বাংলাদেশের নারী শিল্পীগণ

বাঙালি কুমোর বা কুমোরের স্ত্রী অথবা কন্যা এমন সমস্ত পণ্য তৈরি করেন যাতে চাকা ব্যবহার করা হয়না। তারা কুমোরের পারিবারিক কর্মশালায় ঘট, সরা বা পাত্রের ঢাকনা, পুতুল ইত্যাদি সমস্ত পণ্যতে রং করেন। তাঁতি পরিবারের নারীরা তাঁত বোনার কাজ ছাড়া প্রায় সব কাজ করে থাকেন। তবুও নারীদের কখনোই দেশের শিল্পী ঐতিহ্যের অংশ করা হয়না। তারা কখনো একটি গোষ্ঠীর অংশ হননা। দেশে কোনো মহিলা স্যাঁকরা (স্বর্ণকার), ছুঁতোর (সূত্রধর) বা তক্ষক (ভাস্কর) ছিলেননা। দেশের বর্তমান প্রস্তুতকর্তা ও উপভোক্তা সম্পর্কের অর্থনৈতিক কাঠামো সর্বদা পুরুষ-কেন্দ্রিক। যদিও প্রথম চিত্রশিল্পী হিসেবে সংস্কৃত সাহিত্যে যে চিত্রলেখার উল্লেখ পাওয়া যায়, তিনি বাণ রাজার প্রাগজ্যোতিষপুরার অন্দরমহলের শিল্প নির্মাণ করেছিলেন। রাধার সহচরীদের চিত্রকলার দক্ষতা বৈষ্ণব সাহিত্যে পুনরাবৃত্তি হয়ছিল। বাঙালি নারীর সর্বশ্রেষ্ঠ হাতের কাজের ছোঁয়া বাংলার লোকশিল্পে পাওয়া যায়। রন্ধনশৈলী সম্পর্কিত শিল্প সম্পর্কে দিনেশ চন্দ্র সেন বলেন যে, সন্দেশ (মিষ্টান্ন) তৈরিতে শৈল্পিক দক্ষতা দিয়ে নারীরা ফুল এবং ফলের সৌন্দর্য অর্জন করেছিল। বাঙালি নারীদের পোড়ামাটির তৈরি শত শত ছাঁচ আছে, তাদের সেই সৌন্দর্যায়নের প্রয়াস সত্যিই দেখার মতো। পূর্ব বাংলার নারীদের নারকেলের শাঁস থেকে তৈরি মিষ্টি যারা দেখেনি, তারা সেই সব নারকেলি মিষ্টির জন্যে তাদের প্রশংসা করতে পারবেনা।

ইতিহাস

যদিও বাংলার নারী শিল্পীরা নানা ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের জিনিসপত্র ব্যবহার করে থাকেন, তবুও তাদের নকশার মধ্যে এক ধরনের মিল খুঁজে পাওয়া যায়। নকশিকাঁথা (চিত্র 1.9), নকশিপিঠে, পাটি, ঘট, হরি ইত্যাদি জিনিসগুলো সাজানো হয় এবং তাদের কর্মকুশলতার মধ্যে আমরা আল্পনা নকশার প্রতিফলন লক্ষ করি। মাটিতে চালের মাড় দিয়ে আল্পনা আঁকা হয় খেজুর কাঁটা, পাট কাঠি অথবা বাঁশের পাতলা টুকরোর সাহায্যে; চালের গুঁড়ো দিয়ে পিঠে বানানো হয়। এই পিঠে প্রধানত ময়মনসিংহ, কুমিল্লা, সিলেট, ঢাকা ও চট্টগ্রামে (চিত্র 1.8) তৈরি করা হয়। বিশ্লেষণে এটি উপলব্ধি করা যায় যে, বাঙালি নারী তার জানা জগতের নানা রকম শিল্পমাধুরীর সঙ্গে তিনি যে প্রতীকগুলি শিখেছেন তার দ্বারা বিশ্বব্যাপী শিল্প সৃষ্টি করেন। কবি জসিমউদ্দীন নারীর শিল্প জগৎটা বৃহত্তর রূপে দেখেছেন, আমরা যে চিত্রটি মাটিতে আল্পনার রেখায় দেখি তা আমরা পাথরের স্ল্যাবগুলোতে, ছুঁতোর দ্বারা সজ্জিত কাঠের টুকরোতে, দেহের উল্কিগুলোতে একই রকমভাবে দেখি; গয়না, রঙিন কাঁথা এবং বাড়িতে সূক্ষ্ম বেতের কাজেও দেখা যায়। যদিও বিভিন্ন শিল্পকর্ম তৈরির পদ্ধতি ভিন্ন ভিন্ন, তবুও সেগুলোর মধ্যে সাজুয্য আছে তাদের ঐতিহ্যে।

