আফগান শরণার্থীগণ হলেন আফগানিস্তানের নাগরিক যাঁরা বড়ো যুদ্ধবিগ্রহ অথবা নিপীড়নের ফলে তাদের দেশত্যাগ করেছেন। ১৯৭৯ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েতের আফগানিস্তান আক্রমণ সেদেশ থেকে অভ্যন্তরীণ স্থান ত্যাগ করে শরণার্থীদের প্রথম জোয়ার সূচিত হয় এবং তারা প্রতিবেশী দেশ পাকিস্তান ও ইরানে আশ্রয় পেয়ে যান। ১৯৮৯ খ্রিষ্টাব্দে সোভিয়েত যুদ্ধ শেষ হলে শরণার্থীরা তাদের নিজ দেশে ফিরতে শুরু করেন। ১৯৯২ খ্রিষ্টাব্দের এপ্রিলে মুজাহিদিন কাবুল এবং অন্যান্য বড়ো শহরের নিয়ন্ত্রণ হাতে নিলে একটা ব্যাপক গৃহযুদ্ধ বেধে যায়। আফগানিরা আবার প্রতিবেশী দেশগুলোতে ছড়িয়ে পড়েন।
কম করে ৩২ বছরর জন্যে আফগানিস্তানকে বিশ্বের সবচেয়ে বড়ো শরণার্থী তৈরির দেশ বানিয়ে সর্বমোট ৬০ লক্ষ আফগান শরণার্থী পাকিস্তান এবং ইরানে আশ্রিত ছিল।[১][২] আফগানিরা বর্তমানে সিরীয় শরণার্থীদের পর দ্বিতীয় সর্বাধিক শরণার্থী গোষ্ঠী।[৩] ইরান এবং পাকিস্তানে সবচেয়ে বেশি (৯৫ শতাংশ) আফগান শরণার্থীর অবস্থান।[১] যেসব দেশ ইন্টারন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাসিস্ট্যান্স ফোর্সের (আইএসএএফ) অংশ তারা অল্প সংখ্যক আফগানিকে নিয়ে তাদের সংশ্লিষ্ট কর্মীদলে কাজ করছে।[৪]আফগানি শিখ এবং আফগানি হিন্দুদের মতো জাতিগত সংখ্যালঘুরা প্রায়ই ভারতে চলে আসে।[৫]
অভ্যন্তরীণ স্থানত্যাগী আফগানরা
আফগানিস্তানে ১০ লক্ষের বেশি অভ্যন্তরীণ স্থানত্যাগী জনগণ আছেন। যদিও সেখানে প্রাকৃতিক দুর্যোগেরও কারণ আছে, আফগানিস্তানে বেশির ভাগ অভ্যন্তরীণ স্থান ত্যাগ সংঘর্ষ এবং হিংসার ফলেই এটা হয়েছিল। সোভিয়েত আক্রমণের ফলে ২০ লক্ষ আফগানকে অভ্যন্তরীণ স্থান ত্যাগ করতে হয়েছিল, আর বেশির ভাগ ছিল গ্রামাঞ্চল থেকে শহরাঞ্চলে। ১৯৯২-৯৬ খ্রিষ্টাব্দের আফগান গৃহযুদ্ধের ফল হয়েছিল একটা নতুন অভ্যন্তরীণ স্থানচ্যুতি; তালিবান শাসিত অঞ্চল থেকে অনেক আফগান উত্তরাঞ্চলের শহরগুলোর দিকে পালিয়ে গিয়েছিল। আফগানিস্তান ধারাবাহিকভাবে নিরাপত্তাহীনতা এবং সংঘর্ষে ভুগতে থাকায় অভ্যন্তরীণ স্থানত্যাগের ঘটনা বেড়ে যায়।
আশ্রয়দানকারী দেশসমূহ
ইউএনএইচসিআর-এর তথ্য অনুযায়ী বিশ্বের ৭০টি দেশে আনুমানিক ২৬ লক্ষ নথিভুক্ত শরণার্থী আছে, তার মধ্যে বেশির ভাগকে (৯৫ শতাংশ) দুটো ইসলামিক প্রজাতন্ত্র ইরান এবং পাকিস্তান আশ্রয় দিয়েছে। প্রতি চার জনের মধ্যে তিন জন আফগান বাঁচার জন্যে অভ্যন্তরীণ, বৈদেশিক অথবা বিভিন্নভাবে স্থান ত্যাগ করেছে।
পাকিস্তান
