বালীয় জাতির উদ্ভব তিনটি পর্যায়ের অভিবাসনের ফলাফল। প্রথম অভিবাসন হয়েছিল প্রাগৈতিহাসিক কালে তৎকালীন যবদ্বীপ ও কালিমান্তান দ্বীপ থেকে, এরা ছিলেন আদি-মালয় জনগোষ্ঠী।[৪] বালিতে জাভা থেকে খুব মন্থরগতিতে দ্বিতীয় অভিবাসন হয়েছিল হিন্দু রাজত্বকালে। তৃতীয় এবং চূড়ান্ত অভিবাসন পঞ্চদশ এবং ষোড়শ শতাব্দীর মধ্যে জাভা থেকে হয়। এই সময়ে জাভাতে হিন্দু বিল্বতিক্ত বা মজাপহিৎ সাম্রাজ্যের পতন ও ইসলামিক মাতারাম সাম্রাজ্যের উত্থান ঘটলে ও ইসলাম ধর্মে গণধর্মান্তরণ দেখা দিলে অভিজাত ও কৃষকরা ধর্মান্তরণ ও অত্যাচারের হাত থেকে বাঁচার জন্য বালিতে পালিয়ে যায়। এর ফলে বালীয় প্রাচীন সংস্কৃতির সংমিশ্রণ ঘটে, ধ্রুপদী জাভাই সংস্কৃতির সাথে বহু বালীয় উপাদানের সমন্বয়ে তৈরি হয় নতুন সংস্কৃতি।[৫]
২০০৫ খ্রিস্টাব্দে কারাফেত ও তার সঙ্গীগণের করা ডিএনএ পর্যালোচনায় পাওয়া ফলাফল অনুযায়ী বালির জিনপুলে ওয়াই ক্রোমোজোম-এর ১২% ভারতীয়, ৮৪% অস্ট্রোনেশীয় ও ২% মেলানেশীয় সদৃশ। [৬] সাম্প্রতিক একটি জেনেটিক সমীক্ষা অনুসারে, জাভাই, সুন্দানিদের সাথে বালীয়দেরও অস্ট্রোনেশীয় এবং অস্ট্রোএশিয়াটিক জিনগত মার্কারের ধরন প্রায় সমান অনুপাত রয়েছে।[৭]
বালীয় সংস্কৃতি হল বালির হিন্দু-বৌদ্ধ ধর্ম ও বালীয় রীতিনীতির মিশ্রণ। এই সংস্কৃতির পরিচিতি এর নৃত্য, নাটক ও মূর্তিকল্পের জন্য। বালিদ্বীপের ছায়া নাটক বেশ চর্চিত, স্থানীয়ভাবে এটি ওয়াজাং কুলিত বা ওয়ায়াং কুলিত নামে পরিচিত। এমনকি গ্রামীণ এলাক ও দূরবর্তী গ্রামেও সুন্দর দর্শন মন্দির একটি সাধারণ দৃশ্য এবং তাতে দক্ষ গেমলান খেলোয়াড় এবং প্রতিভাবান অভিনেতারা অনুষ্ঠান করে থাকে।[৮] এমনকি খেজুর পাতার স্তরযুক্ত টুকরোর সজ্জা ও বালির মহিলাদের দ্বারা প্রসাদ হিসাবে তৈরি ফল সাজানোর অনন্য পদ্ধতি তাদের শৈল্পিক গুণ ফুটিয়ে তোলে।[৯] মেক্সিকান শিল্প ইতিহাসবিদ জোসে মিগুয়েল কোভারুবিয়াস-এর মতে, অপেশাদার বালীয় শিল্পীদের দ্বারা তৈরি শিল্পকর্মগুলিকে আধ্যাত্মিক নৈবেদ্য হিসাবে গণ্য করা হয় এবং সেইজন্য এই শিল্পীরা তাদের কাজের স্বীকৃতির বিষয়ে চিন্তা করেন না।[১০] বালীয় শিল্পীরা চৈনিক শিল্পকর্মের অনুরূপ দেবদেবীর মূর্তি, বিদেশি ম্যাগাজিনে ছাপা সজ্জাযুক্ত ধ্রুপদী বাহনের অনুকরণ করতে বেশ পারদর্শী।[১১]
বালির ঐতিহ্যগত বিভিন্ন গান ও নৃত্য প্রদর্শনের সময় গামেলান ব্যবহার করা বালীয় সংস্কৃতির বৈশিষ্ট্য।প্রতিটি ধরনের সঙ্গীত একটি নির্দিষ্ট ধরনের অনুষ্ঠানের জন্য নির্দিষ্ট ও অনন্য। উদাহরণস্বরূপ বলা যায়, জন্মদিন উদযাপন বা পোইদালান-এর সময় যে ধরনের গান গাওয়া হয় অন্নপ্রাশন বা মেতাতাহ-এর সময়, মৃতদেহ সৎকার বা নগাবেন-এর সময় থেকে শুদ্ধিকরণ বা মেলাস্তি-র সময়ে আলাদা আলাদা ধরনের গান হয়ে থাকে।[১২] বালিতে বিভিন্ন ধরনের নাচের জন্যও আলাদা আলাদা ধরনের গামেলান উপলব্ধ। ওয়াল্টার স্পাইস-এর মতে, নৃত্যশিল্প বালিবাসীর জীবনের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ এবং সেইসাথে বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান বা ব্যক্তিগত স্বার্থের জন্য একটি সর্বাধিক প্রচলিত বিনোদনমূলক উপাদান।[১৩]
