হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় (১৭ এপ্রিল, ১৮৩৮ - ২৪ মে, ১৯০৩) হিন্দু কলেজের ছাত্র এবং কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক। মধুসূদনের পরবর্তী কাব্য রচয়িতাদের মধ্যে ইনি সে সময় সবচেয়ে খ্যাতিমান ছিলেন। বাংলা মহাকাব্যের ধারায় হেমচন্দ্রের বিশেষ দান হচ্ছে স্বদেশ প্রেমের উত্তেজনা সঞ্চার।
জন্ম ও শৈশব
হেমচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়ের পৈতৃক নিবাস ছিল হুগলির উত্তরপাড়া গ্রামে। রাজবলহাটের নিকট গুলাটিয়া গ্রামে কুলীন ঘরে জন্ম হয় তার।[১] চার ভাই দুই বোনের মধ্যে সর্বজ্যৈষ্ঠ। পিতা কৈলাসচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন অতিশয় দরিদ্র। কৌলীন্যের বলে কৈলাসচন্দ্র গুলিটা, রাজবল্লভহাট গ্রাম নিবাসী কলকাতা আদালতের মোক্তার রাজচন্দ্র চক্রবর্তীর একমাত্র সন্তান আনন্দময়ীকে বিবাহ করে শ্বশুরবাড়িতে থাকতেন। কৈলাসচন্দ্র বিশেষ কোনও কাজকর্ম করতেন না বিধায় শ্বশুরের ওপর সম্পূর্ণ নির্ভরশীল ছিলেন। হেমচন্দ্র যখন কলকাতার খিদিরপুর বাঙ্গালা স্কুলে পড়তেন তখন রাজচন্দ্র চক্রবর্তী মৃত্যুমুখে পতিত হন। এর ফলে আর্থিক সংকটে পড়ে হেমচন্দ্রের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়। অতঃপর কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ প্রসন্নকুমার সর্বাধিকারী মহাশয় হেমচন্দ্রকে ১৮৫৩ সালে কলকাতার হিন্দু কলেজে সিনিয়র স্কুল বিভাগের দ্বিতীয় শ্রেণিতে ভর্তি করিয়ে দেন। জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় দ্বিতীয় স্থান অধিকার করে মাসিক দশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন ১৮৫৫ সালে। একই বছর কলকাতার ভবানীপুর নিবাসী কালীনাথ মুখোপাধ্যায়ের কন্যা কামিনী দেবীর সংগে পরিণয়সূত্রে আবদ্ধ হন। ১৮৫৭ সালে সিনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করে দুই বছরের জন্য মাসিক পচিশ টাকা বৃত্তি লাভ করেন। চতুর্থ বার্ষিক শ্রেণিতে পাঠকালে বৃত্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেলে লেখাপড়া ত্যাগ করেন।[২]
কর্মজীবন
১৮৫৯ সালে হেমচন্দ্র মিলিটারি অডিট অফিসে কেরানী পদে চাকরি গ্রহণ করেন । পরে ক্যালকাটা ট্রেনিং একাডেমীর প্রধান শিক্ষক নিযুক্ত হন। ১৮৬১ সালে এল. এল. ডিগ্রি লাভ করার পর কলকাতা হাইকোর্টে ওকালতি শুরু করেন এবং ১৮৬২ সালে মুন্সেফ পদ পান। কয়েক মাস পরে তিনি পুনরায় হাইকোর্টে ওকালতিতে ফিরে এসে ১৮৬৬ সালে বি.এল. পাস করেন। এপ্রিল ১৮৯০ সালে সরকারি উকিল নিযুক্ত হন।[৩]
কবিতা চর্চা
হেমচন্দ্রের প্রধান পরিচয় তিনি একজন দেশপ্রেমিক যশস্বী কবি। তার সর্বাধিক প্রসিদ্ধ রচনা বৃত্রসংহার কাব্য (১৮৭৫-৭৭ দুই খণ্ড) এই কাব্যগ্রন্থে তিনি পৌরাণিক কাহিনীর সাহায্যে অন্যায়ের বিরুদ্ধে আহ্বান জানিয়েছিলেন। জুলাই ১৮৭২-এ এডুকেশন গেজেট পত্রিকায় তার 'ভারত সঙ্গীত' কবিতাটি প্রকাশিত হলে তিনি সরকারের রোষানলে পড়েন এবং সম্পাদক ভূদেব মুখোপাধ্যায়কেও সরকারের কাছে জবাবদিহি করতে হয়। এই কবিতায় স্পষ্ট ও প্রত্যক্ষভাবে ভারতবাসীকে অধীনতার পাশ থেকে মুক্ত হবার আহ্বান জানানো হয়। প্রকৃতপক্ষে তিনিই প্রথম জাতীয় কবি যিনি সমগ্র স্বাধীন ভারতের এক সংহতিপূর্ণ চিত্র দেখেছিলেন।[৩] 'ভারতবিলাপ', 'কালচক্র','রিপন উৎসব','ভারতের নিদ্রাভঙ্গ', 'গঙ্গা', 'জন্মভূমি' ইত্যাদি আরোকিছু রচনার মাধ্যমে স্বদেশ প্রেমের বার্তা ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তিনি।[৪]
হেমচন্দ্রের প্রথম কাব্য চিন্তাতরঙ্গিনী (১৮৬১)। বৃত্রসংহার মহাকাব্য এবং কবির শ্রেষ্ঠ রচনা। এছাড়াও আছে-
↑ কখসুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, নভেম্বর ২০১৩, পৃষ্ঠা ৮৭৩-৮৭৪, আইএসবিএন৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