কমলাকার পিপলাই পৃষ্ঠপোষক- বসু পরিবার শ্যামবাজার, কলকাতা
মাহেশের রথযাত্রা (ইংরেজি: Rathayatra of Mahesh) ভারতের দ্বিতীয় প্রাচীনতম এবং বাংলার প্রাচীনতম রথযাত্রা উৎসব।[১] এই উৎসব ১৩৯৬ খ্রিস্টাব্দ থেকে পশ্চিমবঙ্গেরশ্রীরামপুর শহরের মাহেশে অনুষ্ঠিত হয়ে আসছে।[২] রথযাত্রার সময় মাহেশের স্নানপিড়ি ময়দানে এক মাস ধরে মেলা চলে। শ্রীরামপুরের মাহেশ জগন্নাথ দেবের মূল মন্দির থেকে মাহেশ গুন্ডিচা মন্দির (মাসীরবাড়ী) অবধি জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রার ৫০ ফুট উচ্চতাসম্পন্ন রথটি টেনে নিয়ে যাওয়া হয়। উল্টোরথের দিন আবার রথটিকে জগন্নাথ মন্দিরে ফিরিয়ে আনা হয়।
শ্রীরামপুরের মাহেশের রথে শ্রীশ্রী জগন্নাথ, বলরাম ও সুভদ্রা
রথযাত্রার ইতিহাস
প্রাচীন
মাহেশের জগন্নাথ মন্দির ও রথযাত্রা উৎসবের পিছনে একটি কিংবদন্তি রয়েছে। সেটি হল: চতুর্দশ শতকে ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী নামে এক বাঙালি সাধু পুরীতে তীর্থ করতে গিয়েছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল যে তিনি জগন্নাথদেবকে নিজের হাতে ভোগ রেঁধে খাওয়াবেন। কিন্তু পুরীর মন্দিরের পাণ্ডারা বাধ সাধায় তিনি তা করতে পারলেন না। তখন দুঃখিত হয়ে তিনি আমরণ অনশনে বসলেন। তিন দিন পরে জগন্নাথদেব তাঁকে দেখা দিয়ে বললেন, "ধ্রুবানন্দ, বঙ্গদেশে ফিরে যাও। সেখানে ভাগীরথী নদীর তীরে মাহেশ নামেতে এক গ্রাম আছে। সেখানে যাও। আমি সেখানে একটি বিরাট দারুব্রহ্ম (নিম গাছের কাণ্ড) পাঠিয়ে দেবো। সেই কাঠে বলরাম, সুভদ্রা আর আমার মূর্তি গড়ে পূজা করো। আমি তোমার হাতে ভোগ খাওয়ার জন্য উদগ্রীব।" এই স্বপ্ন দেখে ধ্রুবানন্দ মাহেশে এসে সাধনা শুরু করলেন। তারপর এক বর্ষার দিনে মাহেশ ঘাটে একটি নিমকাঠ ভেসে এল। তিনি জল থেকে সেই কাঠ তুলে তিন দেবতার মূর্তি বানিয়ে মন্দির প্রতিষ্ঠা করলেন।[৩]
সন্ন্যাস গ্রহণের পরে শ্রীচৈতন্য পুরীর উদ্দেশ্যে রওয়ানা হন। পথে তিনি মাহেশে পৌঁছেছিলেন।[৪] ধ্রুবানন্দের মন্দির পরিদর্শন করার পরে তিনি তার জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন এবং গভীর সমাধিতে মগ্ন হন। শ্রীচৈতন্য মাহেশকে 'নব নীলাচল' অর্থাৎ 'নতুন পুরী' বলে নামকরণ করেছিলেন।[৪] পরে বৃদ্ধ ধ্রুবানন্দ তাকে মন্দিরের দায়িত্ব নেওয়ার জন্য অনুরোধ করেছিলেন। এতে মহাপ্রভু কমলাকার পিপলাইকে মন্দিরের ভার দেন।যিনি ছিলেন শ্রীচৈতন্যদেবের দ্বাদশ গোপালদের মধ্যে পঞ্চম।এর কিছুদিন পর ধ্রুবানন্দের প্রয়াণ হয়। কমলাকার সুন্দরবনের খালিঝুলির জমিদারের পুত্র। তিনি যুক্তিবিজ্ঞান অধ্যয়ন করতে নবদ্বীপে এলেন। পরে তিনি মহাপ্রভুর একজন প্রিয় শিষ্য হয়ে ওঠেন এবং তার মন্ত্রণালয় এ যোগদান করেন। তিনি ৬৪ মহন্তের মধ্যে প্রথম। মাহেশ জগন্নাথ মন্দিরে ভার গ্রহণ করার পর, তিনি সেখানে থাকতে শুরু করেন ।তিনিই এই বিখ্যাত রথ উৎসব ৬২০ বছর আগে শুরু করেন।
তাঁর উত্তরাধিকারীরা এখনো সেবাইত বা মন্দির 'অধিকারী' হিসেবে মাহেশে বসবাস করেন।
আধুনিক
