অ্যান্টার্কটিকা (; ইংরেজি: Antarctica/ænˈtɑːrktɪkə/(শুনুনⓘ)[ক]পৃথিবীর দক্ষিণতম ও সবচেয়ে কম জনবহুল মহাদেশ। এটি কুমেরু বৃত্তের প্রায় সম্পূর্ণভাবে দক্ষিণে অবস্থিত এবং চারিদিকে দক্ষিণ মহাসাগর দ্বারা বেষ্টিত, যা কুমেরু মহাসাগর নামেও পরিচিত। এই মহাদেশটির উপর ভৌগোলিক দক্ষিণ মেরু অবস্থিত। অ্যান্টার্কটিকা বিশ্বের পঞ্চম বৃহত্তম মহাদেশ এবং ইউরোপ মহাদেশের তুলনায় ৪০% বড়। এর আয়তন ১,৪২,০০,০০০ বর্গকিলোমিটার (৫৫,০০,০০০ বর্গমাইল)। অ্যান্টার্কটিকার বেশিরভাগ ভূখণ্ড বরফাবৃত, যার গড় বেধ ১.৯ কিলোমিটার (১.২ মাইল)।
সাধারণভাবে অ্যান্টার্কটিকা অন্যান্য মহাদেশের তুলনায় শীতল, শুষ্ক ও বায়ুপ্রবাহপূর্ণ এবং এর গড় উচ্চতা সর্বোচ্চ। এটি মূলত একটি মেরু মরুভূমি, যেখানে উপকূলীয় এলাকার বার্ষিক বৃষ্টিপাত ২০০ মিলিমিটার (৮ ইঞ্চি)-এর অধিক এবং অভ্যন্তরে বৃষ্টিপাত অনেক কম। বিশ্বের প্রায় ৭০% স্বাদু পানির ভাণ্ডার এখানে হিমায়িত অবস্থায় পাওয়া যায়, এবং একে গলালে বিশ্বের সমুদ্র সমতল প্রায় ৬০ মিটার (২০০ ফুট) বেড়ে যাবে। অ্যান্টার্কটিকায় পৃথিবীর সর্বনিম্ন তাপমাত্রা −৮৯.২ °সে (−১২৮.৬ °ফা) রেকর্ড করা হয়েছে। গ্রীষ্মকালে উপকূলীয় এলাকার তাপমাত্রা ১০ °সে (৫০ °ফা) পর্যন্ত বাড়তে পারে। স্থানীয় প্রাণী প্রজাতির মধ্যে মাইট, সুতাকৃমি, পেঙ্গুইন, সামুদ্রিক সীল ও টারডিগ্রেড অন্তর্গত। যেখানে গাছপালা পাওয়া যায়, সেখানে উদ্ভিদ প্রজাতির মধ্যে মূলত মস ও লাইকেন পাওয়া যায়।
অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের নামটি মধ্য ফরাসিআন্তার্তিক্ (antartique বা antarctique) হতে উদ্ভূত, যা আবার লাতিনআন্তার্ক্তিকুস্ (antarcticus, "উত্তরের বিপরীত") থেকে প্রাপ্ত। আন্তার্ক্তিকুস্ শব্দটি গ্রিকআন্তি- (ἀντι-, "বিপরীত") ও আর্ক্তিকোস্ (ἀρκτικός, "সপ্তর্ষি, উত্তর") হতে উদ্ভূত।[৪] গ্রিক দার্শনিক এরিস্টটল তাঁর আনু. ৩৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দেরমেতেওরোলজিকা গ্রন্থে আন্তার্ক্তিকোস্ অঞ্চল সম্পর্কে আলোচনা করেছেন।[৫] গ্রিক ভূগোলবিদ মারিনোস তাঁর খ্রিস্টীয় দ্বিতীয় শতাব্দীর বিশ্ব মানচিত্রে এই নাম ব্যবহার করেছিলেন বলে জানা যায়, কিন্তু সেই মানচিত্র কালের সঙ্গে হারিয়ে গেছে। রোমান লেখক হাইজিনাস ও এপুলিয়াস গ্রিক নামটির রোমানীকৃত রূপ পোলুস্ আন্তার্ক্তিকুস্ (polus antarcticus) ব্যবহার করেছিলেন,[৬] যেখান থেকে প্রাচীন ফরাসিপোল্ আন্তার্তিক্ (pole antartike; আধুনিক বানান pôle antarctique) আগত। প্রাচীন ফরাসি শব্দটি ১২৭০ সালে প্রথম পাওয়া যায় এবং সেখান থেকে মধ্য ইংরেজিপোল্ আন্টার্টিক্ (pol antartik) আগত, যা ইংরেজ লেখক জেফ্রি চসারের লেখা এক গ্রন্থে পাওয়া যায়।[৪]
