হেমচন্দ্র চৌধুরী (১৮৩৩-১৯১৫) ছিলেন টাঙ্গাইল জেলার হেমনগরের একজন প্রভাবশালী রাজা, দানবীর, সমাজসেবক, দুরদৃষ্টিসম্পন্ন শাসক, দক্ষ নির্মাতা, সাহিত্যিক এবং বিদ্যানুরাগী। তিনি হেমনগর জমিদার বাড়ির প্রতিষ্ঠাতা যা পরবর্তীতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে অংশ নেওয়া মুক্তিবাহিনীর আশ্রয়স্থল হিসেবে ব্যবহার করা হয়।[১]
ব্যক্তি ও পারিবারিক জীবন
হেমচন্দ্র ১৮৩৩ সালে (১২৩৯ বঙ্গাব্দ) মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।[২] তার পিতার নাম কালীচন্দ্র রায় এবং পিতামহের নাম পদ্মলোচন রায়। তার তিন বোন ছিল। এরা হলেন স্বর্ণময়ী দেবী (স্বামী নীলকান্ত গাঙ্গুলী), ক্ষিরোদা সুন্দরী দেবী (স্বামী গোবিন্দ চন্দ্র গাঙ্গুলী) এবং বরোদা সুন্দরী দেবী (স্বামী রজনীকান্ত গাঙ্গুলী)। হেম চন্দ্রের চার পুত্র ও চার কন্যা ছিলো। পুত্রগণ হলেন হেরম্ভ চৌধুরী, গঙ্গেশ চৌধুরী, প্রফুল্ল চৌধুরী ও যোগেশ চৌধুরী। কন্যারা হেলেন সুরেন্দ্র বালা দেবী (স্বামী সতীশ মুখার্জী), কিরণ বালা দেবী (স্বামী বাদল মুখার্জী), সুনীতি বালা দেবী (স্বামী মুরলিধর গাঙ্গুলী) ও সুমতি বালা দেবী। হেমচন্দ্র চৌধুরীর পিতা কালীচন্দ্র রায়ের স্ত্রী ছিলেন দুইজন। হেম চন্দ্রের মাতা শশীমুখী দেবী ও সৎ মাতা ছিলেন হরদুর্গা দেবী। হেমচন্দ্র চৌধুরী ছিলেন কুলীণ ব্রাক্ষ্মণ এবং ধর্মীয় নিষ্ঠাবান।
হেমচন্দ্র চৌধুরীর মৃত্যুর পর তার উত্তরসুরিরা ১৯৪৬ সালে দেশ বিভাগের সময় সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার ভয়ে ভারতে পাড়ি জমান। অপরদিকে শ্যামকান্ত গাঙ্গুলী ও তার পুত্র কমল গাঙ্গুলী হেমনগরে থেকে যান। কিন্তু ১৯৬৫ সালে পাক-ভারত যুদ্ধের সময় তারাও দেশত্যাগ করেন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় হেমনগরের এই রাজবাড়িটি মুক্তিযোদ্ধারা আশ্রয় হিসেবে ব্যবহার করে।
এছাড়াও হেমচন্দ্র চৌধুরীর আরেকটি বাড়ি ছিল ময়মনসিংহের ত্রিশালের বৈলর ইউনিয়ন
অবস্থিত।
চৌধুরী উপাধি
হেমচন্দ্র চৌধুরীর পিতামহ পদ্মলোচন রায় ছিলেন ভূস্বামী। তিনি ১৮৪৮ সালে (১২৫৪ বঙ্গাব্দ) পুথুরিয়া পরগনার জমিদার ভৈরবচন্দ্রের নিকট থেকে দুই আনার তালুক (ভূসম্পত্তি) কিনেছিলেন। তার মৃত্যুর পর হেমচন্দ্রের পিতা কালীচন্দ্র রায় ১৮৫৫ সালে (১২৬১ বঙ্গাব্দ) পরগনার বাকী চারআনা তালুকও নিলামে ক্রয় করেন। কালীচন্দ্র রায়ের মৃত্যুর পর হেমচন্দ্র রায় মুক্তাগাছার মহারাজা সূর্যকান্ত রায়ের সাথে টেক্কা দিয়ে জয়েনশাহী পরগনার পাঁচ আনা আড়াই গন্ডা তালুক নিলামে ক্রয় করেন। যা ছিল প্রায় ৮৫ হাজার একর পরিমাণ। তিনি রায় থেকে হলেন চৌধুরী। হেমচন্দ্র চৌধুরীর জমিদারি আমবাড়িয়া থেকে উত্তর টাঙ্গাইল ও সিরাজগঞ্জ জেলার প্রায় চার লক্ষ একরে প্রসারিত হয়।
অবদান
হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৮০ সালে (১২৮৬ বঙ্গাব্দ) মধুপুর উপজেলার আমবাড়িয়া রাজবাড়ি ত্যাগ করে গোপালপুর উপজেলার ঝাওয়াইল ইউনিয়নের সুবর্ণখালি গ্রামে নতুন রাজবাড়ি নির্মাণ করেন। তিনি সেখান থেকেই জমিদারি পরিচালনা শুরু করেন। সুবর্ণখালি ছিল যমুনা তীরের প্রসিদ্ধ নদীবন্দর। তখন কলকাতার সাথে সহজ যোগাযোগের কারণে সুবর্ণখালিতে আসাম ও কলকাতার স্টীমার আসতো। হেমচন্দ্র চৌধুরীসহ কয়েকজন হিন্দু জমিদারের উদ্যোগ ও প্রচেষ্টায় ১৯০৫ সালে ময়মনসিংহ হতে জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত রেলওয়ে লাইন সম্প্রসারণ করা হয়। যা রেল ও স্টীমার যোগে ঢাকার সাথে কলকাতার যোগাযোগকে সহজ করে তোলে।
তিনি সুবর্ণখালি হতে সরিষাবাড়ি উপজেলার জগন্নাথগঞ্জ ঘাট পর্যন্ত পাঁচ কিলোমিটার সড়কে হেরিংবন্ড করে টমটম বা পালকিতে যাতায়াতের ব্যবস্থা করেন। জানা যায়, এটিই গোপালপুর উপজেলার প্রথম পাঁকা সড়ক। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দশকে সুবর্ণখালি নদীবন্দর ও হেমচন্দ্রের রাজবাড়ি যমুনায় তলিয়ে যায়। বর্তমানে এটি সোনামুই/সোনামুখী নামে পরিচিত।
হেমচন্দ্র চৌধুরী দানবীর ও শিক্ষানুরাগী ছিলেন। তিনি ১৯০০ সালে তার মাতার (সৎ মাতা) নামে কুঁড়ি একর জমির উপর হেমনগর শশীমুখী উচ্চ ইংরেজি বিদ্যালয়[৩] স্থাপন করেন। হেমবাবু গোপালপুরের সুতী ভিএম পাইলট হাই স্কুল[৪] ও পিংনা হাই স্কুল প্রতিষ্ঠায় জমি ও অর্থ দান করেন। এছাড়াও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা মেডিকেল স্কুল, ময়মনসিংহ ভিক্টোরিয়া হাসপাতাল নির্মাণে, ময়মনসিংহ পুরাতন হাসপাতালের সৌধ নির্মাণে, পিংনা দাতব্য চিকিৎসালয়, গোপালপুর বালিকা বিদ্যালয় এবং বরিশাল মুক ও বধির বিদ্যালয়ে উল্লেখযোগ্য পরিমাণ অর্থ দান করেছিলেন। আনন্দমোহন কলেজ প্রতিষ্ঠায় শিলালিপিতে দশজন দাতার মধ্যে চতুর্থ স্থানে রয়েছে তার নাম।
প্রজাসাধারণের পানীয় জলের সুবিধার্থে রাস্তার মোড়ে মোড়ে কূপ ও বহুসংখ্যক পুকুর খনন করেন। চট্টগ্রামের সীতাকুন্ডের চন্দ্রনাথ মন্দির ও চন্দ্রনাথ পাহাড়ে তীর্থযাত্রীদের জন্য লোহার সেতু নির্মাণে এবং টাঙ্গাইল ফৌজদারী উকিলবার প্রতিষ্ঠায় সার্বিক সহায়তা করেন। প্রজাদের সুখে-দুঃখে পাশে থাকার নানা কাহিনী লোকমুখে প্রচলিত আছে। হেমনগরে তিনি স্থাপন করেছিলেন হরদুর্গা দাতব্য চিকিৎসালয়। ম্যালেরিয়ার স্বর্গরাজ্য বলে কথিত এ অঞ্চলে তিনি বিংশ শতব্দীর প্রথমার্ধে ডাকঘর মারফত মাসিক ১৫ পাউন্ড কুনলিন ঔষধ বিতরণ করেছিলেন। হেমনগর - গোপালপুর - আমবাড়িয়া সড়কও নির্মাণ করেন তিনি। রাজবাড়ির উত্তর-পূর্ব দিকে সড়কের ত্রিমোহনায় লোহার ব্রিজ স্থাপন করেছিলেন।[৫]
সংস্কৃতিতে অবদান
হেমচন্দ্র চৌধুরী ও তার বংশধররা সবাই ছিলেন উদার সংস্কৃতিমনা। তাদের নাটঘরে সে যুগের নামিদামি শিল্পীরা অভিনয় করতো। যাত্রাপালা হতো দুর্গাপুজার সময়। রাজবাড়ির সামনে বসতো কীর্তণের আসর। তবে মুসলমান ও নিচু জাতের হিন্দুদের সেখানে প্রবেশাধিকার ছিল না। হেমচন্দ্র চৌধুরীর তৃতীয় পুত্র প্রফুল্ল চন্দ্র চৌধুরী ছিলেন বিখ্যাত ফুটবলার। পূর্ববঙ্গ ছাড়াও কলকাতায় দাপুটে ফুটবলার হিসেবে সুনাম ছিল। হেমচন্দ্র চৌধুরী পারিবারিকভাবে “হিতৈষী” নামে সাহিত্য পত্রিকা প্রকাশ করতেন। কবি ও গীতিকার হিসেবে হেমবাবুর তৎকালে বেশ সুনাম ছিল।
