যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় মাতৃকোষের নিউক্লিয়াসটি দু'বার এবং ক্রোমোজোম একবার বিভাজিত হয়ে একটি মাতৃকোষ হতে চারটি অপত্য কোষ সৃষ্টি হয় এবং অপত্য কোষে ক্রোমোজোমের সংখ্যা মাতৃকোষের অর্ধেক হয়, তাকে মিয়োসিস(Meiosis) বলে। সংক্ষেপে, যে কোষ বিভাজন প্রক্রিয়ায় নতুন সৃষ্ট কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়ে যায়, তাকে মিয়োসিস বলে। মিয়োসিস বা মায়োসিস এক বিশেষ ধরনের কোষ বিভাজন প্রক্রিয়া যাতে মাতৃকোষেরনিউক্লিয়াসটি পরপর দুবার বিভাজিত হলেও ক্রোমোজোমের বিভাজন ঘটে মাত্র একবার, ফলে অপত্য কোষের ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়ে যায়। ১৮৮৭ খ্রিস্টাব্দে বোভেরী সর্বপ্রথম গোল কৃমির জননাঙ্গে এরূপ কোষবিভাজন প্রত্যক্ষ করেন। বিজ্ঞানী স্ট্রাসবার্গার ১৮৮৮ খ্রিস্টাব্দে সপুষ্পক উদ্ভিদএর জনন মাতৃকোষে এরূপ কোষবিভাজন প্রত্যক্ষ করেন। এরপর ১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে জে. বি. ফারমার ও জে. ই. এস. মুর এ বিশেষ ধরনের কোষবিভাজনের নামকরণ করেন।[১] গ্রীক মূল শব্দের উপর ভিত্তি করে এর বানান করা হয় Meiosis অর্থাৎ মিয়োসিস ।[২]
নিম্নশ্রেণির জীব অর্থাৎ হ্যাপ্লয়েড(n) জীবের গ্যামেটও হ্যাপ্লয়েড। দুটি হ্যাপ্লয়েড গ্যামেটের মিলনে ডিপ্লয়েড (2n) জাইগোট-এর জন্ম হয়। কাজেই হ্যাপ্লয়েড জীবের ক্ষেত্রে প্রজাতির বৈশিষ্ট্য রক্ষার নিমিত্তে নিষেকের পর জাইগোটে মিয়োসিস হয়।
উচ্চ শ্রেণির প্রাণী এবং উদ্ভিদ সাধারণত ডিপ্লয়েড (2n) ডিপ্লয়েড জীব থেকে হ্যাপ্লয়েড গ্যামেট সৃষ্টি হলেই নিষেকের পর পুনরায় ডিপ্লয়েড অবস্থার পুনরাবৃত্তি ঘটা সম্ভব। এজন্য ডিপ্লয়েড জীবের ক্ষেত্রে যৌন একক বা গ্যামেট সৃষ্টির পূর্বে জনন মাতৃকোষে মিয়োসিস সংঘটিত হয়।[৩]
বৈশিষ্ট্য
জনন মাতৃকোষের নিউক্লিয়াসএ মিয়োসিস ঘটে। মিয়োসিসের ফলে একটি নিউক্লিয়াস থেকে চারটি অপত্য নিউক্লিয়াসের জন্ম হয়।মিয়োসিস-১ এ হোমোলোগাস বা সমসংস্থ ক্রোমোজোমগুলো জোড়ায় জোড়ায় মিলিত হয়ে বাইভ্যালেন্ট সৃষ্টি হয়। কায়াজমা সৃষ্টি ও ক্রসিং ওভারের ফলে নন-সিস্টার ক্রোমাটিডগুলোর মধ্যে অংশের বিনিময় ঘটে। ফলে নতুন চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের আবির্ভাব ঘটে। মিয়োসিসে ক্রোমোজোমের একবার এবং নিউক্লিয়াসের দুই-বার বিভাজন ঘটে। অপত্য নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোম সংখ্যা মাতৃ-নিউক্লিয়াসের ক্রোমোজোম সংখ্যার অর্ধেক হয়।
কোনো কোষের নিউক্লিয়াসে ক্রোমোজোম সংখ্যা 2n হলে, মিয়োসিসের পর অপত্য চারটি কোষে ক্রোমোজোম সংখ্যা হয় n ।
বিভাজন প্রক্রিয়া