শিল্প জগতের মূল ধারায় নারীর প্রবেশদ্বারটি বৃহত্তরভাবে সামাজিক অবস্থাগুলোর বিরুদ্ধে। নারীদের সৃষ্টি করার জন্য যে ধরনের শিল্প সামনে সামনে হাজির থাকে, উচ্চ বা মূলধারার শিল্প থেকে তা সম্পূর্ণ ভিন্ন। এই বিতর্কিত সত্যের কারণেই নারী ও পুরুষ ভিন্ন। যদিও তারা একই সমাজ, পরিবার এবং পরিবেশের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত, কিন্তু কারণটা হল পুরুষশাসিত সমাজ, যেখানে তারা বড়ো হয়ে ওঠেন, সেখানেই তাদের মধ্যে বিরাট বৈষম্য শুরু থেকেই বিদ্যমান। এই বৈষম্যটা নান্দনিক চেতনাকে চেনায় এবং বিভিন্ন দিকের জীবনকে দেখায়। হাইড-গেটনার অ্যাবেড্রোথ লিখেছেন, মাতৃতান্ত্রিক শিল্প মাতৃতান্ত্রিক পৌরাণিক কাঠামোর গঠন থেকে উদ্ভূত হয় যা পুরোপুরি ভিন্ন মান পদ্ধতি এবং এটা শুধুমাত্র পিতৃতান্ত্রিকতার বিপরীতে অথবা বিতর্কিত নয়, এটাও এই ভিন্ন পদ্ধতির মানগুলিকে ভাগ করে নেয়। কাজ, শৃঙ্খলা, আত্মত্যাগের বাইরে প্রেমমূলক কোনো কিছু হল প্রভাবশালী শক্তি। বিমূর্ত, অমানবিক আদর্শের জন্য যুদ্ধ বা বীরত্বপূর্ণ মৃত্যু নয়, পুনর্জন্মের চক্র হিসেবে জীবনের ধারাবাহিকতা তার প্রাথমিক নীতি। সুতরাং নারীর প্রাথমিক নান্দনিক চেতনাকে এক সঙ্গে পিতৃতান্ত্রিক সমাজকে ধরে রাখতে ব্যবহৃত হয়। এই ইতিবাচক মহিলা শক্তি প্রেমে পিতৃপুরুষকে উদ্বুদ্ধ করে কারণ নারীর সচেতনতা এবং সেই জন্যে যে, তার শিল্প কখনোই স্ব-কেন্দ্রিক নয়। নারী সবসময় একটি স্তরে কাজ করে যা সাধারণত সহজবোধ্য এবং সহজেই আয়ত্ত করা যায়। তার শিল্প এবং জীবন আলাদা করা যায়না। পিতৃতান্ত্রিক সমাজে শিল্প ও জীবনের মূলধারাকে আলাদা করেছে অথবা উচ্চ শিল্পকে বিভিন্ন শাখায় ভাগ করেছে। প্রকৃতপক্ষে, নারীর মাতৃতান্ত্রিক মূল্যগুলো মূলত সহযোগী এবং আন্তর্জাতিক, যার আকর হল উর্বরা শক্তি জাগানোর ইচ্ছা। এই মান পদ্ধতি পিতৃতান্ত্রিক সমাজে একটি অন্তঃপ্রবাহ এবং নারীদের সচেতন এবং অবচেতন স্থিতি হিসেবে কাজ করে। এই মাতৃতান্ত্রিক মান পদ্ধতি পিতৃতন্ত্র দ্বারা নিজেদের প্রয়োজনে পুনর্গঠন করা হয়েছে। এভাবে, নারীরা যখন পুরুষ দ্বারা নির্মিত শিল্পের বিশ্বে প্রবেশ করে, সে তার প্রশিক্ষণ এবং প্রবৃত্তির বিরুদ্ধে যায়। নারীর বিস্ময়কর ও অসাধারণ কর্মচাঞ্চল্য একটি বিচ্ছিন্ন, পৃথক সত্তা হয়ে যায় যখন একজন নারী পুরুষের তৈরি অজানা নান্দনিক জগতে প্রবেশ করেন; তিনি অসম শর্ত প্রতিযোগিতায় প্রবেশ করেন। প্রায়শই আমরা এমন মহিলাদের দেখি যাঁরা তাদের শিল্পশিক্ষায় মহান প্রতিশ্রুতি প্রদর্শন করেন কিন্তু পরবর্তীকালে মূলধারার শিল্পের প্রকৃত জগতে গতি রাখতে পারেনা। শিল্পের এই জগতে সামাজিক চাপ, পারিবারিক জীবন ও শিশুপালনের সঙ্গে সামঞ্জস্য করা খুব কঠিন বলে মনে হয়। জীবন প্রবাহ থেকে পৃথক বিশুদ্ধ শিল্পের এই বিশ্ব একটা স্বাভাবিক পারিবারিক জীবনযাপনের সময় একজন মহিলার কাছে অস্বাভাবিক বলে মনে হয়। তাই আমরা প্রায়ই নারীকে জীবন এবং সমাজ থেকে বিচ্যুত হয়ে শিল্প ছেড়ে এবং প্রয়োগ শিল্পের দিকে ঝুঁকে পড়তে দেখি। সম্ভবত স্ব-কেন্দ্রীকরণ, স্ব-চেতনা এবং নারীর স্ব-শ্রদ্ধা জ্ঞানের কারণে এই পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, যেমন পুরুষের মতোই একই বিকাশ ঘটেনা। নারীরা অন্যদের সন্তুষ্ট করার চেষ্টায় চিরতরে ব্যস্ত। তিনি নিজেকে সর্বদা দ্বিতীয় ভাবেন এবং সুখ, শান্তি এবং পরিবারের যত্ন নিতে সচেষ্ট। এই মনোভাবের দ্বারা শিল্প বিশ্বের একটা জায়গা খুঁজে পাওয়া অসম্ভব। সুতরাং, যদি আমরা এমন শিল্পীদের জীবনযাত্রা অধ্যয়ন করি যাঁরা শিল্প জগতের একটি স্থান খুঁজে পেয়েছেন তবে তাদের পেশাগত জীবনে কয়েক বছরের মধ্যে আমরা হঠাৎ বিরতি পাব। সম্ভবত তারা মায়ের মতো বাচ্চাদের অথবা নতুন পরিবারের মধ্যে নতুন ভূমিকা রাখতে কিংবা তাদের স্বামীর পেশাকে অগ্রাধিকার দেওয়ার জন্য অলক্ষ্যে নিজেকে ব্যস্ত রাখার চেষ্টা করছেন।

প্রদর্শনীতে বাংলাদেশি নারী শিল্পীগণ

প্রথমবার আমরা শুনলাম যে, এক বৃহৎ সংখ্যক নারী শিল্পী কলকাতায় ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে এক শিল্প প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করেছিলেন, যেটা ছিল 'ফাইন আর্ট একজিবিশন'। পঁচিশ জন নারী শিল্পী ওই শিল্প প্রদর্শনে অংশগ্রহণ করেছিলেন এবং তাদের মধ্যে বেশির ভাগই ছিলেন বাঙালি নারী। ১৯৩৯ খ্রিষ্টাব্দে ক্যালকাটা গভর্নমেন্ট আর্ট স্কুলে ১৭ জন নারীকে ছাত্রী হিসেবে নথিভুক্তির সুযোগ দেওয়া হয়েছিল এবং তারা এটা খুশির সঙ্গে গ্রহণ করেছিলেন। অপর্ণা রায় নারীদের মধ্যে প্রথম ব্যাচের ছাত্রী ছিলেন এবং তিনি ওই স্কুলেরই শিক্ষিকা হয়ছিলেন। যদিও আমরা সেইসব নারীদের সঙ্গে শিল্পক্ষেত্রে পেশাদারিত্বের সঙ্গে পেশাদার শিল্পীদের জিনিসপত্র ও কৌশল নিয়ে কাজ শুরু করার আগে সাক্ষাৎ করি এবং তারা তাদের কাজের ব্যক্তিগত গুণাগুণ জানায়। বলাই বাহুল্য, এটা বলা যায়না যে, তারা পারিবারিক কাজকর্মের পাশাপাশি শিল্পকর্মের অভ্যাস করে। সম্ভবত এজন্যে যে, তাদের কাজের মধ্যে অসাধারণত্ব আছে। যাইহোক, এপর্যন্ত নারীদের অভ্যাসের ফলে তৈরি শিল্পকর্ম একটা অন্য জগতের এবং তার অন্য উদ্দেশ্য ছিল। এর ফলে নানা অসঙ্গতির মধ্যেও নারী শিল্পীদের শিল্পকর্মগুলো তাদের নিজেদের জগৎ খোঁজার ইচ্ছা প্রকাশ করে। এটা মনে রাখা দরকার যে, নারীদের এই নতুন ক্ষেত্রে পদচারণা ছিল প্রায় অনধিকার প্রবেশের মতো, কেননা, পরিবারের চৌহদ্দির বাইরে এটা বিশ্ব জনগণের মোকাবেলা করার সুযোগ তৈরি করেছিল।

