ফিল্ড মার্শাল মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুই সোলাইমান (আরবি: محمد حسين طنطاوى سليمان, মিশরীয় আরবি: mæˈħæmmæd ħeˈseːn tˤɑnˈtˤɑːwi seleˈmæːn; (জন্মঃ ৩১ অক্টোবর, ১৯৩৫) একজন মিশরীয় সামরিক ও রাষ্ট্রনেতা। তিনি মিশরের সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক এবং সুপ্রিম কাউন্সিল অফ দ্য আর্মড ফোর্সেস বা স্কাফের চেয়ারম্যান।[১] তিনি ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ তারিখে হোসনি মুবারাকের ক্ষমতাচ্যুতি থেকে ৩০ জুন, ২০১২ তারিখে নবনির্বাচিত রাষ্ট্রপতি মুহাম্মাদ মুরসির দায়িত্ব গ্রহণ পর্যন্ত মিশরের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। তানতায়ুই ১৯৯১ সাল থেকে মিশরের প্রতিরক্ষা ও সামরিক উৎপাদন বিষয়ক মন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। জানুয়ারি ২০১১ তে হোসনি মুবারাক তানতায়ুইকে উপ-প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নিয়োগ দিলে এই পদেও তিনি একমাস দায়িত্ব পালন করেন।
সামরিক জীবন
নিউবিয়ান বংশোদ্ভুদ মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুই ১ এপ্রিল, ১৯৫৬ তারিখে মিশরের সশস্ত্র বাহিনীর পদাতিক বিভাগে কর্মকর্তা হিসেবে কমিশন লাভ করেন।[২][৩] সেনাবাহিনীতে যোগদানের পরের বছর তানতায়ুই সুয়েজ যুদ্ধে নিযুক্ত হন। সেনাবাহিনীর পেশাগত জীবনে তানতায়ুই ১৯৬৭ সালের ছয় দিনের যুদ্ধ, পরের তিন বছরের ওয়ার অফ অ্যাট্রিশান ও ১৯৭৩ সালের ইয়ম কিপ্পার যুদ্ধে অংশ নিয়েছেন।
সামরিক জীবনে তানতায়ুই একাধিক নেতৃস্থানীয় পদ অলংকরণ করেছেন, যার মধ্যে রয়েছে সেনাপ্রধান ও মিশরের দ্বিতীয় সেনাদলের সর্বাধিনায়কের দায়িত্ব।
কূটনৈতিক দায়িত্মের মধ্যে তানতায়ুই একবার পাকিস্তানে মিশরের সামরিক অ্যাটাশে হিসেবে দায়িত্ম পালন করেন, যে পদটিকে বৃহত্তর অঞ্চলের ভূ-রাজনীতি এবং দুই দেশের ঐতিহাসিক, সামরিক ও রাজনৈতিক সম্পর্কের একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
তানতায়ুই মিশরের রিপাবলিকান গার্ডের অধিনায়ক হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মিশরীয় সেনাবাহিনীর অপারেশানস চীফ হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
১৯৯১ সালে গালফ ওয়ারের সময় তানতায়ুই ইরাকে মার্কিন নেতৃত্বাধীন বহুদেশীয় বাহিনীর মিশরীয় অংশের নেতৃত্ব দেন এবং কুয়েত থেকে ইরাকি সৈন্য অপসারণের সামরিক অভিযানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।
২০ মে, ১৯৯১ তারিখে প্রভাবশালী সেনা অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট জেনারেল ইউসেফ সাবরি আবু তালেবের অপসারণের পর তানতায়ুই মিশরের প্রতিরক্ষা ও সামরিক উৎপাদন বিষয়ক মন্ত্রী নিযুক্ত হন এবং মিশরীয় সামরিক কাঠামোর কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে চলে আসেন। একই সাথে তিনি মিশরীয় সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়কের দায়িত্ম এবং ফিল্ড মার্শাল হিসেবে পদোন্নতি পান।
ধারণা করা হয় ১৯৯৫ সালে হোসনি মুবারাকের উপর হত্যাকান্ডের প্রচেষ্টা সফল হলে মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুইই মিশরের রাষ্ট্রপতি হিসেবে দায়িত্ম গ্রহণ করতেন। এছাড়া মুবারাকের রাষ্টপতিত্বের শেষ পর্যায়ও সম্ভাব্য উত্তরসূরী হিসেবে তানতায়ুইর নাম উঠে এসেছিল।
২০১১-২০১২ মিশরীয় বিপ্লব
