হেনরি কিসিঞ্জারKCMG (ইংরেজি: Henry Kissinger; /ˈkɪsɪndʒər/; জার্মান: Heinz Alfred Kissinger; জন্মঃ ২৭ মে, ১৯২৩ - মৃত্যুঃ ২৯ নভেম্বর, ২০২৩) ছিলেন জার্মান-বংশোদ্ভূত আমেরিকান যুদ্ধাপরাধী, শিক্ষাবিদ, রাজনৈতিক বিজ্ঞানী, কূটনীতিবিদ এবং ব্যবসায়ী।[২] তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরামর্শক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এরপর প্রেসিডেন্টরিচার্ড নিক্সন এবং প্রেসিডেন্ট জেরাল্ড ফোর্ড সরকারদ্বয়ের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছিলেন। মেয়াদ শেষ হলেও অনেক প্রাক্তন রাষ্ট্রপতি এবং বিশ্ব নেতৃবৃন্দের কাছে তার মতবাদ সম্পর্কে বক্তব্য প্রদান করতে দেখা গিয়েছিল।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
কিসিঞ্জার (হেইঞ্জ আলফ্রেড কিসিঞ্জার) ১৯২৩ সালের ২৭ মে জার্মানির বাভারিয়ার ফার্থে (Fürth, Bavaria, Germany) জন্মগ্রহণ করেছিলেন । তিনি গৃহকর্মী পাওলা (১৯০১-১৯৯৮), এবং স্কুল শিক্ষক লুই কিসিঞ্জার (১৮৮৭-১৯৮২) এর একমাত্র সন্তান। তার একমাত্র ছোট ভাই, ওয়াল্টার (১৯২৪-২০২১) একজন ব্যবসায়ী ছিলেন। কিসিঞ্জারের পরিবার ছিল জার্মান-ইহুদি। তার প্রপিতামহ, মেয়ের লোব (Meyer Löb) ১৮১৭ সালে "কিসিঞ্জার"কে তার উপাধি হিসাবে গ্রহণ করেছিলেন, এটি ব্যাভারিয়ান স্পা শহরের 'ব্যাড কিসিঞ্জেন' থেকে নিয়েছিলেন। শৈশবে কিসিঞ্জার ফুটবল খেলতেন । তিনি SpVgg Fürth এর যুব দলের হয়ে খেলেন, যেটি সেই সময়ে দেশের অন্যতম সেরা ক্লাব ছিল।
২০২২ সালের একটি সাক্ষাৎকারে কিসিঞ্জার বলেন, তার খুবই স্পষ্টভাবে মনে আছে যখন ১৯৩৩ সালে এডলফ হিটলার জার্মানির চ্যান্সেলর হিসাবে নির্বাচিত হয়। এই সময়টি কিসিঞ্জার পরিবারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ টার্নিং পয়েন্ট হিসাবে প্রমাণিত হয়। নাৎসি শাসনের সময় কিসিঞ্জার এবং তার বন্ধুরা নিয়মিতভাবে হিটলার ইয়ুথ গ্যাং দ্বারা হয়রানি হতেন কিসিঞ্জার। কখনও কখনও নাৎসি জাতিগত আইনের দ্বারা আরোপিত বিচ্ছিন্নতাকে অমান্য করে ম্যাচ দেখার জন্য ফুটবল স্টেডিয়ামে লুকিয়ে পড়তেন, প্রায়শই নিরাপত্তারক্ষীদের মারধরের শিকার হতেন। নাৎসিদের ইহুদি-বিরোধী আইনের ফলস্বরূপ, কিসিঞ্জার জিমনেসিয়ামে ভর্তি হতে অক্ষম হন এবং তার বাবাকে তার শিক্ষকতার চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়।
১৯৩৮ সালের ২০ আগস্ট কিসিঞ্জার যখন ১৫ বছর বয়সী ছিলেন, তখন তার পরিবার নাৎসি জার্মানি থেকে পালিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেয় এবং সেই বছরের পঞ্চম সেপ্টেম্বরে সপরিবারে নিউইয়র্ক সিটিতে নিরাপদে পৌঁছান। কিসিঞ্জার তার উচ্চ বিদ্যালয়ের বছরগুলি উচ্চ ম্যানহাটনের 'ওয়াশিংটন হাইটস' বিভাগে কাটিয়েছেন জার্মান-ইহুদি অভিবাসী সম্প্রদায়ের অংশ হিসাবে। যদিও কিসিঞ্জার আমেরিকান সংস্কৃতিতে দ্রুত আত্তীকরণ করেছিলেন, তবে তিনি কখনোই তার উচ্চারিত জার্মান উচ্চারণ হারাননি, শৈশবের লজ্জার কারণে যা তাকে কথা বলতে দ্বিধাগ্রস্ত করেছিল। জর্জ ওয়াশিংটন হাই স্কুলে তিনি রাতে স্কুলে পড়াশুনা করতেন এবং দিনের বেলা শেভিং ব্রাশ কারখানায় কাজ করেন।