পাকিস্তান ৪০ বছর ধরে ১০ লক্ষের বেশি শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়েছে।[৬] ১৫ লক্ষ নথিভুক্ত আফগান শরণার্থী পাকিস্তানে বসবাস করছে বলে বলা হয়, এছাড়াও প্রায় ১০ লক্ষ অনথিভুক্ত শরণার্থী আছে।[৭][৮] যাহোক, সম্প্রতি নিরাপত্তার কারণে তথা পাকিস্তান এবং আফগানিস্তানের মধ্যে রাজনৈতিক উত্তেজনায় আফগান শরণার্থীদের দেশে ফেরার অন্তঃপ্রবাহ চলেছে।[৬] পাকিস্তান প্রাথমিকভাবে আফগান শরণার্থীদের ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত আইনত শরণার্থীর মর্যাদা দিয়েছে, তার পরে তাদের এদেশ ছাড়তে হবে অথবা নিজ দেশে ফিরতে হবে, যাহোক, সেপ্টেম্বরে তাদের ফেরার সময়সীমা ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের ৩১ মার্চ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।[৬]
২০১৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ ডিসেম্বর তেহরিক-ই-তালিবান (টিটিপি) গোষ্ঠী পাকিস্তানি তালিবানএর দ্বারা পেশওয়ারে একটা স্কুলে সন্ত্রাসবাদী হামলা সংঘটিত হয়,[৯] যার নেতারা আফগানিস্তানে উদ্ভূত বলে দাবি করা হয়[১০] প্রবীণ পাকিস্তানি আধিকারিকদের মতে কাবুলের বাইরে থেকে নিয়ন্ত্রিত।[১১][১২] এই আক্রমণে কমপক্ষে ১৪৫ জনের মৃত্যু হয়, যার মধ্যে বেশির ভাগই স্কুলের শিশু।[৯] আক্রমণের পর সন্ত্রাসবাদকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে পাকিস্তান সরকার ন্যাশনাল অ্যাকশন প্ল্যান (এনএপি) গ্রহণ করে এবং এই কর্মকাণ্ডের ২০ দফার একটা হল আফগান শরণার্থীদের নথিভুক্তিকরণের সার্বিক নীতি প্রণয়ন।[১৩] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দ থেকে জানা যায় যে, পাকিস্তানে আফগান শরণার্থীদের বিরুদ্ধে মারাত্মক হেনস্থা, শত্রুতা এবং আফগানিস্তানে ফেরার জন্যে চাপ সৃষ্টি করা হয়েছে।[৬][১৪][১৫] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের ফেব্রুয়ারিতে হাজারে হাজারে শরণার্থীর প্রস্থান চলতে থাকে।[১৬]হিউম্যান রাইটস ওয়াচ অনুযায়ী ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে প্রায় ৩৬৫,০০০ নথিভুক্ত এবং ২০০,০০০ অনথিভুক্ত শরণার্থী পাকিস্তান থেকে দেশে ফেরত গিয়েছে।[৬][১৭] শরণার্থীদের ব্যাপক প্রস্থানকে বলা হয়েছে পাকিস্তান সরকার তথা ইউএনএইচসিআর দ্বারা স্বেচ্ছামূলক দেশে ফেরার ব্যাপার, যাহোক, হিউম্যান রাইটস ওয়াচ এক সাম্পতিক রিপোর্টে বলেছে, এটা আফগান শরণার্থীদের ওপর বেআইনি বলপ্রয়োগ এবং ফেরার স্বেচ্ছাসেবীয়ানা প্রশ্নের সম্মুখীন।[৬]
ইরান
