বাংলা ভাষায় কুরআনের অনুবাদ সর্বপ্রথম কে করেছেন তা নিয়ে কিছু বিতর্ক আছে। ঊনবিংশ শতাব্দীতে আরবী থেকে বাংলায় পবিত্র কুরআন শরীফের অনুবাদ শুরু হয়। অনেকেই আংশিক অনুবাদ করেছেন যেমন মাওলানা আমির উদ্দীন বসুনিয়া। আবার ভাই
গিরিশ চন্দ্র সেন সর্বপ্রথম পূর্ণাঙ্গ কুরআন অনুবাদ করেছেন।[১]
পৃথিবীর সমৃদ্ধতম ভাষার অন্যতম বাংলা ভাষায় মুসলিমদের পবিত্র শাস্ত্র কুরআনের অনেক অনুবাদ ঊনিবংশ, বিংশ ও একবিংশ শতাব্দীতে প্রকাশিত হয়েছে৷[২]
অনুবাদ কর্মের সূচনা
চতুর্দশ শতাব্দী
১৩৮৯ খ্রিস্টাব্দে বাংলা সাহিত্যের প্রাচীনতম কবিদের একজন শাহ মুহম্মদ সগীর বাংলা ভাষায় সর্বপ্রথম পবিত্র কুরআনের সুরার অনুবাদ করেন। তিনি সম্পূর্ণ কুরআনের অনুবাদ করেননি, শুধুমাত্র ‘সূরা ইউসুফ’-এর অনুবাদ করেছিলেন এবং এটি ছিল কাব্যছন্দে রচিত।[২]
ইতিহাস পরিক্রমায় অনুবাদ সমূহ
ঊনবিংশ শতাব্দী
ঊনবিংশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে ১৮০৮ বা ১৮০৯ খ্রিস্টাব্দে রংপুরের মটুকপুর নিবাসী মাওলানা আমির উদ্দিন বসুনিয়া আমপারার বাংলা অনুবাদ সম্পন্ন করেন। এ খণ্ডিত অনুবাদটি ছিল বাংলা পুঁথি সাহিত্যের ভাষায় আমপারার কাব্যানুবাদ৷[২] বাংলা ভাষায় কুরআন অনুবাদের তিনিই পথিকৃৎ, যদিও তা আংশিক ছিল৷ এই আমপারা কালের লিথো প্রেসে মুদ্রিত হয় এবং এর পৃষ্ঠাসংখ্যা ছিল ১৬৮। এ অনুবাদের ৮০ বৎসর পর ব্রাহ্ম মতাবলম্বী গিরিশ চন্দ্র সেন (১৮৩৫-১৯১০) বঙ্গানুবাদ করে সম্পূর্ণ কুরআন ছেপে প্রকাশ করেন ১৮৮৬ খ্রিস্টাব্দে।[৩]
এ অনুবাদের পর কুরআনের বঙ্গানুবাদে এগিয়ে আসেন কলকাতার পাটওয়ার বাগানের আকবর আলী। ব্রিটিশ-ভারতের রাজেন্দ্রনাথ মিত্র, পাদ্রি তারাচরণ বন্দ্যোপাধ্যায়, টাঙ্গাইলের মাওলানা নঈমুদ্দিন (১৮৩২-১৯০৮), দিনাজপুরের আকবর উদ্দিন, ব্রিটিশ-ভারতের একজন দেশীয় খ্রিস্টান শ্রী ফিলিপ বিশ্বাস প্রমুখ।[৩] এর মধ্যে গিরিশ চন্দ্র সেনের বঙ্গানুবাদটি ছিল পূর্ণাঙ্গ আর অন্যদের অনুবাদ ছিল খণ্ডিত। গিরিশ চন্দ্র সেনের অনুবাদ আক্ষরিক পর্যায়ের ছিল৷ এতে টীকা-টিপ্পনী সংযুক্ত হয় ফলে এটিকে অর্থানুবাদও বলা যায়। এর ভাষা প্রাঞ্জল। প্রাথমিক পর্যায়ের কুরআন হিসেবে বিভিন্ন মুসলিম পণ্ডিত ও সাহিত্যিকেরা অনুবাদটির প্রশংসা করেছেন৷[৪]