মিয়োসিস বিভাজনের সময় একটি কোষ পর পর দুবার বিভাজিত হয়। প্রথম বিভাজনকে মিয়োসিস-১ এবং দ্বিতীয় বিভাজনকে মিয়োসিস-২ বলা হয়।[৪] প্রথম বিভাজনের সময় অপত্য কোষে ক্রোমোসোমের সংখ্যা মাতৃকোষের ক্রোমোসোম সংখ্যার অর্ধেক পরিণত হয় তাই একে হ্রাস বিভাজন বলে। দ্বিতীয় বিভাজনটি মাইটোসিসের অনুরুপ।[৫]
মিয়োসিস-১
প্রথম মিয়োটিক বিভাজনকে চারটি ধাপে ভাগ করা হয়েছে,[৬] যেমন-
প্রোফেজ-১ঃ এই ধাপটি বেশ দীর্ঘস্থায়ী এবং জটিল। ঘটনা পরম্পরা অনুযায়ী একে নিম্নলিখিত পাঁচটি উপধাপে ভাগ করা হয়েছে।
লেপ্টোটিন[৭]একে পোলারাইসড বিন্যাস বলা হয়। এই উপদশায় ক্রোমাটিন তন্তুগুলি নিউক্লিওপর্দার কাছে ফুলের বোকের আকারে সজ্জিত থাকে। একে বোকে স্টেজ বলে।
জাইগোটিনএই উপদশায় বাইভ্যালেন্ট স্টেজ দেখা যায় ও সাইন্যাসিস ঘটে।
প্যাকাইটিনএই উপদশায় টেট্রাড গঠিত হয়,রেসিপ্রকাল কায়াজমা অথবা কমপ্লিমেন্টারি কায়াজমা গঠিত হয়ে ক্রসিং ওভারের মাধ্যমে জিনের আদান প্রদান ঘটে।
টেলোফেজের শেষ দিকে প্রজাতিভেদে মাইটোসিস প্রক্রিয়ার অনুরুপ সাইটোকাইনেসিস ঘটে অথবা ঘটেনা।
কোষে সাইটোকাইনেসিস ঘটুক কিংবা না ঘটুক অল্প সময়ের মধ্যে এরা দ্বিতীয় মিয়োটিক বিভাজনে (মিয়োসিস-১) অংশ গ্রহণ করে।
ইন্টারকাইনেসিস
মিয়োসিস কোষবিভাজন প্রক্রিয়ায় নিউক্লিয়াসের প্রথম ও দ্বিতীয় বিভক্তির মধ্যবর্তী সময়কে ইন্টারকাইনেসিস বলা হয়। এ সময়ে অত্যাবশ্যকীয় DNA, প্রোটিন প্রভৃতি সংশ্লেষিত হয়। DNA- এর অনুলিপন সৃষ্টি হয় না।
মিয়োসিস-২
মিয়োসিস-১ এ সৃষ্ট হ্যাপ্লয়েড মাতৃকোষ বা নিউক্লিয়াস দুটি যে পদ্ধতিতে ৪টি হ্যাপ্লয়েড (n) কোষ বা নিউক্লিয়াস গঠন করে, তাকে মিয়োসিস-২ বলে। এ বিভাজনকেও চারটি পর্যায়ে ভাগ করা হয়েছে।
প্রোফেজ-২
মেটাফেজ-২
অ্যানাফেজ-২
টেলোফেজ-২.
সাইটোকাইনেসিস
পূর্বেই বলা হয়েছে যে, কোন কোন জীবে মিয়োসিস-১ এর পর পরই সাইটোপ্লাজমের বিভক্তির ফলে দুটি অপত্য কোষের সৃষ্টি হয় অথবা সাইটোকাইনেসিস তখন না হয়ে মিয়োসিস-২ এর পর সাইটোপ্লাজমের বিভাজন ঘটে, ফলে ৪টি অপত্য কোষের সৃষ্টি হয়।
মিয়োসিসের তাৎপর্য
(১) ক্রোমোজোম সংখ্যা ঠিক রাখা: যৌন প্রজনন বলতে পুং-জননকোষ ও স্ত্রী-জননকোষের মিলনকে বোঝায়। সমস্ত
উন্নত স্তরের প্রাণীর ক্ষেত্রে এভাবে প্রজনন ঘটে। এখন প্রত্যেক প্রজাতির জন্যে ক্রোমোজোমের সংখ্যা নির্দিষ্ট। পুং ও স্ত্রী-জননকোষের নিউক্লিয়াসেও যদি সেই নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রোমোজোম থাকে তাহলে উভয়ের মিলনকালে সেই সংখ্যা দ্বিগুণ হয়ে যাওয়ার সম্ভাবনা। এই বাস্তব অসুবিধে এড়ানোর জন্যেই প্রকৃতিতে মিয়োসিস পদ্ধতিতে বিভাজনের ব্যবস্থা আছে। এতে এমন ব্যবস্থা রয়েছে যে, পরিপক্ক জননকোষ সৃষ্ট হওয়া কালে তার ক্রোমোজোম সংখ্যা (2n) হ্রাস পায় বা পূর্ণসংখ্যার অর্ধেকে পরিণত হয় (n)। যেমন মানুষের ক্রোমোজোম সংখ্যা 46, কিন্তু পরিপক্ক জননকোষে অর্থাৎ শুক্রাণু আর ডিম্বাণুর মধ্যে থাকে মাত্র 23-টি ক্রোমোজোম। ফলে শুক্রাণু ও ডিম্বাণুর মিলনে (Syngamy) যে জাইগোট উৎপন্ন হয়, তাতে স্বাভাবিক সংখ্যা- (23+ 23 = 46-টি ক্রোমোজোম) আবার ফিরে আসে। এইভাবেই মিয়োসিস বিভাজন প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মনীতি অক্ষুণ্ণ রাখে।