ঔপনিবেশিক যুগ

এদেশে ব্রিটিশ আগমনের ফলে ব্যক্তিগত উপলব্ধি এবং বিশ্লেষক দৃষ্টিভঙ্গির ক্ষেত্রে বাঙালি জীবনচর্যায় একটা বদলের ছবি লক্ষ করা যায়। সম্ভবত নারীদের এই উদ্দীপনাময় প্রেরণার উৎস থেকে, পুরুষরা একটা মাধ্যম পেয়ে গিয়েছল যা থেকে তাদের সৃষ্টিশীলতা প্রকাশ পেয়েছিল। এটা একটা যুগসন্ধিক্ষণ হিসেবে কাজ করেছিল, যখন উনিশ শতকের সময়কালে পারিবারিক পরম্পরাগত কাজকর্মের বদলে বাংলর উঁচুতলার জনগণের শিল্পকলা একটা নতুন আঙ্গিকে প্রবেশ করেছিল। তখনই সৃষ্টি হয়েছিল নতুন শিল্প ব্যক্তিত্ব, যার ফলে শিল্প প্রদর্শনী, জনতার শিল্প সংস্থা, শিল্প শিক্ষালয়সমূহ এবং ব্রিটিশদের সংগঠিত শিল্প সম্পর্কিত লেখালেখির উদ্যোগ। নিচু জাতের চিত্রকর (শিল্পী), ভাস্কর (খোদাইকারী), কুমোর (কুম্ভকার), মালাকার (মালা প্রস্তুতকারক) থেকে তারা একটা আলাদা ব্র্যান্ডের জনগণ হিসেবে পরিগণিত হয়েছিল। সাধারণ ব্যক্তি থেকে তারা একটু আলাদা, বুদ্ধিমান, শিক্ষিত এবং অনন্য। তারা জ্ঞানদীপ্ত সৃষ্টিকারী। এই সঙ্গে যদিও নারীরাও শিশু এবং অন্যান্য বিশিষ্ট পরিবারের সঙ্গে ওই শিল্পের মূল প্রবাহের তালে তাল মিলিয়ে চলেছিল। যদিও পুরুষেরা পেশাদারিত্বে আকাঙ্ক্ষিত, বৃহত্তর, নামজাদা এবং সমৃদ্ধ শিল্পী ছিলেন। নারীরা সেলাই, বোনা, রান্না অথবা আল্পনা আঁকার পরিবর্তে হঠাৎই সৃষ্টির সম্ভাবনা দেখে এই শিল্পমাধ্যমে প্রবেশ করেছিল। এতে নারীদের পেশাদারিত্ব, সম্পদ এবং খ্যাতির আশা ছিলনা, কেননা, সেই সব পথ তাদের জন্যে তখনো বন্ধ ছিল। অপরপক্ষে, নারীরা নতুন উন্মুক্ত শিল্পের জগতে প্রবেশ করেছিল তাদের নিজেদের আশা এবং জীবন দর্শন নিয়ে। পশ্চিমি শিল্পের ইতিহাসে যাকে 'গৌন শিল্প' বলা হয়, সেই শিল্পের অবস্থান থেকে বেরিয়ে নারীদের স্বীকৃত মূলস্রোতের মাধ্যমে কাজ করতে দেখা যেত। এই প্রসঙ্গে জার্মেইন গ্রিয়ারের বক্তব্য খুবই তাৎপর্যপূর্ণ। নারী চিত্রশিল্পীদের সম্পর্কে তার বক্তব্য হল, এমনকি যদিও এটা খুব মহান নারী শিল্প নয়, এই নারী শিল্প সংশ্লিষ্ট নারীবাদী এবং শিক্ষার্থীদের স্বার্থে প্রকাশ পায়, এটা কিনা নিপীড়িত ব্যক্তিত্বের দারিদ্র্য দেখায়, আত্মনিয়ন্ত্রণে অকার্যকর শিল্পীর নকশা, আত্মশক্তির মুখবিকৃত অন্তর্মুখিতা অথবা আকস্মিক এর অব্যক্ত জিনিসে বিদ্রোহের ঝলকানি, অথবা এর সবগুলোই ঘটে। যেটা কিনা নারীর সৃষ্টিশক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়ার কারণ হয়না কিংবা পারেনা, অধিকাংশ সময়ে চিত্রশিল্প, কিন্তু তথাকথিত গৌন শিল্পতে কখনো প্রকাশিত না-হয়ে দূরে থেকে যায়। নারী শিল্পীরা আদতে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নিজেদের ব্যক্তিগতভাবে প্রকাশ না-করে সমাজ এবং জীবনের সঙ্গে যুক্ত শিল্পে নিবেদিত হয়ে কাজ করেছেন। এটা যেন তাদের সামাজিক মূল্যবোধ এই চিন্তা করতে শেখায় যে, শিল্প হল জীবনের দিকনির্দেশ, যেটা যাদুঘর অথবা বাজারের পণ্য থেকে আলাদা করা দরকার। এটা হল খুব প্রাচীন মাতৃতান্ত্রিক সমাজের ভক্তি আচার ব্রতের মতো, যেখানে সমাজ এবং পরিবারের মঙ্গলের জন্যে শক্তি নিয়ন্ত্রিত হোত। নিজেকে বাদ দিয়ে মানব সমাজের উন্নয়নে নারী খুবই কার্যকরী ভূমিকা নিয়েছিল।

আধুনিক যুগ

আমরা অল্প কয়েকজন নারী শিল্পীর নাম জানি। অথচ বেশির ভাগ ক্ষেত্রে শিল্পের কাজ শিল্পীর সঙ্গেই চলে। কারণটা হল এই যে, নারীরা তাদের অন্যান্য পারিবারিক দায়িত্ব পালনের পাশাপাশি একটা শখ হিসেবে শিল্প সৃষ্টি করে থাকেন। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে তারা শিল্পের প্রতি পুরোপুরি নিবেদিতপ্রাণ নন। এভাবেই, পুরুষদের তৈরি শিল্পকর্মের থেকে তাদের সংখ্যা কম। এজন্যে তাদের কাজ সম্পর্কে ধারণা করা কষ্টকর। আমরা তাদের কাজ সম্পর্কে শুনতে পাই কিন্তু তাদের কাজ দেখার সম্ভাবনা কম। এটা কেন কী নারী শিল্পীরা বেশির ভাগ অজানা, অস্বীকৃত, অবিশ্লেষিত এবং অমূল্যায়িত। যখন নারী তার অনন্যসাধরন গুণমান প্রমাণ করেন, তার ব্যক্তিত্ব তার কাজকে প্রভাবিত করে এবং তা গুরুত্ব পায়। তার কাজ শুধুই তার ব্যক্তিত্বের ঘটনা। এসবই বিবেচনার মধ্যে আসে যখন নারী শিল্পীদের কাজের মূল্যায়ন করা হয়, অথবা অন্যথায় বাংলা এবং বিশ্বের আধা জনগণের কাজকে অবহেলা করা হয়। এটা লক্ষ করা দরকার যে, বেশির ভাগ নারী শিল্পী এসেছেন শিক্ষিত উচ্চ অথবা মধ্যবর্গের পরিবারগুলো থেকে। দেশ ভাগের আগেকার কিছু বাঙালি নারী শিল্পী সম্পর্কে এক সংক্ষিপ্ত আলোচনা নিচে দেওয়া হয়েছে:

গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী (১৮৫৮-১৯২৪)

গিরিন্দ্রমোহিনী দাসী কলকাতায় জন্মেছিলেন। তার পিতা ছিলেন হারাণ চন্দ্র মিত্র। তিনি কবিতা লিখেছেন এবং ছবি এঁকেছেন। তিনি দেবদেবীর এবং প্রাকৃতিক চিত্রাদি সম্পন্ন করেন। ভাইসরয়ের স্ত্রী লেডি মিন্টো তার আঁকা একটা ছবি দেখেছিলেন এবং সেটা অস্ট্রেলিয়াতে এক প্রদর্শনীতে পাঠিয়েছিলেন। ভারতী, মানসী এবং মর্মবাণী পত্রিকায় তার আঁকা ছবিগুলো তার নিজের লেখা কবিতায় ছাপা হয়েছিল।

সুচারু দেবী (১৮৭৪-১৯৫৯)

সুচারু দেবী ময়ূরভঞ্জের মহারানি ছিলেন। তিনি কেশব চন্দ্র সেন এবং জগন্মোহিনী দেবীর তৃতীয় কন্যা ছিলেন। তিনি শর্ট নামে এক ইউরোপীয় শিক্ষিকার কাছে তেল রঙে ছবি আঁকা শিখেছিলেন। শ্রীরাম চন্দ্র ভঞ্জ দেওয়ের সঙ্গে বিবাহের পর তিনি শিল্প সম্পর্কে আরো উৎসাহী হন এবং ইউরোপে গিয়ে পশ্চিমি শিল্পের অভিজ্ঞতা অর্জন করেন। তিনি তেল রঙে প্রাকৃতিক দৃশ্যের চিত্রশিল্পে দক্ষ ছিলেন। তার শিল্পকর্মের সংগ্রহে ভক্তি-অর্ঘ্যশে (চিত্র 1.10) তার পিতার শৈশবের চিত্রকল্প অঙ্কিত আছে। সুনয়নী দেবীর বক্তব্যে তার স্বামী এবং সন্তানের মৃত্যুতে দুঃখের এবং একাকীত্বের যন্ত্রণা তার চিত্রশিল্পে ফুটে উঠেছে...