ঐতিহ্যগতভাবে, নারীর স্তন প্রদর্শনকে অশালীন বলে মনে করা হয় না। বালির মহিলাদের প্রায়ই বক্ষাবরণ বাদে দেখা যায় তবে ঊরু প্রদর্শন অশালীন বলে মনে করা হয়। আধুনিক বালিতে, এই রীতিনীতিগুলি সাধারণত কঠোরভাবে পালন করা হয় না, তবে বালির মন্দিরগুলিতে দর্শনার্থীদের তাদের পা ঢেকে রাখার পরামর্শ দেওয়া হয়।
বালির নবজাতকের নামকরণের তার জন্মের ক্রম এবং বর্ণ প্রথা স্পষ্ট।[১৪]
পুপুতান হল যুদ্ধক্ষেত্রে পরাজয় নিশ্চিত মনে করে গণ আত্মহত্যা করা। বালিতে ওলন্দাজ হস্তক্ষেপের সময় উল্লেখযোগ্য এবং সম্ভবত প্রথম পুপুতান সংঘটিত হয়। ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা যুদ্ধের সমসাময়িক মার্গরনার যুদ্ধে লেফটেন্যান্ট কলোনেল আই গুস্তি নাগুরাহ রাইয়ের সর্বাধিনায়কত্বে শেষ পুপুতান হয়। বালির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর তার নামেই নামাঙ্কিত।[১৫]
বালীয়দের অধিকাংশই আগম তীর্থ তথা "পবিত্র-জলের ধর্ম"তে বিশ্বাস করেন। এটি হিন্দুধর্মের একটি অংশ। ভ্রমণকারী ভারতীয় পুরোহিতরা বহু শতাব্দী আগে মানুষকে হিন্দু ও বৌদ্ধ ধর্মের পবিত্র সাহিত্য ও ধর্মগ্রন্থের সাথে পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলেন বলে জানা যায়। স্থানীয় লোকেরা তা গ্রহণ করে এবং তাদের নিজস্ব প্রাক-হিন্দু পুরাণের সাথে এটিকে একত্রিত করে রীতিনীতি পালন করতে থাকেন।[১৬] অভিবাসনের তৃতীয় তরঙ্গের আগে বালিতে বসবাসকারী বালীয়রা বালি আগা নামে পরিচিত ছিলেন, তাদের বেশিরভাগই আগম তীর্থের অনুসারী নন, বরং তারা তাদের নিজস্ব সর্বপ্রাণবাদী ঐতিহ্য বজায় রাখেন।
ভেজামাটিতে ধান চাষ বালির খাদ্য উৎপাদনের একটি প্রধান ভিত্তি ও কৃষিজ পণ্য। এই কৃষি ব্যবস্থা অত্যন্ত জল নির্ভর ফলে বালিতে জীবিকা নির্বাহের কৌশল হিসাবে কার্যকর হওয়ার জন্য সেচের একটি পরিকল্পিত বণ্টন প্রয়োজন।[১৭] বালিতে জলের প্রতুলতা বজায় রাখা ও বন্টন করার জন্য সেচ খালের একটি পরিকল্পিত ব্যবস্থা রয়েছে, যা স্থানীয়ভাবে সুবক নামে পরিচিত। ভূগর্ভস্থ কূপ এবং খাল উভয়ই এই প্রাকৃতিক জলের উৎস থেকে ভিজামাটির ধান চাষের ক্ষেত্রগুলিকে আলাদা রাখে বা প্রয়োজনে যোগান দেয় যা বালির কৃষকদের প্রধান ফসল ফলানোর জন্য সহায়ক।[১৮]
সমবায় জলের পুনর্বন্টন ব্যবস্থা বালিনিজদের মধ্যে ধর্মীয় এবং সাংস্কৃতিক অনুশীলনের সাথে আবদ্ধ, এবং পারস্পরিক বাধ্যবাধকতার উপর ভিত্তি করে একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব করে এবং জল মন্দিরের (স্থানিয়ভাবে পুরা তীর্থ) কর্মীদের দ্বারা পরিচালিত হয়। এই জল মন্দিরের ধর্মীয় কর্মকর্তারা এই ব্যবস্থায় অংশগ্রহণকারীদের উপর আধ্যাত্মিক এবং সাংস্কৃতিক সুপ্রভাব প্রয়োগ হয় এবং এর ধারাবাহিকতা নিশ্চিত করে।[১৯] এই জল মন্দিরগুলি মূলত সেচ খালের সংযোগ অবস্থানে অবস্থিত এবং দ্বীপের পাহাড়ী জলের উৎস থেকে নিম্নভূমি অঞ্চলে জল বিতরণ পরিচালনা করে যেখানে প্রাকৃতিক ধান চাষের জন্য জল খুব কম পাওয়া যায়।[২০]