দ্য ওয়র্ল্ড ফ্যাক্টবুকের মতে ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইরানে প্রায় ১০ লক্ষ নথিভুক্ত এবং ১৫ থেকে ২০ লক্ষের মতো অনথিভুক্ত শরণার্থী ছিল।[১৮] এই শরণার্থীদের অধিকাংশের গত সাড়ে তিন দশকের মধ্যে ইরানে জন্ম হয়েছে, তবুও তাদের আফগান নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়। ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে ধারাবাহিকভাবে ইরান থেকে ২১ শতাংশ কম ফেরত আসতে থাকে (২০১৫তে ৩১৬,৪৩০ থেকে ২০১৬তে ২৪৮,৭৬৪) এবং বিতাড়নও (২২৭,৬০১ থেকে ১৯৪,৭৬৩) ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের তুলনায় ১৪ শতাংশ কমে যায়।[১৯] আফগান শরণার্থীদের ব্যাপারে ইরানের প্রাথমিক প্রতিক্রয়া ধর্মীয় সহানুভূতির দ্বারা খোলা দরজার নীতিতে পরিচালিত ছিল, যেখানে আফগানরা ইরানে গ্যাস, খাদ্য এবং স্বাস্থ্যরক্ষায় ভর্তুকি সমেত যেকোনো শহরে যাতায়াত ও কাজ করার স্বাধীনতা পেয়েছিল (কেওইপিকেই, ২০১১)।[২০][২১] ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের গোড়ায় শুরু করে যখন ইরানের ব্যুরো ফর অ্যালেন্স অ্যান্ড ফরেন ইমিগ্রান্টস অ্যাফেয়ার্স (বিএএফআইএ) শরণার্থী সহ সকল বিদেশিদের নথিভুক্তি শুরু করে এবং অস্থায়ী বাসিন্দা কার্ড চালু করে।[২২] ২০০০ খ্রিষ্টাব্দে ইরান সরকারও ইউএনএইচসিআর-এর সঙ্গে যৌথভাবে প্রত্যাবর্তন প্রকল্পের উদ্যোগ নেয়।[২২] ২০০০ খ্রিষ্টাব্দের দশক থেকে আফগান শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তনে সাহস জোগানোর জন্যে শিক্ষা সহ কাজের বহর, বাসস্থানের জায়গা, চাকরির সীমাবদ্ধতা ইত্যাদির জন্যে আইন প্রণয়ন করেছিল[২২][২৩]
২০০২ থেকে আফগানিস্তানে ফেরা
২০০১ খ্রিষ্টাব্দের শেষ দিকে তালিবান শাসন ক্ষমতাচ্যুতির পর ৫০ লক্ষের বেশি আফগান ইউএনএইচসিআরএর মাধ্যমে পাকিস্তান এবং ইরান থেকে দেশে প্রত্যাবর্তিত।[২৪][২৫][২৬][২৭] সাম্প্রতিক বছরগুলোতে হাজার হাজার আফগান আফগানিস্তানে ফিরতে শুরু করেছেন।[৩][২৮] ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রসংঘএর মতে প্রায় ৬০০,০০০ নথিভুক্ত এবং অনথিভুক্ত আফগান পাকিস্তান থেকে প্রত্যাবর্তন করেছেন।[২৯] আইওএম-এর মতে, ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দে পাকিস্তান দেশে ফেরা আফগানের সংখ্যা ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দের দ্বিগুণেরও বেশি, এই বৃদ্ধির হার ২০১৫-এর তুলনায় ১০৮ শতাংশ (১১৯,২৭৯ থেকে ২৪৮,০৪৫)।[১৯] বাদবাকি নথিভুক্ত পাকিস্তানে আফগান শরণার্থী সংখ্যা ১৩ লক্ষের আশপাশ।[৩০] একই বছরে ইউএনএইচসিআর জানায় যে, ৯৫১,১৪২ আফগান ইরান বাস করছে।[৩১] তাদের বেশির ভাগ গত সাড়ে তিন দশকে পাকিস্তানে জন্মেছে এবং বড় হয়েছে, কিন্তু তাদের এখনো আফগান নাগরিক হিসেবে মান্যতা দেওয়া হয়।[২৪][২৫][২৮][৩২][৩৩]
আন্তর্জাতিক সহায়তা