১৮৮৬ সালে গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদ প্রকাশিত হলেও সেই অনুবাদ ছিলো মূল আরবি বিহীন,এবং হিন্দুধর্মীয় শব্দে ভরপুর। গিরিশচন্দ্র সেনের ভ্রমাত্মক অনুবাদ তাই সর্বত্র গৃহীত হয় নি।এরই ধারাবাহিকতায় আব্বাস আলী পবিত্র কুরআনের পূর্ণাঙ্গ অনুবাদ করেন। যা ১৯০৮ সালে প্রকাশিত হয়।উল্লেখ যে মওলানা নঈমুদ্দীন ২৩ পারা কুরআনের অনুবাদ করেছিলেন।[৫]আব্বাস আলীর অনুবাদে প্রথমে ছিলো মূল আরবী,এরপর ছিলো শাহ রফিউদ্দিন(রহ.) এর উর্দু অনুবাদ এবং শেষে আব্বাস আলীর সরল বাংলা অনুবাদ।
মওলানা আকরম খাঁ (১৮৬৮-১৯৬৮)। বাঙালি মুসলিম আলেমদের মধ্যে মওলানা আকরম খাঁ পবিত্র কোরআন অনুবাদের সঙ্গে নানাভাবে জড়িত ছিলেন। প্রথমত, গিরিশচন্দ্র সেনের অনুবাদকে অভিনন্দিত করে তিনি প্রথম এ বিষয়ে আলোচনায় আসেন। পরে মাওলানা আব্বাছ আলীর সঙ্গে যৌথভাবে ১৯০৫ সালে কোরআন অনুবাদে অংশগ্রহণ করেন। যৌথ অনুবাদটি ছিল তিন ভাষায় সমন্বিত। আরবি, বাংলা ও উর্দু ভাষায় এই কোরআন অনূদিত হয়ে প্রকাশিত হয়েছিল।[২]
শ্রী কিরণ গোপাল সিংহ (১৮৮৫-১৯৪২), ইতিহাসে দেখা যায়, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে একমাত্র কিরণ গোপাল সিংহই পবিত্র কোরআন অনুবাদে এগিয়ে এসেছিলেন।[২]
১৯১১ : মুহাম্মদ মেহেরুল্লাহ সানী' (১৮৫৬-১৯১৮)। সিরাজগঞ্জ জেলার সমাজকর্মী ও সাহিত্যিক মেহেরুল্লাহ সানী পবিত্র কোরআন বাংলায় অনুবাদ করেন এবং এর নাম দেন বাংলা কোরআন শরিফ।[৪]
১৯১৩ : আলাউদ্দীন আহমদ (১৮৫১-১৯১৫) ও হাফেজ মাহমুদ শাহ। সুসাহিত্যিক আলাউদ্দীন আহমদ সিরাজগঞ্জে পবিত্র কোরআন অনুবাদে হাত দেন। পরে তিনি হাফেজ মাহমুদ শাহর সাহায্য গ্রহণ করেন এবং যুগ্ম নামে এই অনুবাদ ১৯১৩ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।[২]
১৯১৪ : মাওলানা খোন্দকার আবুল ফজল আবদুল করিম (১৮৭৬-১৯৪৭)। টাঙ্গাইলে জন্মগ্রহণকারী খোন্দকার আবদুল করিম ১৯১৪ সালে ‘কোরআন’ নামে বাংলা ভাষায় পবিত্র কোরআন অনুবাদ করেন এবং টাঙ্গাইল থেকে মুদ্রণ করে প্রকাশ করেন।[৩]
১৯১৬ : মুন্সী করিম বখশ কলকাতার অধিবাসী মুন্সী করিম বখশ ১৯১৬ সালে পবিত্র কোরআনের প্রথম ও শেষ পারার বাংলা অনুবাদ কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।[৩]
১৯১৭ : আবদুল ছাত্তার সুফী কলকাতা থেকে ১৯০৭ সালে পবিত্র কোরআনের আয়াত কাব্য আকারে অনুবাদ করে প্রকাশ করেন তিনি। বাংলা কবিতার ত্রিপদী ছন্দে কোরআন অনুবাদে ছিলেন তিনিই প্রথম।[৪]
