মার্কা বা ব্র্যান্ড হচ্ছে একটি নাম, একটি পরিচিতিজ্ঞাপক শব্দগুচ্ছ (term), একটি স্মারকচিহ্ন (sign), একটি প্রতীক (symbol) এবং নকশা (পরিকল্পনা) কিংবা এই সবগুলির একটি সুসমন্বিত রূপ যা কোনো বিক্রেতা বা বিক্রেতাগোষ্ঠীর পণ্য ও সেবার নিজস্ব পরিচিতি গড়ে তোলে এবং প্রতিযোগীদের চেয়ে নিজেদেরকে আলাদাভাবে উপস্থাপন করে।[১] মূলত একটি মার্কা হচ্ছে কোনো বিক্রেতার ধারাবাহিতভাবে স্বকীয় বৈশিষ্ট্যমণ্ডিত পণ্য ও সেবা ক্রেতার কাছে পৌঁছে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি। তবে একটি সেরা মার্কা হতে হলে অবশ্যই পণ্য বা সেবার গুণমানের নিশ্চয়তা থাকতে হবে। ব্যবসায়, বাজারজাতকরণ এবং বিপণন সংক্রান্ত কার্যাবলীতে মার্কাের বহুল ব্যবহার লক্ষনীয়।
হিসাববিজ্ঞান অনুসারে মার্কাকে 'অলীক সম্পত্তি' হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যেটি অনেকক্ষেত্রে একটি কোম্পানির উদ্বৃত্তপত্রের খুব মূল্যবান সম্পত্তি হিসেবে স্বীকৃত। মার্কা মূল্যায়ন (Brand valuation) অত্যন্ত তাৎপর্য্যপূর্ণ ব্যবস্থাপকীয় কৌশল যার মাধ্যমে কোন মার্কার আর্থিক মূল্য নিরূপণ করা হয়। এটি শেয়ারগ্রাহকদের মূল্য বৃদ্ধির জন্য বিপণনসংক্রান্ত বিনিয়োগ সঠিকভাবে পরিচালনায় সাহায্য করে।
ইতিহাস
মার্কা শব্দটির ইংরেজি অনুবাদ Brand-এর উৎপত্তি ঘটেছে 'Brandr' শব্দটি থেকে যার অর্থ হচ্ছে 'পোড়ানো'।[২] প্রাথমিক পর্যায়ে, গবাদিপশুর মালিকগণ তাদের নিজ নিজ পশুকে অন্যান্য মালিকের পশুর চাইতে আলাদাভাবে সনাক্ত করার সুবিধার্থে খাঁজকাটা ধাতব বস্তু পুড়িয়ে তা দিয়ে পশুর শরীরে একটি মার্ক বা চিহ্ন বসিয়ে দিতেন।
প্রাচীনতম মার্কার উদাহরণটি খুঁজে পাওয়া যায় ভারতে বৈদিক যুগে (খৃষ্টপূর্ব ১১০০ সন- খৃষ্টপূর্ব ৫০০ সন), যেটি ছিলো 'চয়নপ্রাস' নামক একটি ভেষজ বাটা।[৩] ১৩শ শতাব্দীতে ইতালীয়রা কাগজের ওপর জলছাপ আঁকার মাধ্যমে মার্কা ব্যবহার শুরু করে।[৪] প্যাকেটজাত পণ্য এবং শিল্পায়নের প্রভাবে বিপণন খাতে মার্কার ব্যবহার শুরু হয় উনিশ শতকে। এসময় বিভিন্ন গৃহস্থালি পণ্যের উৎপাদন ব্যবস্থাকে বড় বড় কেন্দ্রে স্থানান্তর করে ফেলা হয়।
'Bass & Company' নামক একটি ব্রিটিশ কোম্পানি দাবি করে তাদের লাল এবং ত্রিভুজাকৃতির মার্কাটিই বিশ্বের প্রথম নিবন্ধীকৃত ব্যবসায়িক মার্কা বা ট্রেডমার্ক। 'Tate & Lyel'ও নিজেদের মার্কাকে বিশ্বের প্রথম ট্রেডমার্ক হিসেবে দাবি করেছে যেটি গিনেস বুক অফ ওয়ার্ল্ড রেকর্ড কর্তৃক স্বীকৃত।[৫]
ধারণাসমূহ
মার্কাকরণ কৌশলকে সফল হতে হলে এবং মার্কার মূল্য সৃষ্টি করতে হলে ভোক্তাদেরকে অবশ্যই বোঝাতে হবে যে বিভিন্ন ধরনের মার্কার পণ্য ও সেবার মধ্যে যথেষ্ট পরিমাণ পার্থক্য বিদ্যমান। মার্কাসমূহের মধ্যকার পার্থক্যটি অনেকসময় পণ্যের বিবিধ বৈশিষ্ট্য এবং উপকারিতার ওপর নির্ভর করে।[৬] জিলেট, থ্রি-এম, মার্ক, এবং অন্যান্য অনেক মার্কা প্রতিনিয়ত উদ্ভাবনী শক্তিকে কাজে লাগিয়ে নিজ নিজ পণ্য খাতে শ্রেষ্ঠত্ব অর্জন করেছে। আবার অনেক প্রতিষ্ঠান পণ্য ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ওপর গুরুত্বারোপ করে প্রতিযোগিতায় শ্রেষ্ঠ হয়েছে। এই বিষয়গুলোর মধ্যে রয়েছে ভোক্তার উৎসাহটি কোথায় তা বুঝতে পারা এবং পণ্যের ভেতরে সেই উৎসাহের সাথে সম্পর্কযুক্ত একটি অবয়ব বা ইমেজ সৃষ্টি করা।