প্রমাণ্য তথ্য বলে যে এই এই পদ্ধতি একাদশ শতকের প্রথম দিকে বিকশিত হয়েছিল এবং সেই সময় থেকে এটি ক্রমাগত চলে আসছে।[২১] জিনগত প্রমাণ ইঙ্গিত করে যে এই পদ্ধতিটি বংশ পরম্পরায় ছড়িয়ে পড়ে কারণ বালির আদি চাষি গ্রামবাসীরা সেইসময় সুফসলী অঞ্চল থেকে দ্বীপের অন্য জলবায়ুগতভাবে প্রতিকূল অঞ্চলে ভেজামাটিতে ধান চাষের উদ্ভব ঘটায়।[১৮] নির্দিষ্ট পুরা তীরৃথ-এর সাংস্কৃতিক প্রভাব মূলত সুবক ব্যবস্থার মধ্যে তাদের অবস্থানের সাথে সম্পর্কযুক্ত। প্রধান জলের উৎসগুলিতে অবস্থিত মন্দিরগুলিরও উল্লেখযোগ্য সাংস্কৃতিক প্রভাব রয়েছে। এই ধরনের রাজকীয় প্রধান মন্দিরগুলির সাথে রাজ পরিবারের সদস্যরা যুক্ত রয়েছেন। এই পুরা তীর্থগুলি জল মন্দিরের কাজের অংশীদার হয়ে সমাজে বেশ প্রভাব ফেলেছে। [২২]
ভৌত অবকাঠামোর এই ব্যবস্থাটি বিশ্বাস ও দায়িত্বের প্রতিনিধিত্ব করে যা অংশগ্রহণকারী ব্যক্তিদের দ্বারা এটির ধারাবাহিকতাকে উৎসাহিত করে এবং একটি সমতলকরণ ব্যবস্থা প্রদান করে যেখানে লোকেরা অন্যথায় ধানের কৃষি জমিতে অংশগ্রহণ করতে অক্ষম হবে। কারণ জল ফসল বৃদ্ধির জন্য প্রাকৃতিকভাবে সহায়ক অঞ্চল থেকে অপ্রতুল অঞ্চলে সমবণ্টন করা উভয় ক্ষেত্রে কৃষিজ উন্নতির সহায়ক।
উৎসব
বালির মানুষরা একাধিক উৎসব উদযাপন করেন তার মধ্যে রয়েছে কুটা কার্নিভাল, the সানুর ভিলেজ ফেস্টিভাল, এবং সমাধিক চর্চিত বালির ঘুরি উৎসব,[২৩] যেখানে অংশগ্রহণকারীরা মাছ, পাখি, পাতা প্রভৃতি আকারের ঘুড়ি উড়ান এবং তার সাথে সহযোগী গান বাজনা হয়।
↑Akhsan Na'im, Hendry Syaputra (২০১১)। Kewarganegaraan, Suku Bangsa, Agama dan Bahasa Sehari-hari Penduduk Indonesia Hasil Sensus Penduduk 2010। Badan Pusat Statistik। আইএসবিএন978-979-064-417-5।
↑Aris Ananta, Evi Nurvidya Arifin, M Sairi Hasbullah, Nur Budi Handayani, Agus Pramono. Demography of Indonesia's Ethnicity. Singapore: ISEAS: Institute of Southeast Asian Studies, 2015. p. 273.
↑Shiv Shanker Tiwary & P.S. Choudhary (২০০৯)। Encyclopaedia Of Southeast Asia And Its Tribes (Set Of 3 Vols.)। Anmol Publications Pvt. Ltd.। আইএসবিএন978-81-261-3837-1।
↑Karafet, Tatiana M.; Lansing, J S.; Redd, Alan J.; and Reznikova, Svetlana (2005) "Balinese Y-Chromosome Perspective on the Peopling of Indonesia: Genetic Contributions from Pre-Neolithic Hunter-Gatherers, Austronesian Farmers, and Indian Traders," Human Biology: Vol. 77: Iss. 1, Article 8. Available at: http://digitalcommons.wayne.edu/humbiol/vol77/iss1/8
↑Beryl De Zoete, Arthur Waley & Walter Spies (১৯৩৮)। Dance and Drama in Bali। Faber and Faber। পৃষ্ঠা 298। ওসিএলসি459249128।
↑Beryl De Zoete, Arthur Waley & Walter Spies (১৯৩৮)। Dance and Drama in Bali। Faber and Faber। পৃষ্ঠা 6–10। ওসিএলসি459249128।
↑Leo Howe (২০০১)। Hinduism & Hierarchy In Bali। James Currey। পৃষ্ঠা 46। আইএসবিএন1-930618-09-3।
↑Helen Creese, I Nyoman Darma Putra & Henk Schulte Nordholt (২০০৬)। Seabad Puputan Badung: Perspektif Belanda Dan Bali। KITLV-Jakarta। আইএসবিএন979-3790-12-1।