সুনয়নী দেবী (১৮৭৫-১৯৬২)

সুনয়নী দেবী জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথের ভগিনী ছিলেন। তার স্বামী রজনীমোহন চট্টোপাধ্যায় একজন অ্যাটর্নি ছিলেন। তার শিল্প শিক্ষার জন্যে কোনো শিক্ষক ছিলনা। তিনি তার সহোদরদের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়ে শিল্পের জগতে যাত্রা শুরু করেন, কিন্তু ত্রিশ বছর বয়সে পৌঁছানোর পরই তার কাজের বহর বাড়তে থাকে। বিবাহের পর তার যৌথ পরিবারের কাজকর্ম, যেমন সন্তানদের, স্বামীর দেখাশোনার পাশাপাশি শিল্পকর্মের অভ্যাস করতে থাকেন। তার জলরঙের চিত্রশিল্পের মধ্যে পৌরাণিক দেবদেবীদের, কৃষ্ণ, রামায়ণ এবং মহাভারত ইত্যাদি বিষয়বস্তু ছিল। তার কাজের বিষয় ছিল বাঙালি ঘরকন্না এবং নারীর প্রতিকৃতি। কমল সরকার বলেছিলেন যে, 'তার চিত্রগুলো কার্যকর হয়ছিল চিরন্তন স্থানীয় ধারায় পটচিত্রের ওপর ভিত্তি করে।' দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরয়েন্টাল আর্ট ইউরোপে তার চিত্রশিল্পের অসংখ্য প্রদর্শনীর আয়োজন করেছিল কিন্তু তার জীবৎকালে নিজ দেশে একটাও শিল্প প্রদর্শন হয়নি। তার চিত্রশিল্পের মধ্যে যে লোকশিল্পের অনুপ্রেরণা আমরা উপলব্ধি করি (চিত্র 1.10) পরবর্তীকালে সেই বিশ্লেষণ পুরোপুরি ছিল জামিনী রায়ের। এটা হয়েছিল সম্ভবত তিনি নিজেকে একজন মহান শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করতে চাননি, যে পরীক্ষানিরীক্ষা এবং মৌলিকত্ব জোরালোভাবে তার শিল্পকর্মে উপস্থিত ছিল। ফেলে-দেওয়া কার্ডবোর্ড থেকে নোটবইয়ের মোড়কের তিনি একজন ফলপ্রসূ ব্যবহারকারী ছিলেন। এই বিষয়ে তার সহজ এবং স্বতঃস্ফূর্ত মনোভাব প্রকাশ পেয়েছিল। কিশোর চ্যাটার্জি মন্তব্য করেছিলেন, '...সুনয়নী দেবী সরাসরি অন্তর থেকে ছবি আঁকতেন এবং তার মাতৃতান্ত্রিক কর্তব্যকর্ম তার নিরীহ আনন্দের চিত্রশিল্প সৃষ্টিতে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি, একটা শিল্প যার সৌন্দর্য ছিল সম্পূর্ণ দাম্ভিকতা ছাড়া এবং নিতান্তই আসল।

মেহেরবানু খানম (১৮৮৫-১৯২৫)

মেহেরবানু খানম ঢাকার নবাব পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার আব্বার নাম নবাব স্যর আশানুল্লা এবং আম্মার নাম কামরুন্নেষা খানম। কলকাতা থেকে প্রকাশিত মোসলেম ভারত পত্রিকায় ছাপার জন্যে মেহেরবানু তার একটা চিত্রশিল্প পাঠিয়েছিলেন। এটা জানা যায় যে, কবি কাজি নজরুল ইসলাম ওই চিত্রটা দেখে তার 'খেয়াপারের তরণী' কবিতাটা লিখেছিলেন। যে সময়কাল এবং পরিবারে মেহেরবানু জন্মেছিলেন এবং বড়ো হয়ে উঠেছিলেন, তার রক্ষণশীল পরম্পরা তার অঙ্কিত চিত্রকে অতি অপ্রত্যাশিত করে দিয়েছিল (চিত্র 1.11)। সম্ভবত ধর্মীয় করণে তিনি কোনো জীবন্ত ব্যক্তির চিত্রাঙ্কনের রূপ দিতে পারেননি। নবাব পরিবারের সংগৃহীত চিত্রশিল্পগুলো তার দেখার অভ্যাস ছিল। তার আব্বা খুবই সংস্কৃতিমনস্ক ছিলেন, সম্ভবত সেই জন্যেই শিল্পের প্রতি তার আগ্রহ বৃদ্ধি পেয়েছিল। মোসলেম ভারতে প্রকাশিত দুটো চিত্রশিল্প ভিন্ন তার আর কোনো শিল্পকর্মের খোঁজ পাওয়া যায়নি। ওই দুটো চিত্রশিল্পই ছিল প্রাকৃতিক দৃশ্যের। সৈয়দ এমদাদ আলি লিখেছেন যে, মেহেরবানু খানম ছ-মাসের জন্যে চিত্রশিল্পের পাঠ নিয়েছিলেন। মেহেরবানু গৃহস্থালির শত কাজের মধ্যেও শিল্পে মনোনিবেশ করেছিলেন।

সুখলতা রাও (১৮৮৬-১৯৬৯)

সুখলতা রাও ছিলেন উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরী এবং বিধুমুখী দেবীর জ্যেষ্ঠ কন্যা। তিনি তার পিতার কাছে চিত্রশিল্পের শিক্ষা পেয়েছিলেন এবং পুরাণ, রামায়ণ ও মহাভারতের দৃশ্য এবং চরিত্রগুলোর চিত্রাঙ্কন করেছিলেন। প্রবাসী, মর্ডান রিভিউ, সুপ্রভাত, সন্দেশ, চ্যাটার্জিজ পিকচার অ্যালবাম এবং অন্যান্য পত্রিকায় তার চিত্রকর্মগুলো প্রকাশিত হয়েছিল।

হাসিনা খানম (জন্ম ১৮৯২)

হাসিনা খানমকে বাংলা আকাদেমি প্রকাশিত চরিতাভিধানে প্রথম মুসলমান নারী শিল্পী হিসাবে গণ্য করা হয়েছে। স্বাগত, বসুমতী ইত্যাদি পত্রিকায় তার অঙ্কিত কিছু জলরং এবং স্কেচ প্রকাশিত হয়েছল। তার জন্মস্থান, জন্ম তারিখ; মৃত্যুস্থান এবং তারিখ জানা যায়নি।

প্রতিমা দেবী (১৮৯৩-১৯৬৯)