ধ্রুপদী সভ্যতার সময় থেকে ইউরোপীয় বুদ্ধিজীবীদের মধ্যে তেরা আউস্ত্রালিস্ (terra australis, আক্ষ.'দক্ষিণ ভূমি') নামক এক কাল্পনিক মহাদেশের ধারণা ছিল। তাদের ধারণা অনুযায়ী, তেরা আউস্ত্রালিস্ পৃথিবীর সুদূর দক্ষিণে এক বিশাল মহাদেশ যা ইউরোপ, এশিয়া ও উত্তর আফ্রিকার ভূখণ্ডের ভারসাম্য বজায় রাখে। এধরনের মহাদেশের বিশ্বাস ইউরোপীয়দের দ্বারা অস্ট্রেলিয়ার আবিষ্কার অবধি স্থায়ী ছিল।[৭]
১৯ শতকের গোড়ার দিকে অন্বেষণকারী ম্যাথিউ ফ্লিন্ডার্সঅস্ট্রেলিয়ার দক্ষিণে একটি বিচ্ছিন্ন মহাদেশের অস্তিত্ব নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন, যাকে তখন নিউ হল্যান্ড বলা হয়েছিল, এবং এইভাবে অস্ট্রেলিয়ার পরিবর্তে "টেরা অস্ট্রালিস" নামটি ব্যবহার করার পক্ষে সমর্থন করেছিলেন। [৮][৯] ১৮২৪ সালে সিডনির ঔপনিবেশিক কর্তৃপক্ষ আনুষ্ঠানিকভাবে নিউ হল্যান্ড মহাদেশের নাম পরিবর্তন করে অস্ট্রেলিয়া রাখে, অ্যান্টার্কটিকার উল্লেখ হিসাবে "টেরা অস্ট্রালিস" শব্দটি অনুপলব্ধ রেখেছিল। পরবর্তী দশকগুলিতে, ভূগোলবিদদেরকে "অ্যান্টার্কটিক মহাদেশ" এর মতো আনাড়ি বাক্যাংশ দিয়ে কাজ করতে হয়েছিল। তারা আলটিমা এবং অ্যান্টিপোডিয়ার মতো বিভিন্ন নাম প্রস্তাব করে আরও কাব্যিক প্রতিস্থাপনের জন্য অনুসন্ধান করেছিল। [১০] ১৮৯০-এর দশকে প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে একটি মহাদেশের নাম হিসাবে "অ্যান্টার্কটিকা" শব্দটি ব্যবহৃত হয়। স্কটিশ মানচিত্রাঙ্কনবিদজন জর্জ বার্থেলোমিউকে এই নামকরণের হোতা বলে মনে করা হয়।[১১]
এই নিবন্ধটি অ্যান্টার্কটিকার ইতিহাস সম্পর্কে। অ্যান্টার্কটিকা মহাদেশের জন্য অ্যান্টার্কটিকা দেখুন।
অ্যান্টার্কটিকার ইতিহাসের সূচনা প্রাচীন পশ্চিমা তত্ত্বের এক বিস্তীর্ণ মহাদেশের অস্তিত্বের বর্ণনা থেকে। এতে এই মহাদেশটি টেরা অস্ট্রালিস নামে পরিচিত, যা বিশ্বের সুদূর দক্ষিণে অবস্থিত বলে মনে করা হয়। আন্টার্কটিক শব্দটি খ্রিষ্টপূর্ব দ্বিতীয় শতাব্দিতে টায়ার এর মারিনাস সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন যার অর্থ "আর্কটিক বা সুমেরুবৃত্তের বিপরীত"।