মাওলানা মুহাম্মদ রুহুল আমিন (১৮৭৫-১৯৪৫)। পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনায় জন্মগ্রহণকারী মাওলানা রুহুল আমিন ১৯১৭ সালে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করেন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে পাস করা আলেম হওয়ায় তাঁর অনুবাদের প্রতি তৎকালীন মুসলিমসমাজের আগ্রহ দেখা যায়।[২]
১৯২০ : মাওলানা এয়ার আহমদ এলটি (-১৯৪৪)। ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণকারী মাওলানা এয়ার আহমদ ‘আমপারা বাঙ্গালা তফছির’ নামে কোরআন অনুবাদ করে ১৯২০ সালে ঢাকা থেকে প্রকাশ করেন।[৪]
১৯২২ : মোহাম্মদ আবদুল হাকিম (১৮৮৭-১৯৫৭) ও মোহাম্মদ আলী হাসান। গোপালগঞ্জ নিবাসী মোহাম্মদ আবদুল হাকিম এবং মানিকগঞ্জ নিবাসী মোহাম্মদ আলী হাসান ‘কোরআন শরিফ’ নাম দিয়ে পবিত্র কোরআনের অনুবাদ যৌথভাবে সম্পাদন করেন এবং কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। এর সঙ্গে তাঁরা তাফসিরও বর্ণনা করেছেন। শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হক থেকে শুরু করে অনেক মুসলমান নেতাই তাঁদের অনুবাদের প্রশংসা করে সনদ দিয়েছিলেন।[৩]
১৯২৩ : মাওলানা শেখ ইদ্রিস আহমদ। বাংলাদেশের চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলায় ১৮৯২ সালে মাওলানা শেখ ইদ্রিস আহমদ জন্মগ্রহণ করেন। ‘কোরআনের মহাশিক্ষা’ নামে তাঁর অনূদিত পবিত্র কোরআন ১৯২৩, ১৯২৭ ও ১৯৩৪ সালে মোট তিন খণ্ডে বিভক্ত হয়ে প্রকাশিত হয়।[৩]
১৯২৪ : মাওলানা ফাজেল মকিমী। কলকাতার অধিবাসী মাওলানা ফাজেল মকিমী ১৯২৪ সালে পবিত্র কোরআনের দু-তিন পারা অনুবাদ করেছিলেন। কিন্তু গবেষকরা তাঁর অনুবাদের কোনো নমুনা বা কপির সন্ধান পাননি।[৬]
১৯২৫ : ফয়জুদ্দীন আহমেদ (১৮৯৯-১৯৩৫)। বরিশালে জন্মগ্রহণকারী ফয়জুদ্দীন আহমেদ সুরা ফাতিহা ও এর তাফসির অনুবাদ করেন। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ঢাকা থেকে ১৯২৫ সালে তা প্রকাশ করেন। সুরা ফাতিহার অনুবাদ ও তাফসিরের এই খণ্ডটি ছিল ১৫৭ পৃষ্ঠার।[৬]
১৯২৬ : ফজলুর রহীম চৌধুরী (১৮৯৬-১৯২৯)।বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণকারী এবং শেরেবাংলা এ কে ফজলুল হকের জামাতা ফজলুর রহীম চৌধুরী প্রথমে ‘কোরআনের সুবর্ণ পঞ্জিকা’ নামে বিশেষ বিশেষ সুরা ও সুরাংশ অনুবাদ করে ১৯২৬ সালে প্রকাশ করেন। পরে ‘কোরআন শরিফ’ নামে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করেন, যা তাঁর মৃত্যুর পর ১৯৩০ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয়।[২]