প্রতিমা দেবী (চিত্রশিল্পী) তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম শেষেন্দ্রভূষণ চট্টোপাধ্যায় এবং মা বিনয়িনী দেবী। তার দাদামশাই ছিলেন গুণেন্দ্রনাথ ঠাকুর। গগনেন্দ্রনাথ, সমরেন্দ্রনাথ এবং অবনীন্দ্রনাথ ছিলেন তার মামা এবং সুনয়নী দেবী ছিলেন তার মাসিমা। রবীন্দ্রনাথের পুত্র রথীন্দ্রনাথের সঙ্গে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং পরবর্তীকালে রবীন্দ্রনাথ প্রতিষ্ঠিত 'বিচিত্রা' শিক্ষাঙ্গনে তিনি চিত্রশিল্প শিক্ষা করেন। নন্দলাল বসু ছিলেন তার শিক্ষক। তিনি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের খুব প্রিয়পাত্রী ছিলেন এবং তার সঙ্গে অনেক দেশ ভ্রমণ করেছিলেন। ফলস্বরূপ, তার শিল্পী জীবনের আন্তর্জাতিক শিল্পকর্ম সম্পর্কে বিশিষ্ট ধারণা তৈরি হয়েছিল। তিনি প্যারিসে দেয়ালচিত্র, চিনেমাটি এবং বুটিকের কাজের শিক্ষা পেয়েছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে লন্ডনে তার এক শিল্প প্রদর্শনী হয়েছিল। তার শিল্পী হিসেবে কাজের থেকেও শান্তিনিকেতনে তার অবদানের জন্যে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিলেন। তিনি একেবারে নিজস্ব ধারায় নাটকের মঞ্চ এবং পোশাকাদির নকশা তৈরি করতেন। তিনি রবীন্দ্রনাথের নাটকের চরিত্রচিত্রণে বিশেষভাবে দক্ষ ছিলেন। নৃত্য এবং গীতের মাধ্যমে তিনি নিজের শৈল্পিক ব্যক্তিত্বের উন্নতিসাধন করেছিলেন। যদিও তার প্রথম দিকের চিত্রশিল্পে জাপানি প্রভাব লক্ষ করা যায়, পরবর্তীকালে তিনি বাংলা স্কুলের ধারায় চিত্রাঙ্কন করেছিলেন। তিনি বাংলা স্কুলের ব্যাখ্যামূলক দিক নিয়ে কাজ করে তাকে স্বাভাবিক চরম অবস্থায় উন্নীত করেন (চিত্র 1.13)। তিনি ধারাবাহিকভাবে প্রয়োগমূলক শিল্পের পরীক্ষানিরীক্ষা করেছিলেন। কিশোর চ্যাটার্জির মতে, চিত্রকর হিসেবে শান্তিনিকেতনের যৌথ আবেগের কাছে তিনি তার সৃষ্টিশীলতাকে দমন করেছিলেন।

শান্তা দেবী (১৮৯৩-১৯৮৪)

শান্তা দেবী কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতা রামানন্দ চ্যাটার্জি ছিলেন প্রবাসী, মর্ডান রিভিউ এবং বিশাল ভারত পত্রিকার সম্পাদক; তারা মায়ের নাম মনোরমা দেবী। তার পারিবারিক পরিবেশ এরকম ছিল যে তিনি ছোটোবেলা থেকেই লেখা ও আঁকা শুরু করেছিলেন। তিনি অবনীন্দ্রনাথ এবং নন্দলাল বসুর কাছে চিত্রাঙ্কন শিখেছিলেন। পরবর্তীতে তিনি শান্তিনিকেতনে নন্দলাল বসুর তত্ত্বাবধানে চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করেন। সেখানে তিনি আন্দ্রে কার্পেলেসের তত্ত্বাবধানে তেলরঙের কলাকৌশল শিক্ষালাভ করেন। শান্তা দেবী ভারতীয় ধারায় চিত্রাঙ্কন করতেন কিন্তু বিষয় নির্বাচনে একান্ত নিজস্বতা ছিল (চিত্র 1.12)। তিনি এসরাজ বাজাতেন, লেখাজোখা করতেন এবং নকশিকাঁথা (কাঁথা সূচিশিল্প) সেলাই করতেন। তার চিত্রশিল্পের প্রদর্শনী হয়েছিল কলকাতা, মাদ্রাজ (চেন্নাই) এবং রেঙ্গুনে (ইয়াঙ্গন)। কলকাতার বিড়লা আকাদেমিতে যখন তার চিত্রাঙ্কন ও অন্যান্য শিল্পের প্রদর্শনী হয়েছিল তখন তার বয়স ছিল প্রায় নব্বই বছর।

সুকুমারী দেবী (মৃত্যু ১৯৩৮)

সুকুমারী দেবীর পিতা রামকুমার মজুমদার ছিলেন চনপুর-কুমিল্লার অন্তর্গত বোরোদিয়ার জমিদার এবং তার মায়ের নাম আনন্দময়ী দেবী। সুকুমারী দেবী চোদ্দো বছর বয়সে বিধবা হন এবং তার তিন বছর পর শ্রীনিকেতনের কালীমোহন ঘোষের অনুপ্রেরণায় তিনি শান্তিনিকেতনে যান। সূচীশিল্প এবং আল্পনায় তার দক্ষতার কারণে রবীন্দ্রনাথ নন্দলালকে নির্দেশ দেন যাতে সুকুমারী দেবীকে কলাভবনের শিক্ষিকা হিসেবে নিয়োগ করা হয়। অধিকন্তু তিনি নন্দলালের কাছে চিত্রাঙ্কনের শিক্ষাও নেন। পুরাণ থেকে দেবদেবীর উপাখ্যান তার চিত্রশিল্পের মূল বিষয়বস্তু ছিল। কমল সরকারের ভাষ্য অনুযায়ী তার চিত্রশিল্প উজ্জ্বল রং এবং মোটা রেখায় নিবদ্ধ এবং খানিক সাজানো ছিল। আল্পনা এবং অন্যান্য কারুশিল্পে তিনি অতিশয় দক্ষ ছিলেন।

প্রকৃতি চট্টোপাধ্যায় (১৮৯৫-১৯৩৪)

প্রকৃতি চট্টোপাধ্যায় ছিলেন চিত্রশিল্পী জলধিচন্দ্র (চিত্র 1.12) এবং শান্তা মুখোপাধ্যায়ের কন্যা, যিনি ছিলেন যতীন্দ্রমোহন ঠাকুরের নাতি। তিনি দেবী দৃশ্য, কৃষ্ণলীলা থেকে পুতুল সমেত শিশু, বুদ্ধের জীবন এবং জলরঙে রবীন্দ্রনাথের গল্পের চিত্রাঙ্কন করেছিলেন। তিনি প্লাস্টার অফ প্যারিস, রেশমের ওপর চিত্রশিল্প, ল্যাকার এবং এনামেলের কাজে দক্ষ ছিলেন। তার সূচীশিল্প এবং আল্পনার কাজ প্রকাশনায় দৃশ্যমান হয়েছিল।

ইন্দুরানি সিনহা (জন্ম ১৯০৫)

ইন্দুরানি সিনহা কলকাতায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম অক্ষয় কুমার মিত্র এবং মা রাজলক্ষ্মী দেবী। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে তিনি চিত্রশিল্পী সতীশ চন্দ্র সিনহার সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং তার প্রায় ষোলো বছর পর তার স্বামীর তত্ত্বাবধানে চিত্রাঙ্কনের কাজ শুরু করেছিলেন। তিনি তেলরং, জলরং এবং প্যাস্টেলে কাজ করতেন। তিনি প্রকৃতিক দৃশ্য, গ্রাম্য জনগণ, এবং নগ্ন ও পোশাকি চিত্রশিল্পে পারদর্শী ছিলেন। ১৯৪১ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নারীদের জন্যে এক বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