হাই স্কুলের পর, কিসিঞ্জার নিউইয়র্কের সিটি কলেজে অ্যাকাউন্টিং অধ্যয়নে ভর্তি হন। তিনি পার্ট-টাইম ছাত্র হিসাবে একাডেমিকভাবে দক্ষতা অর্জন করেছিলেন। ১৯৪৩ সালের শুরুর দিকে তিনি পড়াশোনা সাময়িকভাবে বন্ধ করে মার্কিন সেনাবাহিনীতে যোগ দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকেন।
রাজনৈতিক জীবন
রিপাবলিকান দলে যোগদান
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী
বৈদেশিক নীতি
হোয়াইট হাউসে অবস্থানকালীন রিচার্ড নিক্সন, হেনরি কিসিঞ্জারের মাধ্যমে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রিয়েলপলিটিকের মতবাদ প্রতিষ্ঠা করেন।[৩] ক্ষমতায় থাকাকালে ১৯৬৯ থেকে ১৯৭৭ সালের মধ্যে কিসিঞ্জার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বৈদেশিক নীতিতে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। এ সময় তিনি ডিটেন্টে নীতির মাধ্যমে সোভিয়েত ইউনিয়ন, গণপ্রজাতন্ত্রী চীনের সাথে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আমেরিকার সম্পর্ক বজায় রাখেন। প্যারিস শান্তি সম্মেলনেরও প্রধান আলোচক ছিলেন তিনি। ভিয়েতনাম যুদ্ধে আমেরিকার সম্পৃক্ততারও ইতি ঘটান হেনরি কিসিঞ্জার। অনেক ধরনের আমেরিকান নীতি এ সময়ে সৃষ্ট হয়। তন্মধ্যে কম্বোডিয়ায় বোমাবর্ষণের ঘটনায় তার সম্পৃক্ততা এখনো বিতর্কের পরিবেশ সৃষ্টি করে। কিসিঞ্জার এখনো বিতর্কিত ব্যক্তিত্ব হিসেবে বহাল তবিয়তে অবস্থান করছেন।[৪]
১৯৭৩ সালে আরব-ইসরায়েল যুদ্ধের প্রেক্ষাপটে কিসিঞ্জার মধ্যস্থতাকারীর ভূমিকা হিসেবে ইসরায়েলকে সিনাই উপত্যকা থেকে সেনা প্রত্যাহারে বাধ্য করান। এরফলে তার রাজনৈতিক দূরদর্শীতার পরিচয় পাওয়া যায় যা তৈল সঙ্কট উপশমে সহায়তা করেছিল।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, ১৯৭১
হেনরি কিসিঞ্জারের দিক নির্দেশনায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রীয় সরকার ১৯৭১ সালে সংঘটিত বাংলাদেশের মহান মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানকে সমর্থন করে। কিসিঞ্জার পূর্বেই দক্ষিণ এশিয়ায় সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রভাব বিস্তার এবং ভারত-সোভিয়েত ইউনিয়নের মধ্যেকার মৈত্রী সম্পর্ক সম্পর্কে সচেতন ছিলেন। কিন্তু পাকিস্তানের সাথে চীনের মৈত্রী সম্পর্ক এবং চীনের সাথে ভারত ও সোভিয়েত রাশিয়ার বৈরী, শত্রুভাবাপন্ন মনোভাবের কারণে চীনের সাথে মার্কিনীদের সম্পর্ক উন্নয়নের সুযোগ গ্রহণ করেন।[৫]