১৯২৬: মাওলানা খন্দকার গোলাম রসুল ঝিনাইদহ জেলা হতে ‘বাঙ্গালা পাঞ্জ সুরাহ’ নাম দিয়ে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরা অনুবাদ করেন।[৪]
১৯২৭ : মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী। কক্সবাজার জেলায় জন্মগ্রহণকারী মোহাম্মদ আবদুর রশিদ ছিদ্দিকী ‘মহা কোরআন কাব্য’ নাম দিয়ে ১৯২৭ সালে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। গদ্য ও পদ্য—দুই রীতিতে তাঁর কোরআন অনূদিত হয়েছিল, আর এটা ছিল বঙ্গ ভাষায় কোরআন অনুবাদের একটি ব্যতিক্রম রীতি।[৩]
১৯২৮ : মাওলানা ওসমান গনি। পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে ডিগ্রি অর্জনের পর ১৯১৪ সালে পাঞ্জ সুরা অনুবাদ করেন এবং এর নাম দেন ‘পঞ্চমণি’। কিন্তু এটি প্রকাশিত হয় ১৯২৮ সালে কলকাতা থেকে। পরে ‘পবিত্র কোরআন’ শিরোনামে কোরআন অনুবাদ করেন এবং ১৯৪৭ সালে তা প্রকাশিত হয়। তিনি এই অনুবাদে আরবি উচ্চারণের বাংলা অনুলিখন (প্রতিবর্ণায়ন) সংযোজন করেন।[৩]
মাওলানা আহমদ আলী (১৮৯৮-১৯৫৯)। যশোর জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন এবং কলকাতা আলিয়া মাদরাসা থেকে দ্বিনি শিক্ষার প্রাথমিক ভিত গড়ে তোলেন। ১৯২৮ সালে সুরা ইয়াসিন অনুবাদ করে প্রকাশ করেন।[২]
১৯২৯ : মাওলানা কফিলউদ্দিন আস সিদ্দিকী। টাঙ্গাইল জেলার অধিবাসী মাওলানা কফিলউদ্দিন ১৯২৯ সালে ‘তরজমা পাঞ্জে সুরা’ নাম দিয়ে পবিত্র কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সুরা অনুবাদ করেন। এটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে।[২]
১৯৩০ : মোরশেদ আলী। ‘কোরআন দর্পণ’ নামে পবিত্র কোরআনের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেন মোরশেদ আলী ১৯৩০ সালে। এটি প্রকাশিত হয়েছিল ঢাকা থেকে। অধ্যাপক আলী আহমদ লিখিত বাংলা মুসলিম গ্রন্থপঞ্জিতে কোরআন অনুবাদক হিসেবে তাঁকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। তিনি তাঁর অনূদিত গ্রন্থের নাম দিয়েছিলেন ‘কোরআন দর্পণ’। এর প্রথম খণ্ডে ১৭টি সুরার বঙ্গানুবাদ স্থান পেয়েছিল।[৩]
১৯৩০ :মীর ফজলে আলী (১৮৯৮-১৯৩৯)। বরগুনা জেলার সন্তান মীর ফজলে আলী ১৯৩০ সালে ‘কোরআন কণিকা’ শিরোনামে পবিত্র কোরআনের অংশবিশেষ অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। এটি প্রকাশিত হয় কলকাতা থেকে। ভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ এই অনুবাদের ভূমিকা লিখে দিয়েছিলেন।[৩]