গৌরী ভঞ্জ (জন্ম ১৯০৭)

গৌরী ভঞ্জ হলেন নন্দলাল বসু এবং সুধীরা দেবীর কন্যা। তিনি শান্তিনিকেতনের কলাভবনে চিত্রাঙ্কন এবং হস্তশিল্পের শিক্ষালাভ করেছিলেন। যখন হস্তশিল্প বিভাগের শিক্ষিকা সুকুমারী দেবীকে অসুস্থতার জন্যে শান্তিনিকেতন ছাড়তে হয়েছিল, সেই সময় গৌরী দেবী ওই বিভাগের দায়িত্ব নিয়েছিলেন এবং প্রায় দীর্ঘ তেত্রিশ বছর শিক্ষকতা করেছিলেন। তিনি আল্পনা, সূচীশিল্প, বাটিক, চর্মশিল্প এবং অন্যান্য হস্তশিল্পে অত্যন্ত দক্ষ ছিলেন। তার শিক্ষকতকালীন সময়েই কলাভবনে বাটিক শিল্পের প্রচলন হয়েছিল এবং এই শিল্পমাধ্যমে তার অবদান ছিল উল্লেখযোগ্য। রবীন্দ্রনাথের জীবৎকালে বিভিন্ন অনুষ্ঠানাদিতে সাজসজ্জার ব্যাপারে তার মুখ্য ভূমিকা ছিল।

ইন্দিরা দেবী রায়চৌধুরী (১৯১০-১৯৫০)

ইন্দিরা দেবী রায়চৌধুরী ছিলেন গোপালপুর, টাঙ্গাইলের শ্রীশচন্দ্র ভট্টাচার্য এবং বিনোদিনী দেবীর কন্যা। গৌরীপুর, ময়মনসিংহের গায়ক কুমার বীরেন্দ্র কিশোর রায়চৌধুরীর সঙ্গে ইন্দিরা দেবী বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়েছিলেন। বিবাহের পর তিনি ক্ষিতীন্দ্রনাথ মজুমদারের কাছে চিত্রাঙ্কন শিক্ষা করেন এবং অতুল বসুর কাছে অবয়ব চিত্রাঙ্কনের পাঠ নিয়েছিলেন। তেল এবং জলরঙে অঙ্কিত তার চিত্রের অনেক প্রদর্শনী হয়েছিল। কলকাতার আকাদেমি অফ ফাইন আর্টসের একাদশ বার্ষিক প্রদর্শনীতে ভারতীয় ধারার চিত্রাঙ্কন বিভাগে তিনি নারীদের মধ্যে শ্রেষ্ঠ পুরস্কার পেয়েছিলেন।

ইন্দুসুধা ঘোষ

ইন্দুসুধা ঘোষ চিত্রশিল্পের প্রথম পাঠ পেয়েছিলেন ময়মনসিংহের একজন আলোকচিত্রীর কাছ থেকে। নন্দলাল বসু অধ্যক্ষ থাকাকালীন সময়ে ১৯২৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়েছিলেন এবং সেখানে অঙ্কন এবং হস্তশিল্পের পাঠাভ্যাস করেছিলেন। তিনি চিত্রশিল্প, সাজসজ্জা এবং সূচীশিল্পে সফলতা পেয়েছিলেন। শান্তিনিকেতনের শিল্পীদের প্রতিষ্ঠিত 'কারুসংঘ' নামে এক সংস্থার তিনি একমাত্র নারী সদস্য ছিলেন। কলাভবনের পাঠ সম্পূর্ণ করে তিনি শ্রীনিকেতনে শিক্ষিকা হিসেবে যোগদান করেন। নন্দলাল বসুর নির্দেশক্রমে তিনি ১৯৩১ থেকে ১৯৩২ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত কলকাতার নিবেদিতা গার্লস স্কুলে শিল্প শিক্ষাদানের কাজ করেছিলেন। বিপ্লবী কাজকর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকার কারণে তাকে পাঁচ বছরের জন্যে কারাবাস করতে হয়েছিল। পরবর্তী জীবনে দরিদ্র নারীদের মধ্যে আত্মনির্ভরতা বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে তিনি মহিলা শিল্প শিক্ষালয় এবং নারী সেবা সংঘের সঙ্গে কাজ করেছিলেন।

হাসিরাশি দেবী

হাসিরাশি দেবী বর্তমান উত্তর চব্বিশ পরগনার গোবরডাঙায় জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা অবিভক্ত দিনাজপুরের একজন আইনজীবী ছিলেন। শিশুকাল থেকেই তার শিল্পের প্রতি অনুরাগ ছিল এবং অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে তার পরিচয় হয়েছিল। তার অনেক চিত্রশিল্পের মধ্যে তার একমাত্র কন্যার মৃত্যুতে বিষাদের অভিব্যক্তির প্রকাশ পেয়েছিল। তার চিত্রশিল্প ভারতবর্ষ, মাসিক বসুমতী, বিচিত্রা, জয়শ্রী, প্রবর্তক ইত্যাদি পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল। তার রসাত্মক গল্পসমূহ এবং সেগুলোর ব্যঙ্গচিত্রের জন্যে তিনি অত্যন্ত জনপ্রিয় হয়েছিলেন।

যমুনা সেন (জন্ম ১৯১২)

যমুনা সেন হলেন নন্দলাল বসুর কনিষ্ঠা কন্যা। তিনি ছ-বছর ধরে শান্তিনিকেতনের কলাভবনে তার পিতার তত্ত্বাবধানে চিত্রশিল্প, দেয়ালচিত্র, মডেলিং এবং লিনোকাট শিক্ষা করেছিলেন। তিনি আল্পনা, সূচীশিল্প এবং বাটিক শিল্পে দক্ষ ছিলেন। তিনি কলাভবনের হস্তশিল্পের একজন শিক্ষিকা ছিলেন। তার চিত্রশিল্প বিভিন্ন মাসিকপত্রে প্রকাশিত হয়েছিল।

রানি চন্দ (জন্ম ১৯১২)

রানি চন্দ হলেন মুকুল চন্দ্র দে মহাশয়ের ভগিনী। তিনি মেদিনীপুরে জন্মগ্রহণ করেন। রানি চন্দ ১৯২৮ খ্রিষ্টাব্দে কলাভবনে এসেছিলেন এবং সৌভাগ্যক্রমে নন্দলাল বসু এবং অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের তত্ত্বাবধানে চিত্রশিল্প অধ্যয়ন করেছিলেন। তিনি জলরং, টেম্পারা, ক্রেয়ন, চক, উডকাট এবং লিনোকাট মাধ্যমে কাজ করেছিলেন। 'ভারত ছাড়ো' আন্দোলনে যুক্ত থাকার জন্যে তাকে কারাবরণ করতে হয়েছিল।