পরবর্তীকালে ১৭৫৫-এ কলকাতার নয়নচাঁদ মল্লিক মাহেশে জগন্নাথ দেবের মন্দির তৈরি করেছিলেন যা আজও রয়েছে। বর্তমান রথটি প্রায় ১২৯ বছরের পুরনো। সে যুগে ২০ হাজার টাকা ব্যয়ে শ্যামবাজারের বসু পরিবারের সদস্য হুগলির দেওয়ান কৃষ্ণচন্দ্র বসু রথটি তৈরি করিয়ে দিয়েছিলেন। রথটিতে রয়েছে মোট ১২টি লোহার চাকা এবং দু'টি তামার ঘোড়া। ইতিহাস বলে সাধক ধ্রুবানন্দ ব্রহ্মচারী স্বপ্ন পেয়ে গঙ্গায় ভেসে আসা নিমকাঠ দিয়ে দারুমূর্তি তৈরি করেন। প্রতি বছর রথের আগে বিগ্রহের অঙ্গরাগ হয়ে থাকে। রথের দিন জিটি রোড দিয়েই রথ টানা হয়। এই রথযাত্রাকে কেন্দ্র করে আজও বসে মেলা। বিশেষ উল্লেখযোগ্য, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়-এর 'রাধারাণী' উপন্যাসের প্রেক্ষাপট ছিল এই মাহেশের রথযাত্রা।[৫]
রথ পরিবর্তন
আধুনিক মন্দির ১৭৫৫ সালে নির্মাণ করা হয়। কলকাতা নিবাসী নয়নচাঁদ মল্লিক এর খরচ দেন।একবার বৈদ্যবাটীর একজন ভক্ত মন্দিরে রথ দান করেছিলেন। ১৭৯৭ সালে শ্রী রামকৃষ্ণের বিখ্যাত শিষ্য বলরাম বসুর দাদা কৃষ্ণরাম বসু আরেকটি রথ দান করেছিলেন। সময়ের সঙ্গে সেই রথ জীর্ণ হয়ে পড়ে। কৃষ্ণরামের ছেলে গুরুপ্রসাদ ১৭৯৮ সালে নয় চূড়াবিশিষ্ট নতুন রথ বানিয়ে দেন। ১৮৮৪ সালে রথযাত্রার দিন বল্লভপুরে গুন্ডিচাবাটিতে সেই রথটি আগুনে পুড়ে যায়। তখন বসু পরিবারেরই কর্তা কৃষ্ণচন্দ্রবাবু বর্তমান লোহার রথটি তৈরি করিয়ে দেন। মার্টিন বার্ন কোম্পানি রথটি তৈরি করে। সেই সময়েই এর দাম পড়েছিল ২০ লক্ষ টাকা। ১৮৮৫ সাল থেকে ওই রথে টান শুরু হয়। সেই থেকে এক ভাবে ওই রথ চলছে।[৬]
বর্তমান রথ
৫০ ফুট রথ ১২টি লোহার চাকা হয়েছে। রথ ঐতিহ্যগত বাংলা নবরত্ন শৈলী, এতে ৯ টি চূড়া রয়েছে (কিছু বছর পূর্বে ছিল ১৩ টি)।
রথযাত্রার পথ
রথযাত্রার দিন বিকেলবেলা (প্রায় সাড়ে তিনটে নাগাদ) স্নানপিড়ি ময়দানের সামনে থেকে জিটি রোড ধরে ১ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে মাসিরবাড়ির মন্দিরে রথ পৌছায়। সাথে লক্ষ লক্ষ দর্শনার্থী উপস্থিত থাকায় প্রায় ২ ঘণ্টা সময় লাগে মাসিরবাড়ি যেতে। আবার ৮ দিন পর পূণঃযাত্রা বা উল্টোরথের দিন ঐ পথেই রথ স্নানপিড়ি ময়দানে ফিরে আসে। উল্টোরথে দর্শনার্থীদের সংখ্যা বেশি থাকায় রথ এসে থামতে থামতে সন্ধ্যা প্রায় সাড়ে ৬টা বেজে যায়।
রথযাত্রা ও মেলা
নেই শুধু এই উৎসব প্রাচীনতম কিন্তু বাংলায় সর্ববৃহৎ রথযাত্রা হয়। প্রায় ২-৪ লাখ মানুষ মাসব্যাপী মেলা দেখতে আসে। প্রভু মাহেশ গুন্ডিচা বাটী (মাহেশ মাসীর বাড়ী) মন্দিরে যায় এবং হিসাবে এটি জনপ্রিয় বাংলায় পরিচিত রথ পুনযাত্রা বা উল্টোরথ পর্যন্ত সেখানে রয়ে যায়।
[৪] উপন্যাসের নায়িকা রাধারাণী মেলায় হারিয়ে যায় এবং তারপর তার ভবিষ্যত প্রেমিক দ্বারা প্রাপ্ত হয়। বঙ্কিম -এর বর্ণনায় শুধুমাত্র উৎসবের একটি প্রাণবন্ত ছবি দেয় না সাথে মেলাকে ন্যায্য একটি রোমান্টিক আকর্ষণও দেয়। এমনকি আজও সেই ভগ্নান্তঃকরণ মেয়েটির মনের দুঃখ সবাই বোধ করতে পারবে।