১৯৩১ : মুহাম্মদ আজহার উদ্দীন। রাজবাড়ী জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন মুহাম্মদ আজহার উদ্দীন। ‘কোরআনের আলো’ শিরোনামে পবিত্র কোরআনের দীর্ঘ সুরাগুলো অনুবাদ করে ১৯৩১ সালে তিনি কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।[৪]
১৯৩২ : আবদুল আযীয হিন্দি (১৮৬৭-১৯২৬)। কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন আবদুল আযীয হিন্দি। ‘কোরআন শরিফ’ শিরোনামকৃত তাঁর অনূদিত পবিত্র কোরআন নোয়াখালী থেকে ১৯৩২ সালে প্রকাশিত হয়।[২]
১৯৩৩ : কাজী নজরুল ইসলাম। পশ্চিম বাংলার বর্ধমান জেলায় জন্মগ্রহণকারী বাংলা সাহিত্যে বিদ্রোহী কবি বলে পরিচিত কাজী নজরুল ইসলাম পবিত্র কোরআনের আমপারা অংশ কাব্যাকারে অনুবাদ করেন। তা ‘কাব্য আমপারা’ নামে কলকাতা থেকে প্রকাশিত হয় ১৯৩৩ সালে। কবি নজরুলের অনুবাদের একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য ছিল, তিনি কাব্যানুবাদ শেষে মার্জিনের নিচে আরবি সুরার বাংলা অর্থ পরিবেশন করেছেন।[৬] ১৯২০ সালে ‘আমপারা’ শীর্ষক অংশে পবিত্র কোরআনের অনুবাদের খণ্ডাংশ কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন। গদ্য ও কাব্য—এ দুই-ই বিচ্ছিন্নভাবে অনুবাদে তিনি কাজে লাগান।[২]
১৯৩৪ : সৈয়দ আবুল খায়ের তাজুল আউলিয়া জাহাঙ্গীর। টাঙ্গাইল থেকে ১৯৩৪ সালে ‘বাংলা কোরআন শরিফ’ নাম দিয়ে পবিত্র কোরআনের অনুবাদ প্রকাশ করেন। তবে তা ছিল শুধু প্রথম পারার অনুবাদ।[৪]
১৯৩৫ : সৈয়দ আবুল মনসুর। সিলেটের অধিবাসী ছিলেন সৈয়দ আবুল মনসুর। কলকাতা থেকে ১৯৩৫ সালে ‘কোরআন কুসুমাঞ্জলি’ নামে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে প্রকাশ করেন। পরে ‘কোরআন মঞ্জরি’, ‘কোরআন মঙ্গল’ ইত্যাদি নামে আরো কিছু সুরার অনুবাদ প্রকাশিত হয়। মাইকেল মধুসূদন দত্তের অমিত্রাক্ষর ছন্দের অনুসরণ করে তিনি কোরআনের কাব্যানুবাদের অনুশীলন করেছিলেন।[৩]
১৯৩৬ : আইয়ুব আলী চৌধুরী (১৮৭৭-১৯৩৬)। বাংলা পয়ার ছন্দে সুরা ফাতিহার কাব্যানুবাদ করে আইয়ুব আলী চৌধুরী ১৯৩৬ সালে কলকাতা থেকে তা প্রকাশ করেন। এর নাম দেন তিনি ‘স্বর্গীয় কানন’। কাব্যানুবাদে সুরা ফাতিহা বিষয়ে তাঁর মনগড়া অনেক শব্দও তিনি এতে প্রয়োগ করেন।[৩]
মাওলানা মুহাম্মদ গোলাম আকবর (১৮৯২-১৯৫৬)। যশোর থেকে ১৯৩৬ সালে ‘আমপারার তফসির’ নাম দিয়ে তাঁর কোরআন অনুবাদের খণ্ড প্রকাশ করেন।[২]
