সমতট ছিল বাংলার দক্ষিণ-পূর্বাংশের জনপদ। মেঘনা নদীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে বর্তমান কুমিল্লা- নোয়াখালী-চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরার প্রধান অংশ নিয়ে এই জনপদ গড়ে উঠেছিল। আজ থেকে প্রায় দেড় হাজার বছর আগে সুয়ান জাং (হিউয়েন সাং) নামে একজন চৈনিক পর্যটক বাংলায় এসেছিলেন। তার লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে আমরা জানতে পারি, প্রাচীন সমতট ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান একটি কেন্দ্র। এখানে তিনি অনেক স্থাপনা দেখেছিলেন। এই স্থাপনাগুলোকে বলা হতো বিহার। বিহারগুলোতে বৌদ্ধধর্মের ভিক্ষুরা বসবাস করতেন, ধর্ম এবং জ্ঞান চর্চা করতেন।
বাংলার প্রাচীন এই জনপদগুলোর কথা আমরা জানতে পারি প্রধানত বৈদিক সাহিত্য থেকে। বৈদিক সাহিত্য রচিত হয়েছিল আর্য ভাষার মানুষের হাতে। এসব গ্রন্থে বাংলার প্রাচীন জনপদের কথা এলেও খুব সম্মানজনকভাবে আসেনি। অধিকাংশ কেন এই রকম বলা হয়েছে জানো? পণ্ডিতগণ বলে থাকেন, প্রায় আড়াই হাজার বছর পূর্বে যখন আর্য ভাষাগোষ্ঠীর মানুষেরা বাংলা অঞ্চলে প্রবেশ করছিলেন তখন এই অঞ্চলে অনেক আগে থেকে যাঁরা বসবাস করছিলেন তাঁদের বাধার মুখে তারা পড়েছিলেন। আধিপত্য বিস্তারে এই দ্বন্দ্বের কারণেই সেই সময়ের সংস্কৃত সাহিত্যে বাংলা অঞ্চলের মানুষদের তুচ্ছ করে দেখানো হয়েছে।
যাহোক, আর্যদের মধ্য থেকেই একসময় মৌর্য, গুপ্ত প্রভৃতি শক্তিশালী রাজবংশের উত্থান ঘটে। এইসব রাজশক্তির হাত ধরে বাংলায় আর্য ভাষাগোষ্ঠীর সংস্কৃতি বা বৈদিক সংস্কৃতি প্রবেশ করে। ধীরে ধীরে এইসব জনপদের নগরকেন্দ্রিক মানুষের ওপরও আর্য ধর্ম ও ভাষা-সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করতে থাকে।
সমতটবাংলার একটি প্রাচীন ভৌগোলিক অঞ্চল। পূর্ব ও দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় ব্রহ্মপুত্র নদীর মুখে বঙ্গ জনপদের প্রতিবেশী জনপদ হিসেবে ছিল সমতটের অবস্থান। এ অঞ্চলটি ছিল আর্দ্র নিম্নভূমি। চৈনিক পরিব্রাজক ইিউয়েন সাং সমতটকে কামরূপের দক্ষিণে বিস্তৃত নিম্নদেশ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। সম্ভবত উত্তরের উচ্চ এবং উঁচু-নিচু অঞ্চলের চেয়ে এই অঞ্চলের নদী বিধৌত অঞ্চল ছিল সমতল। সেই থেকে সমতট নামটি প্রচলিত হয়েছিল বলে ধারণা করা হয়। রোমান জ্যোতির্বিদ টলেমি এ অঞ্চলকে Souanagoura হিসেবে উল্লেখ করেন।
ইতিহাস
সমতট রাজ্য মেঘনা নদীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে বর্তমান কুমিল্লা-নোয়াখালী-চট্টগ্রাম এবং ভারতের ত্রিপুরার প্রধান অংশ নিয়ে গড়ে উঠেছিল। সমতট রাজ্যের রাজধানী ছিল রোহিতগিরি বর্তমান নাম শালবনবিহার যার অবস্থান কুমিল্লা শহরে। খ্রিষ্টীয় চতুর্থ শতাব্দী থেকে (কারও কারও মতে সপ্তম শতাব্দী) দ্বাদশ শতাব্দী পর্যন্ত এই জনপদের বিস্তৃতি ছিল প্রায় ৫০০ মাইল এবং বর্তমান ভারতের ত্রিপুরা জেলা ছিল সমতটের অন্যতম অংশ।