চিত্রনিভা চৌধুরী

চিত্রনিভা চৌধুরী ১৯১৩ খ্রিষ্টাব্দে মুরশিদাবাদে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতার নাম ডা. ভগবান চন্দ্র বসু এবং মা শরৎকুমারী দেবী। তার পৈত্রিক নিবাস ছিল চন্দ্রপুর, ত্রিপুরা। ১৯২৭ খ্রিষ্টাব্দে তিনি নোয়াখালির নিরঞ্জন চৌধুরির সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন। বিবাহের পর তার স্বামীর উৎসাহে নন্দলাল বসুর অধ্যক্ষ থাকাকালে কলাভবনে মোটামুটি বছর পাঁচেক চিত্রশিল্প অধ্যয়ন করেছিলেন। ১৯৩৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি তার পাঠ শেষ করেন এবং কলাভবনে শিক্ষকতা করে এক বছর পর ছেড়ে দেন। প্রাচীন ভারতীয় সাহিত্যের উপাখ্যান এবং চরিত্রসমূহ তার চিত্রশিল্পের বৈশিষ্ট্য ছিল। গ্রাম বাংলা এবং দেশীয় জীবনপ্রবাহ তার কাজের মধ্যে অঙ্গীভূত ছিল। তার বেশির ভাগ শিল্পসৃষ্টিই জলরং এবং প্যাস্টেলের উপস্থাপনা ছিল।

কামিনী সুন্দরী পাল

কামিনী সুন্দরী পাল হলেন শশীভূষণ পালের স্ত্রী, যিনি ১৯৪০ খ্রিষ্টাব্দে মহেশ্বরপাশা স্কুল অফ আর্ট প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কামিনী দেবী সূচীশিল্পের শিক্ষিকা হিসেবে ওই স্কুলে যোগদান করেন। এমব্রয়ডারি চিত্রশিল্পের জন্যে তিনি স্বীকৃতি পেয়েছিলেন। তার কোনো প্রাতিষ্ঠানিক ট্রেনিং ছিলনা। তিনি খুলনার খালিশপুরে ১৮৮৩ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার পিতার নাম রাইচন দাস। তার চিত্রশিল্পের বিষয় ছিল বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিকৃতি এবং পলাশির যুদ্ধের মতো ঐতিহাসিক ঘটনা।

১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে ভারত বিভাগের পর, যে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্ট নামে পরিচিত, ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে সেটা 'গভর্নমেন্ট ইন্সটিটিউট অফ আর্টস' নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। ১৯৫৪-৫৫ শিক্ষাবর্ষে এই প্রতিষ্ঠানে প্রথম যে পাঁচজন নারী ভরতি হয়েছিলেন তারা হলেন: তাহেরা খানম, রওশন আরা, হাসিনা আলি, জুবেইদা আখতার খাতুন এবং সয়িদা ময়ীনা এহসান। ময়ীনা এহসান ছাড়া সকলেই তাদের পাঁচ বছরের শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ করেছিলেন। জুবেইদা আখতারকে বাদ দিয়ে এই সকল নারীই শহরের এবং শিক্ষিত পরিবারসমূহ থেকে এসেছিলেন। এটা জানা যায় যে, তাদের শিল্পজগতে প্রবেশের ব্যাপারে তাদের পরিবারবর্গ থেকে কোনোরকম বাধা আসেনি। তাহেরা খানম পরবর্তীতে স্বনামধন্য শিল্পী কায়ুম চৌধুরীর সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হন এবং অঙ্কনকার্য জারি রাখেন (চিত্র 1.15)। এটা মানতেই হয় যে, এই নারীরা খুবই সাহসী এবং আত্মবিশ্বাসী ছিলেন, কেননা, তৎকালীন সমাজের ছুঁৎমার্গকে উপেক্ষা করে তারা এরকম অস্বাভাবিক একটা অধ্যয়নের বিষয় নির্বাচন করেছিলেন। এটাও সত্যি যে, পরবর্তীকালে যে নারীগণ শিল্প শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পাঠ নিয়েছিলেন তারা তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মধ্যে নিজেদের শিক্ষার দৃশ্যমান প্রয়োগ করেননি। অনেকে তাদের শিক্ষাক্রমের অধ্যয়ন সম্পূর্ণ করতে পারেননি। শিল্পাভ্যাসের মূলস্রোতের সঙ্গে সামাজিক এবং পারিবারিক দায়িত্বকে মেলানো নারীদের পক্ষে খুব সহজ কাজ ছিলনা। আসলে যে সমস্ত নারী সমাজ ও পরিবারের কাজকর্ম সম্পূর্ণ করে সময় বের করতে পারতেন তারাই মূলস্রোতের শিল্পে অবদান রাখতেন। এব্যাপারে এদেশে নবেরা আহমেদ হলেন একজন ব্যতিক্রমী ব্যক্তিত্ব। ১৯৫৬ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ইংল্যান্ড থেকে ভাস্কর্যে ডিপ্লোমা অর্জন করে দেশে ফিরে আসেন। তিনি যে ভাস্কর্য অভ্যাস করতেন তা শুধু প্রচারই হোত না; এমনকি ধর্মীয় বিতর্কও দেখা দিত। তার ঐকান্তিকতা এবং আত্মোৎসর্গের ফলে তার ভাস্কর্য এগিয়ে চলে। তিনি সিমেন্ট এবং লোহার রডের মতো অসাধারণ সব জিনিস নিয়ে গবেষণা করতেন। যাই হোক, তিনি লোকবিষয় এবং ধারা নিয়ে নানা পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়েছিলেন (চিত্র 1.14)। প্রথম ভাস্কর্য প্রদর্শনী, প্রথম বহির্দ্বার ভাস্কর্য এবং ঢাকায় এক গণমঞ্চে প্রথম সৃষ্ট দেওয়াল ভাস্কর্য সবই তার পক্ষে গিয়েছিল। ভাষা আন্দোলনের শহিদদের স্মারকস্তম্ভ, জাতীয় শহিদ মিনার সৃষ্টিতেও তিনি যুক্ত ছিলেন। ১৯৫৬ এবং ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দের মধ্যবর্তী সময়ে ঢাকায় এই সমস্ত বৈপ্লবিক ঘটনার কারণে এবং উপযুক্ত পৃষ্ঠপোষকতার অভাবে তিনি তদানীন্তন পশ্চিম পাকিস্তানে গিয়েছিলেন। যাই হোক, লোকপ্রবণতা এবং আন্তর্জাতিকতাবাদের সংমিশ্রণে সাম্প্রতিক পশ্চিমি শিল্প সম্পর্কে তার স্বচ্ছ ধারণা তাকে নতুন শিল্প সম্ভাবনার দ্বার উন্মুক্ত করার পথে দৃঢ় পদক্ষেপ করতে সহায়ক হয়েছিল। সম্ভবত যেহেতু তিনি এক প্রকৃত আন্তর্জাতিক এবং উজ্জ্বল পরিবেশে বড়ো হয়েছিলেন, তার পরিচয় এবং তার দেশপ্রমিক ধরনা কখনোই নিকৃষ্টতার বন্ধনে বোঝা হয়ে থাকেনি। তবুও, সামাজিক স্বীকৃতি এবং পেশাদারি সাফল্য অর্জনের ক্ষেত্রে নারী হিসেবে তাকে চাপে পড়তে হয়নি। সম্ভবত যে জন্যে তিনি ধারাবাহিকভাবে তার পরীক্ষানিরীক্ষা চালিয়ে যেতে পেরেছিলেন। তিনি হলেন বাংলাদেশের প্রথম আধুনিক ভাস্কর। গভর্নমেন্ট আর্ট ইন্সটিটিউটের শিক্ষকমণ্ডলী এবং প্রশাসন তাদের পাঠক্রমে ভাস্কর্য চালু করার ব্যাপারে এখনো খুব সতর্ক এই ভয়ে যে, জনগণ চিন্তা করতে শুরু করবে মুসলিম দেশে অ-ইসলামীয় ব্যবহারে উৎসাহ দেওয়া হচ্ছে। ঢাকায় প্রথম নারী যিনি চিত্রশিল্পের একক প্রদর্শনী করেন তিনি হলেন দুরে খানম। শিল্পী আমিনুল ইসলামের সঙ্গে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হওয়ায় তিনি রুমি ইসলাম নামে বেশি পরিচিত ছিলেন। পরবর্তীকালে তাদের বিবাহবিচ্ছেদ হয়। ১৯৬০ খ্রিষ্টাব্দে ইন্সটিটিউট অফ ফাইন আর্টে শিক্ষা সম্পন্ন হওয়ার পর তার শিল্প প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এই প্রদর্শনীর বৈশিষ্ট্য ছিল তেলরং ও টেম্পারা এবং চিত্রশিল্পগুলোতে বিমূর্ততার দিকে একটা পরিষ্কার ঝোঁক ছিল (চিত্র 1.16)। প্রদর্শনীটা জয়নূল আবেদিন, এ এল খাতিব এবং সাদেক খান দ্বারা উচ্চ প্রশংসিত হয়ছিল। তার শিল্পকর্মে মহান সম্ভাবনা দেখা গিয়েছিল কিন্তু পরবর্তীতে তিনি বাংলাদেশের শিল্পজগৎ থেকে অন্তর্হিত হয়ে গিয়েছিলেন। নবেরা আহমেদ এবং রুমি ইসলাম এই দুই শিল্পীর ক্ষেত্রেই আমরা দেখি যে, তারা নারী হয়েও পুরুষ-কেন্দ্রিক শিল্পজগতে প্রবেশ করেছিলেন। মহৎ মেধা, দৃঢ়তা এবং উৎসর্জনের জন্যে তাদের পদাঙ্ক অনুসরণীয়। যদিও তারা গ্রহণযোগ্যভাবে সামাজিক প্রথার বিরুদ্ধে পুরুষনিয়ন্ত্রিত বাস্তবে প্রবেশ করেন, তারা সেখানে দীর্ঘকাল অবস্থান করতে পারেননি। একইভাবে, তাদের নির্দিষ্ট নতুন দিগন্ত এবং তাদের ঐতিহাসিক গুরুত্ব পুুরুষনিয়ন্ত্রিত সমাজ দ্বারা মূল্যায়িত হয়নি। এটা পুরোপুরি সত্য যে, তারা প্রায় সম্পূর্ণরূপে হারিয়ে গিয়েছেন।