১৯৩৭ :বসন্তকুমার মুখোপাধ্যায়। হিন্দু ব্রাহ্মণদের মধ্যে বসন্তকুমার মুখোপাধ্যায়ই প্রথম কোরআন অনুবাদ করে প্রকাশ করেছিলেন। ‘পবিত্র কোরআন প্রবেশ’ নামে তাঁর অনুবাদ ১৯৩৭ সালে নারায়ণগঞ্জ থেকে মুদ্রিত হয়ে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয়েছে বলে গ্রন্থটিতে উল্লিখিত হয়।[২]
১৯৩৯ :মুহাম্মদ ইসমাইল। চাঁদপুরে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ ইসমাইল পবিত্র কোরআনের ৩০তম পারা অনুবাদ করে ১৯৩৯ সালে ত্রিপুরা থেকে প্রকাশ করেন। তিনি এর নাম দেন ‘আমপারার তরজমা’।[২]
১৯৪০ :মুহাম্মদ শামসুল হুদা। গিরিশচন্দ্র সেনের পর নরসিংদীতে জন্মগ্রহণকারী মুহাম্মদ শামসুল হুদা নামের আরেক নরসিংদীবাসী কোরআন অনুবাদে এগিয়ে আসেন। ১৯৪০ সালে ‘নেয়ামুল কোরআন’ নামে পবিত্র কোরআনের বিভিন্ন সুরার অনুবাদ, ফজিলতসহ তাঁর অনুবাদ প্রকাশিত হয় ঢাকা থেকে।[৩]
১৯৪১ :খানবাহাদুর আহসানউল্লা (১৮৭৩-১৯৬৫)। সাতক্ষীরায় জন্মগ্রহণকারী খানবাহাদুর আহসানউল্লা পবিত্র কোরআনের গুরুত্বপূর্ণ পাঁচটি সুরা অনুবাদ করে ১৯৪০ সালে (মতান্তরে ১৯৪০-১৯৪৭-এর কোনো সময়ে) কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।[৩]
১৯৪৪ :মীজানুর রহমান। ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অধিবাসী মীজানুর রহমান তাঁর মায়ের নির্দেশে পবিত্র কোরআন অনুবাদ করে ‘নূরের ঝলক’ বা ‘কোরআনের আলো’ নাম দিয়ে ১৯৪৪ সালে কলকাতা থেকে প্রকাশ করেন।[৩]
১৯৪৫ :মাওলানা যুলফিকার আলী। ফেনী জেলায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন তিনি। পবিত্র কোরআনের আমপারার অংশ অনুবাদ করে ১৯৪৫ সালে চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশ করেন। তাঁর অনুবাদের বৈশিষ্ট্য হলো, তিনি আরবি অক্ষরে বাংলা অনুবাদ করেন। পবিত্র কোরআন অনুবাদে এই রীতিতে তিনিই প্রথম। তবে এই ধারার আর বেশি চর্চা হয়নি।[৪]
১৯৪৬ : ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১৮৮৫-১৯৬৯)। পশ্চিম বাংলার চব্বিশ পরগনা জেলায় জন্মগ্রহণকারী বহুভাষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ থেকেও বাংলাভাষী মানুষ পবিত্র কোরআনের অনুবাদ লাভ করেছে। ‘মহাবাণী’ শিরোনামে তাঁর অনূদিত কোরআন প্রকাশিত হয়েছিল ১৯৪৬ সালে বগুড়া থেকে। এতে সুরা ফাতিহা থেকে সুরা ফিল পর্যন্ত অনূদিত হয়েছিল। এ ছাড়া তিনি সুরা বাকারাও অনুবাদ করেছিলেন। তাঁর অনুবাদে সংস্কৃতজাত শব্দের অগ্রাধিকার ছিল। ‘ইমাম’কে ‘আচার্য’ ও ‘ধর্মাচার্য’, ‘মুক্তাদি’কে ‘অনুবর্তী’, ‘আয়াত’কে ‘প্রবচন’, ‘নবী’কে ‘সংবাদবাহক’, ‘নবুয়ত’কে ‘প্রেরিতত্ব’ শব্দ দ্বারা ব্যাখ্যা করেছেন তিনি।[৬]
