মরেন হিগা ম্যাগি (পর্তুগিজ: Maurren Maggi; জন্ম: ২৫ জুন, ১৯৭৬) সাঁও কার্লোসে এ জন্মগ্রহণকারী ব্রাজিলের বিখ্যাত মহিলা ট্র্যাক ও ফিল্ড অ্যাথলেট। অলিম্পিকেস্বর্ণপদক লাভ করেছেন তিনি। ১০০ মিটার হার্ডলস ও দীর্ঘ লম্ফে যথাক্রমে ১২.৭১ সেকেন্ড ও ৭.২৬ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার বর্তমান রেকর্ডধারী তিনি। এছাড়াও, ট্রিপল জাম্পে ১৪.৫৩ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে দক্ষিণ আমেরিকার রেকর্ড গড়েছিলেন। ব্রাজিলের প্রথম প্রমিলা অ্যাথলেট হিসেবে ব্যক্তিগত পর্যায়ের ক্রীড়ায় অংশ নিয়ে অলিম্পিকে স্বর্ণপদক জয় করেন মরেন ম্যাগি।[১]
প্রারম্ভিক জীবন
রুথ ও উইলিয়াম দম্পতির কন্যা তিনি। বিটলসের প্রতি পিতার অকুণ্ঠ ভালাবাসা থেকে তার নামকরণ হয়। ড্রামারের স্ত্রী স্টার, মরেন কক্স থেকেও এ নামে অক্ষর সংযুক্ত ঘটান। কিন্তু একটি শব্দে নাম নিবন্ধনে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল।[১] ফলে তার নামে দু'টি 'আর' ও 'ই' যুক্ত করতে হয়েছে।[২] উইলিয়াম ও জেফারসন নামীয় তার আরও দুই ভাই রয়েছে।[৩]
শৈশবকালে তিনি খেলনা পশু-পাখি ভালবাসতেন।[৪] সাত বছর বয়সে ভলিবল, সাঁতার, জিমন্যাস্টিকস, টেবিল টেনিস ও দাবার ন্যায় বিভিন্ন খেলাধূলায় সম্পৃক্ত হন। কিন্তু রাজ্য প্রতিযোগিতায় অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিয়ে নিজেকে জড়িয়ে ফেলেন। ১৯৯৪ সালে ১৭ বছর বয়সে প্রযুক্তিবিদ দম্পতি নেলিও মোরা এবং তার স্ত্রী তানিয়ার সাথে কুবাতাওয়ের প্রতিযোগিতায় স্বাক্ষাৎ ঘটলে মরেনের জীবন পাল্টে যায়।[৫]
সাঁও পাওলো সরকারের গৃহীত ক্রীড়া উদ্যোগ ফিউচার আইবিরাপুরা প্রকল্পে অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে একাকী নিজ গৃহ ত্যাগ করেন। সেখানে তিনি প্রযুক্তিবিদ দম্পতির পরিচালনায় ও এডিসি-ইলেক্ট্রোপাওলো দলের তত্ত্বাবধানে আবাসন এবং প্রশিক্ষণ গ্রহণ করতে থাকেন।[৬]
১৫জনেরও অধিক মহিলা অ্যাথলেটের উপযোগী একটি বড় কক্ষে বসবাস করতে থাকেন। সেখানে তিনি স্থান, সহকর্মীদের দৃষ্টিভঙ্গীসহ পারিবারিক সান্নিধ্যের অভাব বোধ করতে থাকেন। এ সময়ে 'বালিকা সমস্যা' নামের একটি দল এ সমস্যাগুলোকে আরও বাড়িয়ে তোলে ও নিয়মানুবর্তীতাবিহীন অবস্থার পরিবেশ সৃষ্টি করতে তৎপর হয়। প্রিয় বান্ধবীকে হাসপাতালে ভর্তি করানোর পর তাকেও নেকড়ে মুখোশ দেখিয়ে ভয় দেখায়। ফলে মরেন স্নায়ুবৈকল্যে ভুগতে থাকেন।[৭]