পঞ্চদশ ও ষোড়শ শতাব্দীতে কেপ অফ গুড হোপ এবং কেপ হর্ন এর বৃত্তান্ত প্রমাণ করে যে যদি টেরা অস্ট্রালিস ইনকোনিটিটা ("অজানা দক্ষিণাঞ্চলীয় ভূমি") বলে কোন স্থানের অস্তিত্ব থাকে, তবে এটি একটি স্বতন্ত্র মহাদেশ হবে। ১৭৭৩ সালে জেমস কুক এবং তার নাবিকদল সর্বপ্রথম অ্যান্টার্কটিক সার্কেল বা কুমেরুবৃত্ত অতিক্রম করেন ও এর নিকটবর্তী দ্বীপগুলি আবিষ্কার করেন। তবে তারা অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখণ্ড দেখতে পাননি। ধারণা করা হয় যে তারা মূল ভূখণ্ডের প্রায় ২৪০ কি.মি.(১৫০ মাইল) দূরে অবস্থান করছিলেন।
১৮১৯ সালে ৭৪ টি কামান বিশিষ্ট সান তেলমো জাহাজের ৬৪৪ জন নাবিকের মধ্যে কয়েকজন সম্ভবত হাইপোথার্মিয়ায় মৃত্যুবরণ করার পূর্বে অ্যান্টার্কটিকায় প্রথম পা রাখেন। যদিও এ ঘটনার কোন সুনির্দিষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায় না। এর এক বছর পর ১৮২০ সালের ২৭শে জানুয়ারি, ফাবিয়ান গোতলিয়েব ফন বেলিংশসন ও মিখাইল লাযারেভ এর নেতৃত্বে পরিচালিত এক অভিযানে তারা প্রিন্সেস মার্থা উপকূলের সাথে সংযুক্ত একটি বরফের চাঁই এর তাক বা আইস শেলফ আবিষ্কার করেন যা পরবর্তীতে ফিম্বুল আইস শেলফ নামে পরিচিত হয়। বেলিংশসন ও লাযারেভ আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যান্টার্কটিকার মূল ভূখণ্ড দর্শনকারী ও আবিষ্কারকরূপে পরিচিত হন। এর তিনদিন পর ১৮২০ সালের ৩০শে জানুয়ারী, এডওয়ার্ড বার্নসফিল্ডের নেতৃত্বে এক ব্রিটিশ অভিযাত্রীদল ট্রিনিটি পেনিনসুলা দেখতে পান, এবং এর দশ মাস পরে ১৭ই নভেম্বর, ১৮২০ তারিখে আমেরিকান সীল-শিকারী নাথানিয়েল পামার অ্যান্টার্কটিকা দেখতে পান। প্রথম আনুষ্ঠানিকভাবে অ্যান্টার্কটিকায় মানুষের পদার্পণ ঘটে সম্ভবত মাত্র এক বছর পরে যখন ক্যাপ্টেন জন ডেভিস নামে একজন আমেরিকান সীল-শিকারী সেখানে বরফের উপর পা রাখেন।
বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককে "অ্যান্টার্কটিক অভিযানের স্বর্ণযুগ" আখ্যা দেয়া হয়। এ সময় বেশ কয়েকটি অভিযাত্রীদল দক্ষিণ মেরুতে পৌঁছাতে চেষ্টা করেছিল। এদের মধ্যে অনেকেই আহত হন ও মৃত্যুবরণ করেন। নরওয়ের রুয়াল আমুনসেন ব্রিটনের রবার্ট ফ্যালকন স্কটের সাথে এক নাটকীয় প্রতিযোগিতার পর ১৩ই ডিদিসেম্বর১৯১১ সালে অ্যান্টার্কটিকায় পৌঁছেছিলেন।
