il fiume Mississippi (ovest). L'area è stata chiamata The Most Southern Place on Earth (la re...

 

Îles ExtérieuresOuter Islands (en) Carte des Seychelles montrant les îles Intérieures (autour de Mahé) et les îles Extérieures (îles Amirante, Coëtivy, atoll Farquhar, Cosmoledo et Aldabra). Géographie Pays Seychelles Archipel Seychelles Localisation Océan Indien Coordonnées 8° S, 50° E Superficie 211,3 km2 Nombre d'îles 64 Île(s) principale(s) Aldabra Géologie Îles coralliennes Administration Statut Ne font partie d'aucun district des Seychelles. Démog...

 

French painter (1616–1670) A Poultry Merchant and an Old Woman Warming Her Hands, circa 1652 by Jean Michelin Jean Michelin (1616–1670) was a French Protestant painter. Michelin started out in his career as primarily a bamboccianti painter. He later branched out into religious themed paintings.[1] One of his notable pieces was a depiction of the Adoration of the Shepherds, which currently resides in The Louvre.[2] References ^ Jean Michelin Brief Bio. Retrieved 2012-04-23....

Paghimo ni bot Lsjbot. 52°45′17″N 7°03′29″E / 52.75486°N 7.05794°E / 52.75486; 7.05794 Limietwijk Kanal Nasod  Olandres Lalawigan Provincie Drenthe Gitas-on 14 m (46 ft) Tiganos 52°45′17″N 7°03′29″E / 52.75486°N 7.05794°E / 52.75486; 7.05794 Timezone CET (UTC+1)  - summer (DST) CEST (UTC+2) GeoNames 2751595 Kanal ang Limietwijk sa Olandres.[1] Nahimutang ni sa lalawigan sa Provincie Drenthe,...

 

Paghimo ni bot Lsjbot. 4°22′59″N 27°08′49″E / 4.38309°N 27.14695°E / 4.38309; 27.14695 Nabande Suba Nasod  Demokratikanhong Republika sa Konggo Lalawigan Orientale Province Gitas-on 660 m (2,165 ft) Tiganos 4°22′59″N 27°08′49″E / 4.38309°N 27.14695°E / 4.38309; 27.14695 Timezone CAT (UTC+2) GeoNames 8074538 Suba ang Nabande sa Demokratikanhong Republika sa Konggo.[1] Nahimutang ni sa lalawigan sa Oriental...

 

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!