হ্যারিসবার্গ (জার্মান:হ্যারিসবাররিগ) মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী ও ডাফনে কাউন্টির সদর দপ্তর। এর জনসংখ্যা ৪৯,২৭১। এটি সাসকুয়েহান্না নদীর পূর্ব তীরে, ফিলাডেলফিয়ার ১০৭ মাইল পশ্চিমে অবস্থিত। এটি হ্যারিসবার্গ মেট্রোপলিটন এলাকার প্রধান শহর, ২০১৯ সালে যার প্রাক্কলিত জনসংখ্যা ৫,৭৭,৯৪১। [১]
পশ্চিমাভিমুখী অভিবাসন, আমেরিকান গৃহযুদ্ধ,স্বাধীনতাযুদ্ধে হ্যারিসবার্গ বিশেষ ভূমিকা পালন করেছিল। পেনসিলভানিয়া খাল ও পেনসিলভানিয়া রেলসড়ক নির্মিত হবার পর হ্যারিসবার্গ উত্তর-পূর্ব যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম শিল্পায়িত শহরে পরিণত হয়। প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে (১৯১৮-১৯১৯) ব্যবহৃত নৌজাহাজ ইউএসএস হ্যারিসবার্গের নামকরণ হ্যারিসবার্গ শহরের নামানুসারেই করা হয়েছিল।
১৯১৭ সাল থেকে হ্যারিসবার্গে পেনসিলভানিয়া কৃষি প্রদর্শনী আয়োজিত হয়ে আসছে। [২] ১৯৭৯ সালে থ্রি মাইল দ্বীপের পারমাণবিক বিস্ফোরণের জন্যও হ্যারিসবার্গ শহর সুপরিচিত।
২০১০ সালে ফোর্বস হ্যারিসবার্গকে পরিবার নিয়ে বসবাসের জন্য আমেরিকার দ্বিতীয় শ্রেষ্ঠ স্থান হিসেবে স্বীকৃতি দেয়।[৩] একই বছর ডেইলি বিস্ট পত্রিকার মন্দা-নিরোধক ২০টি শহরের তালিকায় হ্যারিসবার্গ সপ্তম স্থান দখল করে। [৪]
ইতিহাস
আদিবাসী আমেরিকানরা ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে এখানে বসবাস করতেন। তারা একে পেইক্সটিন বা পাক্সটাং নামে সম্বোধন করতেন। ওহাইও নদী থেকে ডেলাওয়্যার পর্যন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি ও পটোম্যাক নদী থেকে সাসকুয়েহান্না পর্যন্ত বিস্তৃত বালিয়াড়ি হ্যারিসবার্গে মিলিত হয়। তাই দূর-দূরান্ত হতে আগত আদিবাসী ব্যবসায়ীরা এখানে বিশ্রাম নিতেন। ক্যাপ্টেন জন স্মিথ আদিবাসীদের সাথে প্রথম ইউরোপীয় হিসেবে ১৬০৮ সালে সাক্ষাৎ করেন। ১৭১৯ সালে জন হ্যারিস সিনিয়র নামে একজন ইংরেজ ব্যবসায়ী এখানে বসতি স্থাপন করেন। ১৪ বছর পর তিনি ৮০০ একর জমি অনুদান পান। ১৭৮৫ সালে তাঁর ছেলে জন হ্যারিস জুনিয়র এখানে একটি শহর নির্মাণের পরিকল্পনা করেন। তিনি এর নাম দেন হ্যারিসবার্গ। ঐ বছর বসন্তকালে জন হ্যারিস জুনিয়রের জামাতা উইলিয়াম ম্যাকলে হ্যারিসবার্গের ভূমি জরিপ করেন। ১৭৯১ সালে একে স্থানীয় শাসনের আওতাভুক্ত করা হয়। ১৮১২ সালের অক্টোবরে এটি পেনসিলভানিয়া অঙ্গরাজ্যের রাজধানী হয়। ১৮২৭ সালে এখানে হ্যারিসবার্গ সম্মেলন আয়োজিত হয়, যা জাতীয় রাজনীতিতে সুপারিশ ও তদবিরের সংস্কৃতির পথিকৃৎ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ১৮৩৯ সালে হ্যারিসবার্গে উয়িগ পার্টির সম্মেলন আয়োজিত হয়। সম্মেলনে উইলিয়াম হেনরি হ্যারিসন রাষ্ট্রপতি ও জন টাইলার উপরাষ্ট্রপতি পদে মনোনয়ন পান।