অ্যান্টার্কটিক চুক্তি এবং সম্পর্কিত চুক্তিগুলি, যা সম্মিলিতভাবে অ্যান্টার্কটিক চুক্তি ব্যবস্থা ( এটিএস ) নামে পরিচিত, আন্টার্কটিকার সাথে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক নিয়ন্ত্রণ করে, পৃথিবীর একমাত্র মহাদেশ যেখানে স্থানীয় মানব জনসংখ্যা নেই।এটি ছিল শীতল যুদ্ধের সময় প্রতিষ্ঠিত প্রথম অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ চুক্তি, মহাদেশটিকে বৈজ্ঞানিক সংরক্ষণ হিসাবে আলাদা করে, বৈজ্ঞানিক তদন্তের স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করে এবং সামরিক কার্যকলাপ নিষিদ্ধ করে; চুক্তি পদ্ধতির উদ্দেশ্যে, অ্যান্টার্কটিকাকে ৬০°সে অক্ষাংশের দক্ষিণে সমস্ত ভূমি এবং বরফের তাক হিসাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়।সেপ্টেম্বর ২০০৪ সাল থেকে, অ্যান্টার্কটিক চুক্তি সচিবালয়, যা চুক্তি ব্যবস্থা বাস্তবায়ন করে, এর সদর দফতর আর্জেন্টিনার বুয়েনস আইরেসে অবস্থিত। [১২]
প্রধান চুক্তি স্বাক্ষরের জন্য ১ ডিসেম্বর, ১৯৫৯ সালে খোলা হয়েছিল এবং আনুষ্ঠানিকভাবে [১৩] জুন, ১৯৬১ সালে কার্যকর হয়।১৯৫৭-৫৮ সালের ইন্টারন্যাশনাল জিওফিজিক্যাল ইয়ার (আইজিওয়াই) সময় অ্যান্টার্কটিকায় সক্রিয় ১২টি দেশ মূল স্বাক্ষরকারী ছিল: আর্জেন্টিনা, অস্ট্রেলিয়া, বেলজিয়াম, চিলি, ফ্রান্স, জাপান, নিউজিল্যান্ড, নরওয়ে, দক্ষিণ আফ্রিকা, সোভিয়েত ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এই দেশগুলি IGY-এর জন্য ৫৫ টিরও বেশি অ্যান্টার্কটিক গবেষণা কেন্দ্র স্থাপন করেছিল, এবং চুক্তির পরবর্তী ঘোষণাকে অর্জিত অপারেশনাল এবং বৈজ্ঞানিক সহযোগিতার একটি কূটনৈতিক অভিব্যক্তি হিসাবে দেখা হয়েছিল। ২০১৯ সাল পর্যন্ত, চুক্তিতে ৫৪টি পক্ষ রয়েছে। [১৪]
টীকা
↑মূল Antarctica শব্দকে আসলে প্রথম c উহ্য করে উচ্চারণ করা হতো, কিন্তু পরে বানান অনুযায়ী উচ্চারণ আরও জনপ্রিয় হওয়ার জন্য বানান অনুযায়ী উচ্চারণকে আরও সঠিক বলে বিবেচিত করা হয়েছে। অবশ্য অনেক ইংরেজি শব্দকে প্রথম c উহ্য, এমনকি প্রথম t উহ্য করে উচ্চারণ করা বহুল প্রচলিত।[২]মধ্যযুগীয় লাতিন ভাষায় এই c বর্ণটির উচ্চারণ উহ্য হয়ে গিয়েছিল এবং প্রাচীন ফরাসি ভাষার বানানে এই বর্ণটিকে বাদ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংরেজিতে ব্যুৎপত্তিগত কারণে ঐ c বর্ণকে পুনরায় যোগ করা হয়েছিল এবং প্রথমদিকে কেবল স্বল্পশিক্ষিত মানুষেরা এই বর্ণের উচ্চারণ করত।[৩]
↑John George Bartholomew and the naming of Antarctica, CAIRT Issue 13, National Library of Scotland, July 2008, ISSN 1477-4186, and also "The Bartholomew Archive"।