আইবিরাপুরায় প্রশিক্ষণ শেষ হবার ফলে বছরের শেষে বালিকাদেরকে জোরপূর্বক স্বগৃহে ফেরত পাঠানো হয়। কিন্তু ম্যাগিসহ কয়েকজন অ্যাথলেট তাদের প্রশিক্ষণ অব্যাহত রাখতে চেয়েছিলেন।[৫]
সাঁও পাওলোতে ফিরে আসার প্রথম বছরেই প্রত্যাশার চেয়েও অধিক ক্রীড়াশৈলী উপস্থাপন করেন তিনি। ব্রাজিলীয় চ্যাম্পিয়নের শিরোপাসহ যুবদের দক্ষিণ-আমেরিকান দীর্ঘলম্ফ ও ১০০ মিটার হার্ডলসে দক্ষিণ-আমেরিকান চ্যাম্পিয়ন হন তিনি।[৬]
খেলোয়াড়ী জীবন
১৯৯৬ সালে অ্যাথলেটিক্সে পেশাদারী পর্যায়ের খেলায় অংশ নেন। বিএম এন্ড এফ অ্যাথলেটিক্স দলে কোচের সাথে তারও খেলোয়াড়ী জীবন শুরু হয়। ঐ বছর তিনি ৬.৪৭ মিটার দূরত্ব পাড়ি দিয়ে সেরা ব্রান্ড জাম্পের অধিকারী হন। ১৯৯৯ সালে মালোর্কায় অনুষ্ঠিত ইউনিভার্সিয়াড গেমসে ব্রোঞ্জপদক লাভ করে আন্তর্জাতিক তারকায় পরিণত হন। অল্প কিছুদিন পর কলম্বিয়ার বোগোতায় অনুষ্ঠিত দক্ষিণ আমেরিকান অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপের দীর্ঘলম্ফ বিষয়ে ৭.২৬ মিটার দূরত্বে অতিক্রম করে বিশ্বের বর্ষসেরা ব্রান্ড জাম্প দেন[৮] ও নতুন ব্রাজিলীয় রেকর্ড স্থাপন করেন। এটি দীর্ঘলম্ফের ইতিহাসে নবম সেরা নৈপুণ্য ছিল। এছাড়াও, ১৯৯৯ সালে উইনিপেগ, ২০০৭ সালে রিও এবং ২০১১ সালের গুয়াদালাজারায় অনুষ্ঠিত প্যান আমেরিকান গেমসের তিন আসরের একই বিষয়ে চ্যাম্পিয়ন তিনি।
এরপর ১৯৯৯ সালে উইনিপেগে অনুষ্ঠিত প্যান-আমেরিকান গেমসে স্বর্ণপদক লাভ করেন যা ঐ প্রতিযোগিতায় নিজস্ব প্রথম শিরোপা। একই খেলায় তিনি ১০০ মিটার হার্ডলসে দ্বিতীয় স্থান দখল করে রৌপ্যপদক লাভ করেন।[৮] জাতীয় পর্যায়ে পরিচিত লাভ করেন ও উইনিপেগের পদক বিতরণের মঞ্চে উঠার দৃশ্য টেলিভিশনে সম্প্রচারের পর ব্যাপক জনপ্রিয়তা পান। তখন তার নখে সবুজ ও হলুদ রঙ ছিল। এছাড়াও বাহুতে টেডি বিয়ার ছিল।[৯]কানাডীয় শহরেও তিনি জয় পান। এখানেই ম্যাগি প্রথমবারের মতো ব্রাজিলের পূর্ণাঙ্গ সদস্যরূপে বিদেশ ভ্রমণ করেন যা তার জীবনকে পরিবর্তন করতে শুরু করে। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,[৪]
উইনিপেগে সবকিছুই আমার কাছে নতুন বলে মনে হচ্ছিল। প্রতিযোগিতার পর আমি ব্রাজিলে খ্যাতনামা ব্যক্তিত্বে পরিণত হই। শিল্পী, অভিনেতা এবং তারকা শিল্পীদের সাথে পরিচিত হই যা পূর্বে তাঁদের সাথে পরিচিত হবার সুযোগ পাইনি।
১৯৯৯ সালে স্পেনের সেভিলেতে অনুষ্ঠিত বিশ্ব অ্যাথলেটিকস চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে ৮ম স্থান অধিকার করেন। ১৯৯৯ সালের শেষে ব্রাজিলিয়ান অলিম্পিক কমিটি প্রদত্ত বর্ষসেরা অলিম্পিক ক্রীড়া অ্যাথলেটের শীর্ষ পুরস্কার গ্রহণ করেন তিনি।[১০]
