সুচেতা মজুমদার বা বিবাহের পর নাম সুচেতা কৃপালনী (২৫ জুন ১৯০৮ - ১ ডিসেম্বর ১৯৭৪)[২][৩] ছিলেন একজন ভারতীয় স্বাধীনতা সংগ্রামী ও রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনিই ভারতের প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী। ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ হতে ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি ভারতের উত্তর প্রদেশ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন। তাঁর রিরল সাহস ও চারিত্রিক দৃঢ়তা ভারতীয় নারীত্বকে যথোপযুক্ত মর্যাদা প্রদান করেছ।
জন্ম ও প্রারম্ভিক জীবন
তিনি বৃটিশ ভারতের পাঞ্জাবের অধুনা হরিয়ানারআম্বালায় এক ব্রাহ্ম-পরিবারে জন্ম গ্রহণ করেন। তার পিতা পাঞ্জাব-প্রবাসী ডাক্তার সুরেন্দ্রনাথ মজুমদার। পাঞ্জাবের লাহোর শহরে শিক্ষারম্ভ হলেও পিতার বদলির চাকরির জন্য তাঁকে বিভিন্ন স্থানের বিভিন্ন স্কুলে যেতে হয়েছিল। তবে তিনি দিল্লির সেন্ট স্টিফেন কলেজ পড়াশোনা করে ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে প্রথম শ্রেণীতে প্রথম হয়ে এম.এ পাশ করেন।
তার ছাত্রাবস্থায় দেশের স্বাধীনতা অর্জনের জন্য সেসময় জাতীয়তাবাদী ভাবনায় দেশবাসী উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন।
তিনিও কেবল দৃঢচেতা মানসিক শক্তি নিয়ে জন্মান নি, তার মধ্যে অনুকরণীয় নেতৃত্বের গুণাবলীর প্রকট ছিল। তিনি তার লেখা "অ্যান আনফিনিশড অটোবায়োগ্রাফি" (একটি অসমাপ্ত আত্মজীবনী) বইতে লিখেছেন যে, যদিও তিনি সেসময় এক লাজুক বালিকা ছিলেন, কিন্তু, তিনি চালচলনে ও বুদ্ধিমত্তায় যথেষ্ট সজাগ ও সচেতন ছিলেন। বয়োবৃদ্ধির সাথে এবং পরিস্থিতির মুখোমুখিতে তার ব্যক্তিত্ব গঠিত হয়েছিল। দশ বৎসর বয়সে তিনি ও তার ভগিনী তাদের পিতার ও বন্ধুবান্ধবদের কাছে জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে জেনেছেন। এতে তাদের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়, তা তাদের কিছু অ্যাংলো-ভারতীয় খেলার সাথীদেরও গালিগালাজে প্রকাশ পেত। তার নিজের কথায় যা ব্যক্ত হয় এভাবে -
“আমি ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে প্রচণ্ড রাগ অনুভব করার জন্য যথেষ্ট বুঝের ছিলাম [জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের কথা শোনার পর]। আমরা [সুচেতা এবং তার বোন সুলেখা] আমাদের সাথে খেলত এমন কিছু অ্যাংলো-ভারতীয় বাচ্চাদের বিভিন্ন নামে ডেকে আমাদের ক্ষোভ প্রকাশ করেছিলাম,”
তিনি ও তার ভগিনী সুলেখা দুজনেই ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনে যোগ দিতে মরিয়া হয়ে উঠলেন। তার লেখায় এক আকর্ষণীয় ঘটনার উল্লেখ আছে। জালিয়ানওয়ালাবাগ হত্যাকাণ্ডের পর দিল্লিতে প্রিন্স অব ওয়েলস আসছেন, স্কুলের ছাত্রীদের তাঁকে সম্মান জানাতে 'কুডসিয়া গার্ডেনে' র কাছে নিয়ে যাওয়া হয়, কিন্তু তারা দুজনে কাপুরুষোচিত এই কাজে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করে সে স্থান পরিত্যাগ করেন।
তিনি লিখেছেন-
"আমাদের বিবেকের কাছে এটি লজ্জা ছাড়া কিছু ছিল না। আমরা দুজনেই আমাদের ভীরুতা অনুভব করেছি।"[৪]
পরে লাহোরের কিন্নার্ড কলেজে ছাত্রাবস্থায় তার বাইবেল ক্লাশের শিক্ষক হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু বিতর্কিত বিষয় উল্লেখ করেন। ক্রোধান্বিত সুচেতা ও তার ভগিনী বাড়িতে ফিরে এসে পিতাকে জিজ্ঞাসা করলে, তিনি তাদের ক্রোধ ও সংশয় নিরসনে ধর্মীয় বিষয়ে কিছু শিক্ষা দেন। পরের দিনের ক্লাশে তারা দুই বোন ভাগবত গীতার উদ্ধৃতি দিয়ে শিক্ষকের ভ্রান্তি খন্ডন করেন। তারপর সেই শিক্ষক আর কোনদিন হিন্দুধর্ম নিয়ে কিছু উত্থাপন করেন নি।[৫]