সাম্প্রতিক বছরে কিসিঞ্জার নিক্সনের সঙ্গে ব্যক্তিগত আলাপচারিতার কথকতা ফাঁসের প্রেক্ষাপটে পুনরায় সংবাদ মাধ্যমে আলোচিত হন। সেখানে তিনি বাংলাদেশ-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে তদানীন্তন ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীশ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী সম্বন্ধে বিরূপ মন্তব্য করেছিলেন। এছাড়াও তিনি যুদ্ধের অব্যবহিত পরেই ভারতীয়দের সম্পর্কেও শিষ্টাচার বহির্ভূত শব্দ প্রয়োগ করেন।[৬] অবশ্য, পরবর্তীকালে কিসিঞ্জার তার এ ধরনের বিরূপ মন্তব্য ও শিষ্টাচার বহির্ভূত শব্দ ব্যবহারের জন্য ক্ষমা প্রার্থনা করেন।[৭]
ক্ষমা প্রার্থনা পর ২০০৭ সালের অক্টোবরের প্রথমদিকে ভারতের প্রধান বিরোধী দলনেতা লাল কৃষ্ণ আদভানী'র সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তিনি ভারত-মার্কিন পারমাণবিক চুক্তি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে আদভানী'র ভারতীয় জনতা পার্টির প্রতি তার সমর্থন ব্যক্ত করেন।
এপ্রিল, ২০০৮ সালে কিসিঞ্জার বলেন যে, ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দৃষ্টিভঙ্গীর সাথে সমান্তরালভাবে চলছে। এরফলে ভারত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম মিত্রদেশ হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।[৮]
হেনরী কিসিঞ্জার সংবাদ ও প্রচার মাধ্যমকে এড়িয়ে চলতেন। সাম্প্রতিক সময়ে তিনি ১৯৭৯ সালের মিশর-ইসরায়েলের মধ্যকার শান্তি চুক্তির বিষয়ে একটি দুষ্প্রাপ্য সাক্ষাৎকার প্রদান করেন। তথ্যচিত্রের নামকরণ করা হয়েছিলঃ ব্যাক ডোর চ্যানেলসঃ দ্য প্রাইস অব পীস।[১৩]ইউম কিপ্পুর যুদ্ধেমিশর এবং সিরিয়া কর্তৃক ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ১৯৭৩ সালে সংঘটিত যুদ্ধের বিষয়টি চলচ্চিত্রে তুলে ধরা হয়েছিল। সেখানে তিনি পারমাণবিক যুদ্ধের ঘনঘটা ভীষণভাবে উপলব্ধি করেছিলেন।
১৯৯০ সালে তিনি দি ইকোনোমিস্ট পত্রিকায় দর্শনীর বিনিময়ে সাক্ষাৎকার প্রদান করেন।
ব্রিটিশ ইতিহাসবেত্তা নাইয়ল ফার্গুসন কর্তৃক কিসিঞ্জার শিরোনামে একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মিত হয়। কাইমেরিকা মিডিয়া'র পরিবেশনায় এটি ২০১১ সালে মুক্তি পায়।
ব্যক্তিগত জীবন
হেনরি কিসিঞ্জার প্রথম বিয়ে করেন অ্যান ফ্লেশার নামীয় এক মহিলাকে। এ সংসারে দুই সন্তান - এলিজাবেথ এবং ডেভিড রয়েছে। ১৯৬৪ সালে তাদের মধ্যেকার বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে। দশ বছর পর ন্যান্সী ম্যাগিনেস-কে বিবাহ করেন।[১৪] তারা এখন কানেক্টিকাটের কেন্টে এবং নিউইয়র্ক সিটিতে বসবাস করছেন।