মার্কার উপাদান
একটি মার্কা সাধারণত অনেকগুলো উপাদান নিয়ে গঠিত হয়। এর মধ্যে রয়েছেঃ
নাম: যেই শব্দ বা শব্দগুচ্ছ দ্বারা কোম্পানি, পণ্য, সেবা ইত্যাদিকে প্রকাশ করা হয়ে থাকে।
লোগো: যেই ট্রেডমার্কটি দিয়ে মার্কাকে চিহ্নিত করা হয়।
ট্যাগলাইন: একটি শব্দগুচ্ছ যা মার্কাটি কি বা কীভাবে কাজ করে তা সম্পর্কে ক্রেতা বা ভোক্তাকে ধারণা প্রদান করে এবং ক্রয় করতে উৎসাহ প্রদান করে।
গ্রাফিক্স/অলংকরনঃ একটি মনকাড়া গ্রাফিক্স বা অলংকরণ সহজেই মার্কাকে আকর্ষনীয় করে তুলতে পারে।
রং: উদাহরণ- কোম্পানিগুলো প্রায়শই নিজেদের বিজ্ঞাপনে, পণ্যের মোড়কে অনন্য একটি রঙ ব্যবহার করে। গ্রামীণ ফোনের নীল রঙ, বাংলালিংকের কমলা বর্ণ।
শব্দ/সুর: মার্কাকে পরিচিত করানোর জন্য বা মনে করিয়ে দেবার জন্য অনেকসময় একটি নির্দিষ্ট সুর ও সংগীত ব্যবহৃত হয়।
গন্ধ
স্বাদ
ক্রেতার সাথে সম্পর্কের ব্যবস্থাপনা
মার্কা সচেতনতা
মার্কা সচেতনতা (Brand Awareness) হলো একজন ক্রেতা বা ভোক্তার পক্ষে মার্কাটিকে মনে করতে পারার বা চিনতে পারার ক্ষমতা এবং সেই মার্কাের নাম, লোগো, সুর প্রভৃতি দেখা বা শোনা মাত্রই মস্তিষ্কে কোন একটি বিশেষ অনুভূতির সঞ্চার ঘটা। এটি ক্রেতাকে বুঝতে সাহায্য করে যে মার্কাটি ঠিক কোন ধরনের পণ্যের ক্যাটাগরিতে পড়ে। এর মাধ্যমে ভোক্তা এও বুঝতে পারে যে, মার্কাটি তার কোন প্রয়োজনীয়তাটি মেটাবে এবং কি ধরনের সেবা প্রদান করবে।
মার্কার চলকসমূহ
মার্কা নাম
"মার্কা নাম" (Brand name) প্রায়শই "মার্কা" শব্দের বিকল্পে ব্যবহৃত হয়ে থাকে, যদিও "মার্কা নাম" হল কোন একটি মার্কার লিখিত বা কথ্য রূপ। মার্কা নাম একটি ট্রেডমার্ক হিসেবেও কাজ করে, যেহেতু এটি কোন পণ্য বা সেবাকে নির্দিষ্ট একজন উৎপাদনকারীর বা মালিকের স্বত্বাধীন হিসেবে পরিচিত করায়।
মার্কা পরিচয়
কোন একটি মার্কাের পরিচয় (Brand identity) হচ্ছে সেই মার্কার বাহ্যিক প্রকাশসমূহ যার মধ্যে রয়েছে- নাম, লোগো, ডিজাইন, ট্রেডমার্ক, চাকচিক্য।[৭]
মার্কা প্যারিটি
একজন ক্রেতা যখন উপলব্ধি করে যে কিছু মার্কা আসলে সমপর্যায়ের বা একই প্রকারের তখন তাকে বলা হয় মার্কা প্যারিটি। মার্কা প্যারিটি যখন বিদ্যমান হয়, ক্রেতারা তখন পণ্যের গুনগত মানকে প্রাধান্য দেয় না। কারণ তারা মনে করে এই পণ্যগুলো সমমানসম্পন্ন বা একই ধরনের সেবা প্রদান করবে।[৮]
মার্কা স্বত্বাধিকার মূল্য
মার্কা স্বত্বাধিকার মূল্য (Brand equity) হলো একটি মার্কার পণ্য ও সেবাসমূহের কার্যকারিতা, পছন্দনীয়তা ও সুনামের ওপর ভিত্তিকে করে যে মূল্যটি নির্দিষ্ট করা হয়। 'ক্রেতানির্ভর মার্কা স্বত্বাধিকার মূল্য' (Customer-based Brand Equity) হলো একজন ক্রেতা মার্কার ব্যাপারে জ্ঞান থাকার সুবাদে ওই মার্কার বিপণনে তার সাড়া কতখানি পরিবর্তিত হয় সেটি।[৯]
↑Paul S. Richardson, Alan S. Dick and Arun K. Jain "Extrinsic and Intrinsic Cue Effects on Perceptions of Store Brand Quality", Journal of Marketing October 1994 pp. 28-36