শিল্পায়নের পূর্বে হ্যারিসবার্গ ছবির মতোই সুন্দর ও কৃষিনির্ভর ছিল। ১৮২২ সালে ২,০০,০০০ ডলার ব্যয়ে ক্যাপিটল ভবনের নির্মাণকাজ শেষ হয়। [৫]
১৭১৯ সালে বিক্রয়কেন্দ্র হিসেবে হ্যারিসবার্গ শহর প্রতিষ্ঠিত হয়। পার্বত্য সেতুবন্ধনের (Ridge) প্রবেশমুখে এর অবস্থান। এখানে সাসকুয়েহান্না নদী পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে প্রবাহিত হতো। এর ফলে পূর্বদিকে নৌ-চলাচলে সুবিধা হয়। পশ্চিমাভিমুখী অভিবাসনেও হ্যারিসবার্গ তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এ সকল কারণে হ্যারিসবার্গকে ১৮১২ সালে রাজ্য বিধানসভা রাজধানী হিসেবে নির্বাচিত করে।
১৮৩৪ সালে পেনসিলভানিয়া খাল নির্মিত হলে শহরের দৈর্ঘ্য বৃদ্ধি পায়। ক্যাপিটল ভবন থেকে কিছু দূরেই আবাসিক এলাকা অবস্থিত ছিল। আবাসিক এলাকার অধিকাংশ ভবনই একতলা ছিল। সেসময় শহরে কারখানা না থাকলেও কামারের দোকানসহ কয়েকটি ক্ষুদ্র দোকান অবস্থিত ছিল।
আমেরিকান গৃহযুদ্ধের সময় হ্যারিসবার্গ ইউনিয়ন বাহিনীর কার্যক্রমের অন্যতম কেন্দ্র ছিল। এখানে কার্টিন শিবিরে দশ হাজার ইউনিয়ন সৈন্য প্রশিক্ষণ গ্রহণ করে। রবার্ট ই লি-র নেতৃত্বাধীন কনফেডারেট বাহিনীর উত্তর ভার্জিনিয়া শাখার সৈন্যরা দুইবার শহরটি আক্রমণ করে। পশ্চিম ভার্জিনিয়া প্রদেশের হার্পার্স ফেরি শহর দখল করে নেওয়ার পর লি হ্যারিসবার্গ শহর দখলের পরিকল্পনা করেন। কিন্তু অ্যান্টিটামের যুদ্ধ তার সে প্রচেষ্টা ব্যর্থ করে দেয়। ১৮৬৩ সালে লি পুনরায় হ্যারিসবার্গ শহর দখলে নেওয়ার পরিকল্পনা করেন। সেখানে ইউনিয়ন ও কনফেডারেট বাহিনীর মধ্যে সংঘটিত লড়াই "স্পোর্টিং হিলের যুদ্ধ" নামে পরিচিত।
ঊনবিংশ শতাব্দীতে ইস্পাত ও লোহাশিল্প হ্যারিসবার্গে প্রসার লাভ করে। নিকটস্থ স্টিলটন শহরে ১৮৬৬ সালে পেনসিলভানিয়া ইস্পাত কোম্পানি প্রতিষ্ঠিত হয়।[৬]
১৯২০-১৯৭০ এর দশকে হ্যারিসবার্গ শহরে শিল্পখাত সংকটের সম্মুখীন হয়। ১৯৫০ এর দশকের পর শহরের জনসংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পেতে থাকে। অপরাধ ও দারিদ্র্য শহরের অন্যতম সমস্যা হিসেবে আবির্ভূত হয়। তখন নিকটবর্তী শহরতলিতে হ্যারিসবার্গের বাসিন্দারা বসবাস করতে শুরু করেন। এর প্রমাণস্বরূপ বলা যায়, হ্যারিসবার্গের জনসংখ্যা কমতে থাকলেও হ্যারিসবার্গ মেট্রোপলিটন এলাকার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পায়।