১৯৪৭ :মাওলানা মুনীর উদ্দীন আহমদ। রংপুর নিবাসী মাওলানা মুনীর উদ্দীন আহমদ ‘হাফিজিল কাদেরী’ নামে তাফসিরসহ পবিত্র কোরআনের অনুবাদ করেন ১৯৪৭ সালে। এটি রংপুর থেকেই প্রকাশিত হয়েছিল।[৪]
১৯৬২ : ‘তাফসিরে আশরাফী’, এমদাদিয়া লাইব্রেরি। উর্দু বয়ানুল কোরআনের অনুবাদ। মূল : আল্লামা আশরাফ আলী থানভি (রহ.)।[৩]
২০১৩ : ‘তাফসীরুল কুরআন ’। তাফসীরসহ এই অনুবাদ কর্মটি রচনা করেন ড. মুহাম্মাদ আসাদুল্লাহ আল-গালিব। তিনি আহলেহাদীছ আন্দোলন বাংলাদেশের আমীর ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। তিন খণ্ডে মোট পাঁচ পারার (২৬-৩০) অনুবাদ ও তাফসীর প্রকাশিত হয়েছে। প্রকাশক হাদীছ ফাউন্ডেশন বাংলাদেশ।
আশ্রয় চাহি আল্লাহর, যেন শয়তান দূরে রয় শুরু করিলাম, আল্লাহর নামে, দয়ালু করুণাময়
প্রশংসা সব আল্লাহর, যিনি সারা জাহানের রব; দয়ালু, মহানুভব; (আর) যিনি বিচারদিনের সব৷ আমরা সবাই কেবলই তোমার ইবাদত করে যাই, এবং তোমার কাছেই শুধু সহায়তা চাই৷ তুমি আমাদের দেখাও তোমার সরল-সঠিক পথ; তাদের সে পথ, যাদেরকে দান করিয়াছ নিয়ামত৷ যাদের উপর রুষ্ট হয়েছ, তাদের সে পথ নয় এবং তোমার সৎপথ হতে বিচ্যুত যারা হয়৷[১৮][২৩]
করুণা কৃপার যার নাই নাই সীমা।
বিচার-দিনের বিভু! কেবল তোমারই
আরাধনা করি আর শক্তি ভিক্ষা করি।
সহজ সরল পথে মোদের চালাও,
যাদেরে বিলাও দয়া সে পথ দেখাও।
অভিশপ্ত আর পথভ্রষ্ট যারা,প্রভু,
তাহাদের পথে যেন চালায়ো না কভু।[২৪]
জগতের প্রভু তিনি,দয়ার আধার;
করুণাময়ের হাতে শেষ বিচারের ভার;
আমরা বন্দেগী করি কেবল তোমার;
দেখাও সরল পথ,যে পথে হয়েছে পার
প্রিয়জন;ভ্রষ্টজন যে পথে গজবে ছারখার
সে পথে যাবোনা আমি,সে নয় আমার।[২৪]
পালন করেন যিনি সকল যাহান;
পরম করুণাময় তিনি দয়াবান।
রোজ কিয়ামতে যিনি করিবেন বিচার;
ইবাদাত আমরা সবাই করি আপনার।
আপনারি সাহায্য চাই মোরা ইবাদাতে;
চালান মোদের যেন সেই সোজা পথে।
চলেছে যারা সব সেই পথ ধরে;
আপনার দয়া রয় যাদের উপরে।
আর যারা চলে সব সেই পথে নয়;
আপনার গজব যেথায় আপতিত হয়।
আরো যে লোকেরা ভুল পথে রয়;
এসব চাওয়া যেন মন্জুর হয়![২৪]