শুধুমাত্র জননকোষের ক্ষেত্রেই এই হ্রাসকরণ ব্যবস্থার প্রয়োজন। দেহের অন্যান্য কোষে কখনও মিয়োসিস বিভাজন সংঘটিত হয় না।
(২) জনুঃক্রম:কিছুসংখ্যক অপুষ্পক উদ্ভিদ, (যেমন মস, ফার্ণ) ও নিম্নস্তরের প্রাণীর (যেমন, মনোসিস্টিস) ক্ষেত্রে দেখা যায় যে, তাদের জীবনবৃত্তান্ত সম্পূর্ণ হতে দুটি প্রজন্ম বা জনির (Generation) পর্যায়ক্রমে আসার প্রয়োজন হয়। এর মধ্যে একটি জনি যৌন ও অপরটি অযৌন। অর্থাৎ, যৌন প্রজননের ফলে সৃষ্ট অপত্য সরাসরি অযৌন পদ্ধতিতে প্রজনন করে
এবং তার পরিণামে পুনরায় যৌন জনির সৃষ্টি হয়।
এই জনুঃক্রমে মাইটোসিস ও মিয়োসিস পদ্ধতি উভয়েরই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। যৌন জনিতে দেহকোষে বা দেহমধ্যে সৃষ্ট জননকোষ অর্ধসংখ্যক (হ্যাপলয়েড) ক্রোমোজোম থাকে, অর্থাৎ মিয়োসিস প্রক্রিয়ায় বিভাজনের ফলে ঐ জনি সৃষ্টি হয়। কিন্তু অযৌন জনিতে দেহকোষে থাকে পূর্ণসংখ্যক (ডিপ্লয়েড) ক্রোমোজোম, যাতে বোঝা যায় যে, তার উৎপত্তির মূলে আছে মাইটোসিস পদ্ধতির বিভাজন। অর্থাৎ, মিয়োসিস ও মাইটোসিস পদ্ধতিই মূলত জনুঃক্রমের জন্যে দায়ী।
(3) জিন-পুনর্মিলন:মিয়োসিস বিভাজনকালে হোমোলোগাস ক্রোমোজোমগুলির মধ্যে 'ক্রসিং ওভার' পদ্ধতিতে যে অংশ বিনিময় ঘটে তার ফলে একটির জিনগুলি অপর ক্রোমোজোমের জিনগুলির সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পায়। এই বিষয়টিই মুখ্যত জিন পুনর্মিলনের অন্তর্গত। অবশ্য অন্যান্য বিভিন্ন উপায়েও এমন পুনর্মিলন ঘটতে পারে। যেমন, কোনো ক্রোমোজোম থেকে বিচ্ছিন্ন অংশ অপর ক্রোমোজোমের সঙ্গে জুড়ে যেতে পারে, অথবা একই ক্রোমোজোমের খণ্ডিত অংশ উল্টোভাবে জুড়ে গেলেও জিনগুলির বিন্যাস ব্যবস্থার পরিবর্তন ঘটে। এসবই মিয়োসিস বিভাজন কালে সম্পন্ন হয়।
এখন জিনগুলিই জীবদেহের বৈশিষ্ট্য নির্ধারক, তাই জিন পুনর্মিলনে এই বৈশিষ্ট্যের বিশেষ রদবদল ঘটার সম্ভাবনা থাকে (Variation)। বস্তুত জীবজগতে বৈচিত্র্য সৃষ্টির জন্যে এই ব্যাপার গুলোকেই দায়ী করা হয়। এই বৈচিত্র্যের উপর সমগ্র অভিব্যক্তির বিষয়টি নির্ভরশীল বলে মিয়োসিস পদ্ধতিকে অভিব্যক্তির অন্যতম হেতু (Factor) হিসেবে চিহ্নিত করা হয়।
[৮]
↑J.B. Farmer and J.E.S. Moore, Quarterly Journal of Microscopic Science 48:489 (1905) as quoted in the Oxford English Dictionary, Third Edition, June 2001, s.v.