মোহাম্মদ নাসিম (২ এপ্রিল ১৯৪৮ – ১৩ জুন ২০২০) বাংলাদেশের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। তিনি স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের সাবেক মন্ত্রী ছিলেন।[১] তিনি ১৯৯৬ সালে স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ৬ বার জাতীয় সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও ১৪ দলের মুখপাত্র হিসাবে ছিলেন।[২]
জন্ম ও শিক্ষা জীবন
মোহাম্মদ নাসিমের জন্ম ১৯৪৮ সালের ২ এপ্রিল সিরাজগঞ্জ জেলার কাজীপুর উপজেলায়। তার পিতা শহীদ ক্যাপ্টেন এম মনসুর আলী[৩] এবং মাতা আমেনা মনসুর। পিতা মনসুর আলী বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক, মুক্তিযুদ্ধকালীন বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রী, স্বাধীন বাংলাদেশের তৃতীয় প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।[৪]
মোহাম্মদ নাসিম পাবনার এডওয়ার্ড কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি ছাত্র সংগঠন ছাত্র ইউনিয়নের নেতা ছিলেন। ১৯৬৬ সালে শেখ মুজিবুর রহমান ছয় দফা আন্দোলনের এক সমাবেশে অংশ নিতে পাবনায় যান এবং পরে তিনি মনসুর আলীর বাড়িতে যান, যেখানে তিনি জানতে পারেন যে নাসিম ছাত্র ইউনিয়নের নেতা। শেখ মুজিবুর রহমানের অনুরোধে নাসিম আওয়ামী লীগের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে হাজির হন এবং পরবর্তীকালে এই সংগঠনে যোগ দেন। ১৯৬৭ সালে, নাসিম এডওয়ার্ড কলেজের ছাত্র ইউনিয়ন নির্বাচনে নির্বাচিত হন।[৫]
এডওয়ার্ড কলেজ থেকে এইচএসসি পাশের পর তিনি ঢাকায় এসে জগন্নাথ কলেজে (বর্তমানে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়) ভর্তি হন ও এখান থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি অর্জন করেন।[৪] বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় নাসিম মুজিবনগর সরকারের পক্ষে কাজ করেন।
রাজনৈতিক জীবন
১৯৮৬, ১৯৯৬ ও ২০০১ সালেও সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন মোহাম্মদ নাসিম। পরবর্তীতে ২০১৪ সালে তিনি সিরাজগঞ্জ-১ আসন থেকে সংসদ সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হন এবং ২০১৪ সালের ১২ জানুয়ারি মন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন।
ছাত্র ইউনিয়নের মাধ্যমে ষাটের দশকে ছাত্র রাজনীতির জীবন শুরু[৪] হলেও পরবর্তীতে বঙ্গবন্ধুর সরাসরি প্রভাবে তিনি ছাত্রলীগে যোগদান করেন।[২] ছাত্র অবস্থায় ১৯৬৬ সালে তিনি পাবনা অঞ্চলে ‘ভুট্টা আন্দোলন’ সংগঠিত করলে পিতা এম. মনসুর আলীর সঙ্গে কারারুদ্ধ হন।[৬] ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর নাসিম আওয়ামী লীগের পাবনা জেলা শাখার যুগ্মসচিব হন। ১৯৭৩ সালের সংসদ নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়ন লাভের চেষ্টা করে ব্যর্থ হন। তাকে পরে আওয়ামী লীগের যুব শাখা বাংলাদেশ যুবলীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। ১৯৭৫ সালে বাকশাল গঠনের পরে তাকে এর সাধারণ সম্পাদক নিযুক্ত করা হয়। পঁচাত্তরের হত্যাকাণ্ডের পর মোহাম্মদ নাসিমকেও গ্রেপ্তার করা হয়। সেইসময় দীর্ঘদিন তাকে কারাগারে থাকতে হয়।[৪]