যথাযথ পয়ঃনিষ্কাশনের অভাবে বিংশ শতাব্দীর প্রথমভাগে টাইফয়েডে অনেক মানুষ মৃত্যুবরণ করেন। এর ফলে "শহরের সৌন্দর্যবর্ধন আন্দোলনে" হ্যারিসবার্গের অনেক মানুষ যোগদান করেন। মিরা লয়েড ডক এর নেতৃত্ব প্রদান করেন। জে হোরেস ম্যাকফারল্যান্ড ও ভ্যান্স ম্যাককরমিকের ন্যায় বিশিষ্ট অধিবাসীরাও ইউরোপীয় নগরায়ণ কাঠামো অনুসরণ করে শহরের উন্নতি সাধনের জন্য পরিকল্পনা গ্রহণের উপর জোর দেন।
অ্যাগনেস নামক ক্রান্তীয় ঘূর্ণিঝড়ের ফলে ১৯৭২ সালে হ্যারিসবার্গ শহরে বন্যা হয়।
১৯৭৯ সালে হ্যারিসবার্গের দক্ষিণে লন্ডনডেরি টাউনশিপে পারমাণবিক দুর্ঘটনা ঘটে - যা থ্রি মাইল দ্বীপের পারমাণবিক দুর্ঘটনা নামে পরিচিত। এতে সামান্য ক্ষতি হলেও গভর্নর ডিক থর্নবার্গ গর্ভবতী নারী ও শিশুদের এলাকা ছেড়ে যাওয়ার নির্দেশ দেন। কিছুদিনের মধ্যেই ১,৪০,০০০ মানুষ হ্যারিসবার্গ শহর ছেড়ে চলে যান।[৭]
১৯৮১ সালে স্টিফেন আর রিড হ্যারিসবার্গের মেয়র নির্বাচিত হন ও ২০০৯ সাল পর্যন্ত দায়িত্ব পালন করেন। শহরের উন্নয়নে তিনি বেশ কিছু প্রকল্প গ্রহণ করেন। [৮]
ভূগোল
যুক্তরাষ্ট্রের আদমশুমারি ব্যুরোর তথ্যানুযায়ী, হ্যারিসবার্গ শহরের আয়তন ১১.৪ বর্গমাইল। এর ৮.১ বর্গমাইল স্থল ও ৩.৩ বর্গমাইল জল।
জলবায়ু
শহরটির জলবায়ু বৈচিত্র্যপূর্ণ। এখানে আর্দ্র উপক্রান্তীয় ও আর্দ্র মহাদেশীয় ধরনের জলবায়ুর মধ্যবর্তী একটি দশা বিরাজ করে। জুলাই শহরের উষ্ণতম মাস; এ সময় গড় তাপমাত্রা থাকে ৭৫.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট।[৯] জানুয়ারি মাসে ২৯.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট গড় তাপমাত্রা বিরাজ করে। জুলাই হলো সবচেয়ে আর্দ্র ও ফেব্রুয়ারি হলো সবচেয়ে শুষ্ক মাস।
জনমিতি
২০১০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী হ্যারিসবার্গের বাসিন্দাদের ৫২.৪% কৃষ্ণাঙ্গ বা আফ্রিকান আমেরিকান, ৩০.৭% শ্বেতাঙ্গ, ৩.৫% এশীয়, ০.৫% আদিবাসী আমেরিকান। শহরের ১৮% বাসিন্দা হিস্পানিক অথবা লাতিনো বংশোদ্ভূত।
শহরের পরিবারগুলোর গড় আয় ২৯,৫৫৬ ডলার। হ্যারিসবার্গের মাথাপিছু আয় ১৫,৭৮৭ ডলার। ২৩.৪% পরিবার ও ২৪.৬% বাসিন্দা দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। এদের ৩৪.৯% এর বয়স ১৮ এর নিচে ও ১৬.৬% এর বয়স ৬৫ এর সমান বা বেশি।
↑"Steelton Boro Website"। web.archive.org। ৬ মার্চ ২০১৩। Archived from the original on ৬ মার্চ ২০১৩। সংগ্রহের তারিখ ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২০।উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: বট: আসল-ইউআরএলের অবস্থা অজানা (link)