আঠারো দিনের টানা দেশব্যাপী রক্ষক্ষয়ী ও প্রাণঘাতী গণঅভ্যুত্থানের পর ১১ ফেব্রুয়ারি, ২০১১ তারিখে রাষ্ট্রপতি হোসনি মুবারাক পদত্যাগ করেন এবং মিশরের রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা সশস্ত্র বাহিনীর সর্বোচ্চ পরিষদ স্কাফের কাছে হস্তান্তর করেন। স্কাফের চেয়ারম্যান হিসেবে মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুই মিশরের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হিসেবে আসীন হন। অন্তর্বতিকালীন তত্ত্বাবধায়ন গঠনের উদ্দেশ্যে স্কাফ বিচারপতি ফারুক সুলতানের নেতৃত্বাধীন সর্বোচ্চ সাংবিধানিক আদালতের সাথে যৌথ ভাবে মিশর শাসন শুরু করে এবং মিশরীয় সংসদকে বিলুপ্ত ঘোষণা করে। এই যৌথ নেতৃত্বের অধীনেই ১৯ মার্চ তারিখে মুবারাকের গ্রহণযোগ্যতা এবং তার প্রশাসনের শীর্ষ নেতৃত্বের বিচারযোগ্যতার উপর গণভোট অনুষ্ঠিত হয়।[৪]
মিশরের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হওয়ার পর থেকে তানতায়ুই গণমাধ্যমকে এড়িয়ে চলা শুরু করেন এবং পারতপক্ষে কোন উন্মুক্ত অনুষ্ঠানে অংশ নিতেন না। ক্ষমতা গ্রহণের পর তিনি গণমাধ্যমের সামনে সর্বপ্রথম আসেন ১৬ মে, ২০১১ তারিখে। তিনি এ সময়ে মিশরের পুলিশ অ্যাকাডেমির কোর্স সম্পন্নের অনুষ্ঠানে অংশ নিয়ে একটি বক্তব্য দেন, যেটি প্রেস বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমেও প্রকাশ পায়।
এ সময়ই তানতায়ুই মিশরীয় অ্যাকাডেমিক ইসাম শরাফকে প্রধানমন্ত্রী নিয়োগ দিয়ে তাকে নতুন মন্ত্রিসভা ও সরকার গঠনের দায়িত্ম দেন।
দায়িত্মপালনকালে তানতায়ুই ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী ডেভিড ক্যামেরন এবং মার্কিন পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিলারি ক্লিনটনের মত গুরুত্বপূর্ণ বিদেশী অতিথিদের সাথেও দেখা করেন।
নভেম্বরের বিক্ষোভ ও জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ
অনির্দিষ্টকালীন সামরিক শাসন আর নির্বাচনে বিলম্বের প্রতিবাদে ঐ বছরের নভেম্বরে আবারও তাহরির স্কয়ারসহ দেশব্যাপী রক্ষক্ষয়ী বিক্ষোভ এবং আন্দোলনকারী ও সরকারি বাহিনীর সদস্য সহ ৩৩ জন নিহত ও দুই সহস্রাধিক মানুষ আহত হলে তানতায়ুই মিশরের রাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত টেলিভিশনে উপস্থিত হয়ে দেশবাসীর উদ্দেশ্যে একটি ভাষণ দেন। তিনি দ্রুত নির্বাচন অনুষ্ঠানে সরকারের আন্তরিকতার ব্যাপারে জোর দেন এবং সবার প্রতি শান্ত থাকার অনুরোধ জানিয়ে ঘোষণা দেন- তার সরকার প্রয়োজনে প্রশাসনে সশস্ত্র বাহিনীর অংশগ্রহণের উপর গণভোট অনুষ্ঠানে রাজি আছে।[৫]
বিতর্ক ও সমালোচনা
অক্টোবর ২০১১ তে মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুই বাহরাইনের রাজা হামাদ বিন ইসা আল খালিফাকে জাঁকজমকপূর্ণ ভাবে অভ্যর্থনা জানানোর পর বাহরাইনের একাধিক মানবাধিকার ও নাগরিক সংগঠনের সমালোচনার শিকার হন। বাহরাইন সেন্টার ফর হিউম্যান রাইটসের প্রধান নাবিল রাজাব বিবৃতি দিয়ে বলেন, গণতন্ত্রকামী বাহরাইনীদের বিক্ষোভের শিকার রাজা আল খালিফাকে অভ্যর্থনা জানিয়ে তানতায়ুই গণতন্ত্রের প্রতি মিশরের অস্থায়ী সামরিক প্রশাসনের আন্তরিকতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন।[৬]
এছাড়া তানতায়ুই প্রায় পুরো সময়ই তাহরির স্কয়ার কেন্দ্রীক মিশরীয় বিক্ষোভকারীদের ক্ষোভের কেন্দ্রস্থলে অবস্থান করেছেন। সরকারবিরোধী ও গণতন্ত্রকামী শ্লোগানে প্রতিনিয়ত তানতায়ুইর বিষোদগার, তার পদত্যাগের দাবী ও তার প্রতি ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে, যার মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য ছিল মিশরীয় তরুণদের প্রতি এই মর্মে একটি শ্লোগান, “তানতায়ুই তোমাদের নারীদের বস্ত্রহরণ করেছে, অতএব তাকে উৎখাতের আন্দোলনে আমাদের সাথে যোগ দাও!”।
দ্য টেলিগ্রাফ কর্তৃক মিশরীয় বিপ্লবের কভারেজে দেখা যায়, বিক্ষোভকারীরা মোহামেদ হুসেইন তানতায়ুইকে মৃত্যুদন্ড দেয়ার দাবী জানাচ্ছে।[৭]
তথ্যসূত্র