২০০০ সালের মাঝামাঝি সময়ে বর্তমানের ইউনিয়ন স্পোর্টিভ ফানিলেন্স-সিআর ভাস্কো দা গামা দলে যোগ দেন।[১১] ইউরোপের প্রতিযোগিতাগুলোয় তিনি প্রায় সাত মিটারের কাছাকাছি লাফ দিতেন। ২০০০ সালে সিডনিতে স্বর্ণপদক জয় করে বিখ্যাত হন। তার এই প্রথম অলিম্পিক গেমসে প্রথম লাফ দেবার পর উরুতে আঘাতপ্রাপ্ত হন ও ক্রন্দনরত অবস্থায় প্রতিযোগিতা স্থল ত্যাগ করতে বাধ্য হন। তার ভাষায়[৪] -
আমি আমার জীবনের সেরা মুহূর্তে অবস্থান করছিলাম যা উইনিপেগের চেয়েও সেরা ছিল। আমি কল্পনাও করতে পারিনি যে, আমার জীবনে এমনটি ঘটতে পারে। আমি ঐ লাফটি কখনো টেলিভিশনে দেখতে চাইবো না।
মে, ২০০১ সালে শারীরিকভাবে সুস্থ হয়ে ১২.৭১ সেকেন্ডে ১০০ মিটার হার্ডলসের বাঁধা অতিক্রম করে নতুন দক্ষিণ আমেরিকান রেকর্ড গড়েন।[১২]মানাউসে অনুষ্ঠিত বিতর্কিত দক্ষিণ আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ অ্যাথলেটিক্সে অংশ নিয়ে দীর্ঘ লম্ফে স্বর্ণপদক এবং ২০০১ সালে বেইজিংয়ে অনুষ্ঠিত গ্রীষ্মকালীন ইউনিভার্সিয়াড গেমসের হার্ডলসে রৌপ্যপদক লাভ করেন তিনি।[১৩]
২০০২ সালকে তিনি তার খেলোয়াড়ী জীবনের সেরা বছররূপে আখ্যায়িত করেছেন।[৪] ধারাবাহিকতা ও দৃঢ়তার সাথে গুয়াতেমালা সিটিতে অনুষ্ঠিত আইবেরো-আমেরিকান চ্যাম্পিয়নশিপ জয় করেন। প্যারিসে শেষ হওয়া অষ্টাদশ আইএএএফ গ্রাঁ প্রিতে ৭.০২ মিটার দূরত্ব অতিক্রমণ করে বছরের সেরা ক্রীড়াশৈলী উপহার দেন।[১৪] মাদ্রিদে অনুষ্ঠিত ২০০২ সালের বিশ্বকাপ অ্যাথলেটিক্সে রৌপ্যপদক জয় করেন। ইউরোপীয় মৌসুমে অংশগ্রহণকালে কয়েকমাস নেদারল্যান্ডসে বসবাস করতে হয়েছে তাকে।[৪]
২০০৩ সালে ১৪.৫৩ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে ট্রিপল জাম্পে দক্ষিণ-আমেরিকান রেকর্ড গড়েছিলেন। মার্চ, ২০০৩ সালে যুক্তরাজ্যের বার্মিংহামে অনুষ্ঠিত আইএএএফ বিশ্ব ইনডোর অ্যাথলেটিক্স চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়ে দীর্ঘলম্ফে ব্রোঞ্জপদক পান তিনি।[১] তিনি ৬.৭০ মিটার দূরত্ব অতিক্রমে সক্ষম হন। মিলানে অনুষ্ঠিত একটি প্রতিযোগিতায় ৭.০৬ মিটার স্পর্শ করে পুনরায় বিশ্বের ১নং খেলোয়াড়ের মর্যাদা পান।[৮] এরপূর্বে এপ্রিলে মরেন একই সময়ে তিনটি নতুন দক্ষিণ আমেরিকান রেকর্ডের জন্ম দেন। ৯০-এর দশকের শেষদিকে ট্রিপল জাম্পে অংশ নিতে আগ্রহী ছিলেন যা তার ক্রীড়া আদর্শ আদেমার ফেরেইরা দা সিলভার কাছ থেকে আহুত ছিল।[১৫]