১৯৮১ সালের আওয়ামী লীগের সম্মেলনের মাধ্যমে ছাত্ররাজনীতি থেকে জাতীয় রাজনীতিতে প্রবেশ করেন নাসিম। ওই সম্মেলনে আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮২ সালে নাসিমকে আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৮৭ সালের সম্মেলনে দলের প্রচার সম্পাদক মনোনীত হন। ১৯৯২ ও ১৯৯৭ সালের সম্মেলনে তিনি দলের সাংগঠনিক সম্পাদকের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। ২০০২ সালের আগ পর্যন্ত কেন্দ্রীয় কমিটিতে সাংগঠনিক সম্পাদকের পদ একটি ছিল। এরপর থেকে বিভাগভিত্তিক সাংগঠনিক সম্পাদকদের দায়িত্ব দেয়া হয়। ২০০২ ও ২০০৮ সালে অনুষ্ঠিত দলের সম্মেলনে তাকে দলের কার্যনির্বাহী কমিটির এক নম্বর সদস্য পদে রাখা হয়। ২০১২ সালের সম্মেলনে তাকে দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য পদে পদোন্নতি দেয়া হয়। পরপর তিন মেয়াদে তিনি এই দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৮৬ সালে নাসিম প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন। সিরাজগঞ্জ-১ সংসদীয় আসন (কাজীপুর) থেকে পাঁচবার বিজয়ী হন তিনি। ১৯৯১-এ তিনি জাতীয় সংসদে বিরোধী দলের চীফ হুইপ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।[৬] ১৯৯৬ সালে তিনি স্বরাষ্ট্র, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং ডাক ও টেলিযোগাযোগ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী নিযুক্ত হন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে তৎকালীন ১/১১ সরকারের দেওয়া মামলার কারণে অংশগ্রহণ করতে পারেন নি। ঐ নির্বাচনে তার সন্তান তানভীর শাকিল জয় দলীয় মনোনয়ন লাভ করেন। ২০১২ সালে কাউন্সিলে তাকে প্রেসিডিয়াম সদস্য নির্বাচিত করা হয়।[৪] এরপর ২০১৪ সালের নির্বাচনে নাসিমকে মনোনয়ন পান এবং বিজয়ী সরকারের স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব গ্রহণ করেন।[২][৭] ২০১৯ সালের নির্বাচনেও তিনি বিজয়ী হন।[৮]
ব্যক্তিগত জীবন
পারিবারিক জীবনে মোহাম্মদ নাসিম বিবাহিত এবং তিন সন্তানের জনক ছিলেন। তার স্ত্রীর নাম লায়লা আরজুমান্দ।
মৃত্যু
রক্তচাপজনিত সমস্যা নিয়ে ২০২০ সালের ১ জুন হাসপাতালে ভর্তি হন নাসিম। ওই দিনই কোভিড-১৯ পজিটিভ আসে তার।[৯] এর চার দিন পর, চিকিৎসার সময় তার ইন্ট্রাসেরিব্রাল রক্তক্ষরণ হয়েছিল।[৬] এরপর ৪ জুন অবস্থার উন্নতি হয়, তবে পুনরায় ৫ জুন ভোরে তিনি বড় ধরনের স্ট্রোক করেন। মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণজনিত সমস্যার কারণে দ্রুত অস্ত্রোপচার করে আইসিইউতে রাখা হয়। তার চিকিৎসায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য কনক কান্তি বড়ুয়ার নেতৃত্বাধীন সাত সদস্যের বোর্ড গঠিত হয়। এরপর দুই দফায় ৭২ ঘণ্টার পর্যবেক্ষণে ছিলেন।[১০][১১] এর মধ্যে পরপর তিনবার নমুনা পরীক্ষা করে করোনাভাইরাস অনুপস্থিত পাওয়া যায়।[১২] ১২ জুন পরপর কয়েকদিন স্থিতিশীল থাকার পরে পুনরায় অবস্থার অবনতি ঘটে।[১৩] পরবর্তীতে ২০২০ সালের ১৩ই জুন ঢাকায় বেলা ১১টা ১০ মিনিটে মৃত্যুবরণ করেন তিনি।[১৪][১৫]
তথ্যসূত্র