বর্তমান রাজবাড়ি
হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৮৯০ সালে (১২৯৬ বঙ্গাব্দ) শিমলাপাড়া মৌজায় নতুন একটি দ্বিতল রাজপ্রাসাদ নির্মাণ করেন। এটি সুবর্ণখালি থেকে তিন কিলোমিটার পূর্ব-দক্ষিণে অবস্থিত। অত্যন্ত কারুকর্য মণ্ডিত, দামি কড়ি ও অপূর্ব পাথরে মোড়ানো অগ্রভাগে দুইটি পরীর ভাস্কর্যসমৃদ্ধ বাড়িটি লতাপাতার অপরুপ নকশায় তৈরি। দিল্লী ও কলকাতার কারিগর ও রাজমিস্ত্রি দিয়ে ইটসুরকির তৈরি বাড়িটি দেখে মনে হয় যেন শিল্পকর্ম। ৬০ একর জায়গার উপর শত কক্ষবিশিষ্ট এ বাড়িটিকে ডাকা হয় “পরীর দালান” নামে। উঁচু ও প্রসস্থ দেওয়ালে ঘেরা বাড়ির ভেতরে সুপেয় পানির জন্য একাধিক কূপ খনন করা হয়েছিল। সেখানে ছিল চিড়িয়াখানা, পূজামণ্ডপ, হাতিশালা ও ফুলের বাগান। পরীর দালানের সামনেই ছিল দ্বিতল নাটঘর। বাড়িটির ভেতরে ও সামনে রয়েছে পাকা সান (ইট ও সুরকির) বাঁধানো ঘাটসহ সুবিশাল পুকুর (দিঘি)। পরীর দালানের আশেপাশে স্বজনদের জন্য সান বাঁধা ঘাটসহ দিঘি ও পাকা বাড়িঘর নির্মাণ করা হয়েছিল। রাজবাড়ির অদুরে দক্ষিণদিকে গড়ে ওঠে বিশাল বাজার। এলাকাটি হেমচন্দ্র চৌধুরীর নামানুসারে হেমনগর নামকরণ করা হয়েছিল। বর্তমানে (১৯৭৯ সালে) বাড়িটিতে একটি মহাবিদ্যালয় হেমনগর কলেজ ([৬]) স্থাপন করা হয়েছে।[৭]
আতিথ্যতা
রাজবাড়িতে কলকাতা থেকে জমিদারের আত্মীয়-স্বজন ও ব্রিটিশ কর্মকর্তারা আতিথ্য গ্রহণ করতেন। পানসি নৌকায় অতিথিরা গরিল্লা বিলের অপরুপ জলরাশিতে নৌবিহার উপভোগ করতেন। বিলের মাঝখানে দ্বীপের মতো সদা ভাসমান বিস্ময়কর সৌন্দর্য ছিল যোগির ঘোপা, যা এখনও টিকে আছে।
বিবিধ
মাঘ মাস এলে খাজনা আদায় উপলক্ষে রাজগোলাবাড়ি এলাকায় জমিদারেরা ঘটা করে প্রজাদর্শন দিতো। হেমচন্দ্র চৌধুরীর কন্যা সুমতি বালা দেবীর স্বামী মুরলীধর গাঙ্গুলী হেমনগর ইউনিয়ন পরিষদের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। জানা যায়, ভোটাভুটির জয়পরাজয় নিয়ে তৎকালীন কৃষকনেতা হাতেম আলী খানের সাথে জমিদার পরিবারের বিরোধ সৃষ্টি হয়েছিল। অনেকের স্মৃতিচারণে হেমচন্দ্র চৌধুরীর প্রজা নিপীড়নের চিত্র পাওয়া যায়, বিশেষ করে মুসলমানদের উপর। এছাড়া রাজবাড়ির পূর্ব পাশের সড়ক দিয়ে জমিদারের লাঠিয়ালরা ছাতা মাথায় বা জুতো পায়ে হেঁটে যেতে দিতো না। লাঠিয়ালরা শাস্তি দিতেন ও অতিরিক্ত প্রভুভক্তি দেখাতে বাড়াবাড়ি করতেন। যা প্রজা মনে অসন্তোষ ও প্রতিহিংসার সৃষ্টি করেছিল।[৮]
মৃত্যু
হেমচন্দ্র চৌধুরী ১৯২৫ সালে (১৩৩১ বঙ্গাব্দ) কাশীতে (বারাণসী/বেনারস) মারা যান। মৃত্যুকালীন সময়ে তার বয়স হয়েছিল ৯২ বছর।
চিত্রশালা
তথ্যসূত্র
↑"প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব"। বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন। ২২ অক্টোবর ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৭ ফেব্রুয়ারি ২০১৯।