ঐ সময়ে তিনি বিনম্রভাবে খেলে শতাব্দীর সেরা দ্বৈত অলিম্পিক চ্যাম্পিয়নধারীকে উৎসর্গ করে নিজেকে প্রমাণিত করতেন যা বেশ চিত্তাকর্ষক ফলাফল এনে দিত। এপ্রিল, ২০০৩ সালে সাঁও কায়েতানো দো সালে অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতায় ১৪.৫৩ মিটার দূরত্বে লাফান ও এ বিষয়ের ক্রীড়ায় নতুন দক্ষিণ-আমেরিকান রেকর্ড গড়েন। এরফলে একই সময়ে ব্রাজিলীয় ও দক্ষিণ-আমেরিকান রেকর্ডধারী হন যিনি ট্রিপল জাম্প, দীর্ঘলম্ফ ও ১০০ মিটার হার্ডলসের শিরোপা জয়ী ছিলেন।
২০০৮ সালের অলিম্পিকে দীর্ঘলম্ফে ৭.০৪ মিটার দূরত্ব অতিক্রম করে স্বর্ণপদক লাভ করেছেন তিনি। ২০০৯ সালে ত্রয়ো ব্রাসিল কাইজা দ্য আতলেতিসমো থেকে কেইলা কোস্তা পর্যন্ত অনুষ্ঠিত প্রতিযোগিতাসমূহ দ্বিতীয় স্থান দখল করেন। এরফলে, ১৯৯৮ সালের পর প্রথমবারের মতো স্থানচ্যূত হন তিনি।[১৬]
প্রায় বিশ বছরের পেশাদারী খেলোয়াড়ী জীবনের সাথে জড়িত ছিলেন তিনি। কিন্তু ২০০৩ সালে মরেন নিষিদ্ধ মাদকদ্রব্য গ্রহণ করে কেলেঙ্কারীতে জড়িয়ে পড়েন। ফলশ্রুতিতে ডোপিংয়ের অভিযোগে আইএএএফ কর্তৃক তাকে দুই বছরের জন্য খেলাধূলায় অংশগ্রহণে নিষেধাজ্ঞা প্রদান করা হয়। এরফলে ২০০৩ সালের প্যান আমেরিকান গেমসে অংশগ্রহণ করা থেকে বঞ্চিত হন। পরবর্তীতে নিষিদ্ধ মাদক গ্রহণের অভিযোগ থেকে ব্রাজিলের ক্রীড়া আদালত তাকে মুক্তি দেয়।[১৭] এছাড়াও, গর্ভধারণের ফলে অলিম্পিক গেমসে অংশগ্রহণ করতে পারেননি তিনি।[১৮]
সম্মাননা
তিনি দুইবার ১৯৯৯[১৯] ও ২০০৩ সালে দীর্ঘলম্ফে বিশ্বের ১নং মহিলা ছিলেন।[২] ১৯৯৯ সালে খেলাধূলার ইতিহাসে ৭.২৬ মিটার লাফ দিয়ে নবম সেরা অ্যাথলেট মনোনীত হয়েছিলেন।[২০] এছাড়াও ব্রাজিলীয় অলিম্পিক কমিটি কর্তৃক দুইবার বর্ষসেরা ক্রীড়াবিদের পুরস্কার লাভ করেন তিনি।[১০] এপ্রিল, ২০১৫ সালে বছর শেষে তার খেলোয়াড়ী জীবন শেষ করার কথা ঘোষণা করেন। এরপর পেশাদার টেলিভিশন ভাষ্যকাররূপে তিনি অ্যাথলেটিক্সের আসরে থাকার ইচ্ছা ব্যক্ত করেন।
ব্যক্তিগত জীবন
ডিসেম্বর, ২০০৪ সালে ফর্মুলা ওয়ানের সাবেক পাইলট অ্যান্টোনিও পিজোনিয়ার সাথে সম্পর্কের ফলে সোফিয়া নাম্নী এক কন্যা সন্তানের জন্ম হয়।[২১] তিনি মোনাকোয় বসবাস করতেন।[২২] পরবর্তীতে তাদের মধ্যকার সম্পর্ক ভেঙ্গে যায় ও ২০০৬ সালে বিবাহ-বিচ্ছেদ ঘটে।[২৩] কন্যার ভবিষ্যতের কথা চিন্তা করে তিনি পুনরায় অ্যাথলেটিক্সের জগতে ফিরে আসেন।[১৭]