সপ্তম শতাব্দীতে সমতটের রাজধানী ছিল কুমিল্লা রোহিতগিরি এক সময় এ জনপদের পশ্চিম সীমা চব্বিশ পরগনার খাড়ি পরগনা পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল। গঙ্গা-ভাগীরথীর পূর্ব তীর থেকে শুরু করে মেঘনার মোহনা পর্যন্ত সমুদকূলবর্তী অঞ্চলকেই সম্ভবত বলা হতো সমতট। কুমিলা শহরের ১২ মাইল পশ্চিমে বড় রোহিতগিরি নামক স্থানটি সাত শতকে এর রাজধানী ছিল।
চন্দ্রবংশীয় রাজা ভবদেব কুমিল্লায় আনন্দ বিহার বা শালবন বিহার প্রতিষ্ঠা করেন। এই সময়ে বিহার এশিয়ার জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রবিন্দুতে পরিগণিত হয়। সে সময় একে বিশ্ববিদ্যালয়ের মর্যাদা দেওয়া হয়। বিখ্যাত চৈনিক পরিব্রাজক সুয়ান জাং (হিউয়েন সাং) আনন্দ বিহারে আসেন। তার লেখা ভ্রমণ বৃত্তান্ত থেকে জানা যায়, প্রাচীন সমতট ছিল বৌদ্ধ ধর্মের শিক্ষা ও সংস্কৃতির প্রধান একটি কেন্দ্র। এখানে তিনি অনেক স্থাপনা দেখেছিলেন। এই স্থাপনাগুলোকে বলা হতো বিহার। তখন বিহারে চার হাজার ভিক্ষু ছিল। তিনি ময়নামতী অঞ্চলে ৩৫টি বিহার দেখতে পান।
বর্তমান অবস্থা
বর্তমান বাংলাদেশের বৃহত্তর কুমিল্লা ও বৃহত্তর নোয়াখালী নিয়ে ছিলো সমতট অঞ্চল। বর্তমানেও এ অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অভিন্নতা রয়েছে। এই অঞ্চল নিয়ে কুমিল্লা বিভাগ নামে প্রশাসনিক বিভাগ (প্রস্তাবিত). এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক অভিন্নতা অটুট রাখতে এবং আঞ্চলিক ঐক্য প্রতিষ্ঠায় বৃহত্তর সমতট ঐক্য সংসদ নামে সাংস্কৃতিক সংগঠনটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
বঙ্গদেশের এক নাম সমতট, বরাহমিহিরের কুর্ম্মবিভাগ গ্রন্থে বঙ্গ,উপবঙ্গ ও সমতটকে পৃথক দেশে ধরা হয়ছে,বোধ হয় বঙ্গের সমুদ্রতীরস্থ অংশই সমতট।তবকৎ-ই-নাসিরী গ্রন্থে সমতটকে সনতট বা সাঁকট নাম লিখিত আছে। আবার হোয়েনসাং লিখেছেন "সমতটরাজ্য চক্রাকৃতি তাহার বেষ্টন তিন হাজার লি এবং সমুদ্রতীরবর্ত্তী।রাজধানীর বেষ্টন ২০ লি, ভূমি নিম্ন ও উর্বর এবং অপর্য্যাপ্ত শস্য উৎপাদন হয়,জলবায়ু প্রীতিকর, অধিবাসিরা খর্বকায়,কৃষ্ণবর্ণ ও কষ্টসহিষ্ণু, রাজ্যে সত্যধর্ম্ম ও অপধর্ম্ম উভয়ই প্রচলিত।ত্রিশটি সঙ্ঘারামে প্রায় দুই হাজার ব্রাহ্মণ বাস করতেন, রাজ্যে প্রায় একশত দেবমন্দির আছে, অসংখ্য উলঙ্গ নিগ্রন্থ বাস করে।নগরের নিকট অশোকস্তূপ বর্তমান।পূর্ব্বকালে তথাগত সেখানে সপ্তাহকাল শাস্ত্র ব্যাখ্যা করেন।স্তূপের নিকটস্থ সঙ্ঘারামে হরিৎ প্রস্ত ল্র নির্মিত ৮ ফুট উচ্চ বুদ্ধমূর্ত্তি ছিল।" এইছিল হোয়েনসাং এর বিবরণ।