তিনি ইন্দ্রপ্রস্থ কলেজ [৬] এবং পাঞ্জাব বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনার পর বেনারস হিন্দু বিশ্ববিদযালয়ে সাংবিধানিক ইতিহাস বিষযে অধ্যাপনা করেন ১৯৩১ - ৩৯ খ্রিস্টাব্দ সময়ে।[৭] ১৯৩৬ সালে তিনি ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের বিশিষ্ট ব্যক্তিত্ব তৎকালীন সাধারণ সম্পাদক, বয়সে তার চাইতে কুড়ি বৎসরের বড় আচার্য জে বি কৃপালনীকে বিবাহ করেন। এই বিবাহে দুটি পরিবারসহ মহাত্মা গান্ধীর সম্মতি না থাকলেও পরে তিনি মেনে নিয়েছিলেন[৮] এবং তখন থেকেই সুচেতা রাজনীতিতে সক্রিয় অংশ নিতে থাকেন।
"বিরল সাহস এবং চরিত্রের একজন ব্যক্তি যিনি ভারতীয় নারীত্বে কৃতিত্ব নিয়ে এসেছিলেন"
তিনিই একমাত্র মহিলা যিনি ভারতের বিধান পরিষদে নির্বাচিত হন। তিনি উত্তর প্রদেশ রাজ্যের কানপুর বিধানসভা কেন্দ্র হতে নির্বাচিত হয়ে প্রথম মহিলা মুখ্যমন্ত্রী হন। দেশের সংবিধান রচনার উপসমিতির অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি। ১৯৪৭ সালের ১৪ই আগস্ট রাত ১২টার সময় গণ পরিষদে প্রথম স্বাধীনতার দিনে সদ্য নযুক্ত প্রধানমন্ত্রী জওহরলাল নেহেরুর বিখ্যাত ইংরাজীতে ‘Tryst with destiny’ অর্থাৎ ‘নিয়তির সাথে সাক্ষাৎকার’ শীর্ষক ভাষণের পরে বন্দে মাতরম সঙ্গীত পরিবেশন করেন তিনি।[৯][১০] ১৯৪১ খ্রিস্টাব্দে তিনি অখিল ভারতীয় মহিলা কংগ্রেসের সম্পাদক হিসাবে কার্যভার গ্রহণ করেন। কংগ্রেসের গঠনমূলক কাজে বিশেষ নৈপুণ্যের জন্য এবং সবরকম কঠিন ও কঠোর কাজের জন্য তিনি প্রশংসিত হন। এ সময় থেকে পারিবারিক জীবনতুচ্ছ করে তিনি ঘন ঘন কারাজীবন যাপনে অভ্যস্ত হয়ে ওঠেন। ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে তিনি "কস্তুরবা মেমোরিয়াল ট্রাস্ট"-এর সংগঠন-সম্পাদক হন।[১১]
স্বাধীনতা লাভের পর
স্বাধীনতার পর তিনি প্রত্যক্ষ রাজনীতির সাথে যুক্ত হন। ১৯৫২ খ্রিস্টাব্দে তিনি নতুন দিল্লি লোকসভা কেন্দ্র হতে কংগ্রেস প্রার্থী মনমোহন সেহগলকে পরাস্ত করে কিষাণ মজদুর প্রজা পার্টি'র প্রার্থী হিসাবে নির্বাচিত হন। এক বৎসর আগে তার স্বামীর প্রতিষ্ঠিত অল্প সময়ের এই দলে যোগদান করেন। পাঁচ বৎসর পর ওই কেন্দ্র থেকেই পুনঃনির্বাচিত হন কংগ্রেস প্রার্থী হিসাবে।[১২] ১৯৬৭ খ্রিস্টাব্দে শেষবারের মতো উত্তর প্রদেশের গোণ্ডা লোকসভা কেন্দ্র থেকে নির্বাচিত হন।[৭]
ইতিমধ্যে তিনি উত্তর প্রদেশের বিধানসভার সদস্য হন। ১৯৬০ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিনি উত্তর প্রদেশ সরকারের শ্রম, সমষ্টি উন্নয়ন ও শিল্প দপ্তরের মন্ত্রী ছিলেন[৭] ১৯৬৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর তিনি উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী হন। ভারতের এক রাজ্যের প্রথম মুখ্যমন্ত্রী হওয়ার গৌরব অর্জন করেন। তার সময়কালে বেতন বৃদ্ধির দাবিতে রাজ্য সরকারি কর্মীদের ৬২ দিনের ধর্মঘটের মোকাবিলা করাটা ছিল উল্লেখযোগ্য ঘটনা। কর্মচারীদের নেতৃবৃন্দ যে মুহূর্তে আপস করতে রাজি হন, তখনই তিনি সম্মতি প্রদান করেন। কৃপালানী বেতন বৃদ্ধির দাবি অস্বীকার করে দৃঢ়চেতা প্রশাসক হিসাবে খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।
যখন কংগ্রেস দ্বিধাবিভক্ত হয়, তখন তিনি মোরারজি দেশাইয়ের নেতৃত্বে সংগঠন কংগ্রেসে যোগদান করেন এবং সংগঠন কংগ্রেসের প্রার্থী হিসাবে ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে ফৈজাবাদ লোকসভা নির্বাচনে পরাস্ত হন। ১৯৭১ খ্রিস্টাব্দে তিনি রাজনীতি হতে অবসর নেন এবং জীবনের শেষদিন পর্যন্ত নির্জনে কাটিয়েছন।
↑সুবোধ সেনগুপ্ত ও অঞ্জলি বসু সম্পাদিত, সংসদ বাঙালি চরিতাভিধান, প্রথম খণ্ড, সাহিত্য সংসদ, কলকাতা, আগস্ট ২০১৬, পৃষ্ঠা ৭৮৯, আইএসবিএন৯৭৮-৮১-৭৯৫৫-১৩৫-৬
↑David Gilmartin (২০১৪)। "Chapter 5: The paradox of patronage and the people's sovereignty"। Patronage as Politics in South Asia। Cambridge University Press। পৃষ্ঠা ১৫১–১৫২। আইএসবিএন978-1-107-05608-4।