২০০৩ খ্রিষ্টাব্দের ১৭ মার্চ আফগান শরণার্থীদের পাকিস্তান থেকে স্বেচ্ছায় প্রত্যাবর্তন সহজ করার উদ্যোগে আফগানিস্তান, পাকিস্তান এবং ইউএনএইচসিআর একটা ত্রিপাক্ষিক চুক্তি স্বাক্ষর করে।[৩৪] এছাড়াও ২০১২ খ্রিষ্টাব্দে দ্য ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অন দ্য সলিউশন স্ট্র্যাটেজি ফর আফগান রিফিউজিজ স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন সমর্থন, টেকসই পুনর্বিবেচনা এবং আশ্রয়দানকারী দেশকে সহায়তা দিতে (এসএসএআর) ইসলামিক প্রজাতন্ত্রসমূহ, আফগানিস্তান, ইরান, পাকিস্তান এবং ইউএনএইচসিআর স্বেচ্ছা প্রত্যাবর্তন সহজ করা, টেকসই পুনর্বিবেচনা এবং আশ্রয়দানকারী দেশকে সহায়তার সংস্থান করার জন্যে এই চতুষ্পক্ষীয় উদ্যোগ পুনরারম্ভ করে।[৩৫] ২০১৫ খ্রিষ্টাব্দে ইউএনএইচসিআর-এর ৬৬তম এক্সিকিউটিভ কমিটি সভার উচ্চস্তরীয় অংশ আফগান শরণার্থীদের দিকে নজর দেয়।[৩৬] এটা ছিল আন্তর্জাতিক দৃষ্টি আকর্ষণ এবং আফগান শরণার্থী পরিস্থিতির জন্যে টেকসই সমাধানসূত্র তুলে ধরা।
আফগানিস্তানে চলতে থাকা সংঘর্ষ, বেকারি এবং দারিদ্র্যের কারণে, অল্প সময়ের ব্যবধানে প্রত্যাবর্তনকারীদের অন্তঃপ্রবাহের ফলে অভ্যন্তরীণ জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে মোকাবিলা করা আফগান সরকারের পক্ষে কঠিন ছিল। ফিরতি শরণার্থীদের প্রয়োজন মেটানোর তাগিদে, আফগানিস্তানের জন্যে ২০১৭ খ্রিষ্টাব্দের মানবিক প্রতিবেদনের মধ্যে রাষ্ট্রসংঘ আন্তর্জাতিক গোষ্ঠীর কাছে ২৪ কোটি ডলার মানবিক সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল।[৩]
পরিসংখ্যান
নিচের সারণিতে দেখানো হয়েছে কীভাবে আফগান শরণার্থীরা চারটে প্রধান জনপ্রবাহে ভাগ হয়ে দেশ ছেড়েছিল:[৭][৮]
Haug, Dr. habil. Sonja; Müssig, Stephanie M.A. & Dr. Anja Stichs (২০০৯)। Bundesamt für Flüchtlinge und Migration : Muslimisches Leben in Deutschland (German ভাষায়) (2009 সংস্করণ)।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: অচেনা ভাষা (link)
↑Joseph Goldstein (ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০১৫)। "Refugees Are Pushed to Exits in Pakistan"। The New York Times। সংগ্রহের তারিখ ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০১৫। they all say they have been beaten and slapped and told nobody in Pakistan wants them anymore
↑Farzin, Farshid (২০১৩)। "Freedom of movement of Afghan refugees in Iran"। Forced Migration Review। 1: 44: 85–86 – Advanced Placement Source-এর মাধ্যমে।
↑KOEPKE, B. 2011. The situation of Afghans in the Islamic Republic of Iran nine years after the overthrow of the Taliban regime in Afghanistan. Middle East Institute.