১৯৭৩ সালে হেনরি কিসিঞ্জার ও লে ডাক থো যৌথভাবে নোবেল শান্তি পুরস্কারে ভূষিত হন। জানুয়ারি, ১৯৭৩ সালে উত্তর ভিয়েতনাম ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যেকার যুদ্ধ বিরতি এবং সেখান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের প্রেক্ষাপটে তাকে এ পুরস্কার প্রদান করা হয়। কিন্তু লে ডাক থো পুরস্কার গ্রহণে অস্বীকৃতি জানান কেননা তখনো যুদ্ধ চলছিল।[১৭] কিন্তু তাদেরকে নোবেল শান্তি পুরস্কার প্রদানের ফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটি ব্যাপক সমালোচনার মুখোমুখি হয়। এরফলে নরওয়েজিয়ান নোবেল কমিটির দুইজন সদস্য পদত্যাগ করেন। কিন্তু যখন এ পুরস্কারের বিষয়টি ঘোষিত হয়, তখনও উভয় পক্ষের মধ্যে আলাপ-আলোচনা অব্যাহত ছিল।[১৮] অনেক সমালোচকদের অভিমত, কিসিঞ্জার শান্তি প্রণেতা ছিলেন না; বরঞ্চ যুদ্ধের ব্যাপক প্রসারে সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রেখেছিলেন।[১৯]
অন্যান্য সম্মাননা
১৯৮০ সালে স্মৃতিকথামূলক গ্রন্থঃ দ্য হোয়াইট হাউজ ইয়ার্স-এর ১ম খণ্ডের জন্য তিনি ইতিহাস বিভাগে ন্যাশনাল বুক এ্যাওয়ার্ড লাভ করেন।[২০]
১৯৯৮ সালে নিজ শহর জার্মানির ফার্থে বিশেষ নাগরিকের মর্যাদা লাভ করেন। আজীবন সমর্থক হিসেবে এসপিভিজিজি গ্রিউথার ফার্থ ফুটবল ক্লাবের সম্মানিত সদস্য মনোনীত হন এবং আজীবন মৌসুম টিকিটধারীরও মর্যাদা পান।[২২] ১০ ফেব্রুয়ারি, ২০০১ থেকে ২০০৫-এর গ্রীষ্ম পর্যন্ত কলেজ অব উইলিয়াম এন্ড ম্যারি'র আচার্য্য হিসেবে আসীন ছিলেন।
কিসিঞ্জার ১০০ বছর বয়সে ২৯ নভেম্বর, ২০২৩ তারিখে কানেকটিকাটের কেন্টে তার বাড়িতে মারা যান।[২৩] তিনি তার স্ত্রী ন্যান্সি ম্যাগিনেস কিসিঞ্জারকে রেখে গেছেন; দুই সন্তান, ডেভিড এবং এলিজাবেথ; এবং পাঁচ নাতি। তার মৃত্যু কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস, তার পরামর্শক সংস্থা দ্বারা ঘোষণা করা হয়েছিল। কিসিঞ্জার অ্যাসোসিয়েটস ঘোষণা করেন যে অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া ব্যক্তিগত হবে, এবং নিউ ইয়র্ক সিটিতে একটি স্মারক পরিষেবা দ্বারা অনুসরণ করা হবে।[২৪]
↑A press release issued by the 45th Munich Conference on Security Policy on February 8, 2009 declared "[H]is voice continues to bear weight and authority throughout the globe." see [১]ওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ২৯ জুন ২০০৯ তারিখে Munich Security Conference - February 6, 2009 Press Release
The Kissinger Saga. Henry and Walter: Two Brothers from Fuerth/Germany. Documentary, 90 min. (unabridged version), first time aired: Bayerischer Rundfunk (Bavarian Broadcasting Network), January 21, 2007. Summaryওয়েব্যাক মেশিনেআর্কাইভকৃত ১৮ জানুয়ারি ২০০৮ তারিখে