ফরিদা জামান (জন্ম ১৯৫৩)

ড. ফরিদা জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের অঙ্কন এবং চিত্রশিল্প বিভাগের একজন অধ্যাপক। তিনি ১৯৭৪ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশ কলেজ অফ আর্টস অ্যান্ড ক্র্যাফ্টস থেকে তার বিএফএ উপাধি অর্জন করেন। ১৯৭৮ খ্রিষ্টাব্দে তিনি ভারতের বরোদার সয়াজিরাও বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এমএফএ এবং বিশ্বভারতী বিশ্ববিদ্যালয়, শান্তিনকেতন থেকে পিএইচডি ডিগ্রি সম্পূর্ণ করেন। অস্ট্রেলীয় সরকারের সাংস্কৃতিক পুরস্কারসহ তিনি তিনি বিভিন্ন পুরস্কার ও সম্মান গ্রহণ করেছেন। ড. জামান পাঁচটা একক প্রদর্শনী করা ছাড়াও দেশে-বিদেশে অনেক গোষ্ঠী প্রদর্শনীতেও অংশগ্রহণ করেছেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদের তিনিই প্রথম মহিলা অধ্যাপক এবং সেখানকার প্রথম মহিলা নির্দশক (ডীন)। তার তৈলচিত্র, অ্যাক্রিলিক এবং জলরঙের জ্ঞাতব্য চিত্রের পাশাপাশি তার একটা দীর্ঘ চিত্রকরের কর্মজীবন আছে। বাংলাদেশের স্বনামধন্য চিত্রকর হাসেম খান এরকমই অভিমত ব্যক্ত করেছেন।

রোকেয়া সুলতানা (জন্ম ১৯৫৮)

রোকেয়া সুলতানা নয়ের দশক থেকে তার কর্মোদ্যোগ বাড়াতে থাকেন। তার কাজ আত্মোপলব্ধির আশ্রয়ে থাকার ভিতর থেকে চিত্রায়িত হওয়ার বিশিষ্টতা দান করেছিল। তার শহরের পরিচিত চৌহদ্দির মধ্যে নিত্যদিনের লড়াইয়ের তিনি প্রতিনিধিত্ব করতেন। তার প্রতিকৃতিগুলো শিশু শিল্পের মতো। সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বিশেষায়িত করেছেন, ' তার শিল্পকর্মগুলো ... বুনিয়াদী সংবেদনশীলতা অথবা শিশুর মতো সারল্য থেকে অঙ্কিত। তিনি ছাপাই এবং অন্যান্য মাধ্যমে কাজ করেছেন। ছান্দিক রেখা এবং ছবির অবয়বতা তার কাজের বিশিষ্টতা দিয়েছে। নারীর অস্তিত্ব, অভিজ্ঞতা এবং সংবেদনশীল বিশ্বে নারীর উপলব্ধি হল তার শিল্পকর্মের মূল বিষয়বস্তু।'

আখতার জাহান (জন্ম ১৯৫৮)

আখতার জাহান হলেন কয়েকজন নারী ভাস্করের মধ্যে একজন। বিগত নয়ের দশক থেকে তার শিল্পকর্মের বৃদ্ধি লক্ষ করা যায়। শিশুকালের স্মৃতি, পরিবেশ এবং প্রকৃতি তার শিল্পে ফুটে ওঠে। তিনি সিমেন্ট, ব্রোঞ্জ, ধাতব পাত, কাঠ, টেরাকোটা ইত্যাদি মাধ্যমে কাজ করেন। তার পরিচিত জগৎ থেকে উপাদানের একটা সরল বিমূর্ত ধারণা এবং অবয়বগুলো তাকে বিশিষ্টতা দান করেছে।

দিলারা বেগম জলি (জন্ম ১৯৬০)

দিলারা বেগম জলি সামাজিক বাস্তবতাকে সরাসরি তার শিল্পকর্মের মধ্যে প্রতিনিধিত্ব করে চলেছেন। তিনি সামাজিক অসঙ্গতি, নিপীড়ন, অসাম্য এবং অবিচারকে তার চিত্রিত ভাষায় এনেছেন। তার পছন্দের বিষয়গুলোর মধ্যে আছে নারীদের প্রতি বৈষম্য এবং তার নারীবাদী দৃষ্টিভঙ্গি ক্রমাগত ও সুনির্দিষ্টভাবে তার শিল্পকর্মে জাহির হয়। তার কাজের ধারা অত্যন্ত সরল এবং অবাধ। তার আবেগ ও অন্তর্দৃষ্টি বৌদ্ধিক বিশ্লেষণের চেয়েও তার কাজের মধ্যে বেশি প্রতিভাত হোত। জলি ইরান যুদ্ধের আতঙ্কসমূহ খুবই স্বতঃস্ফূর্ততার সঙ্গে মিশ্র মাধ্যমে অঙ্কিত করেছেন। বিষয়বস্তু এবং উদ্দেশ্য হল জলির শিল্পকর্মের মূল চালিকাশক্তি। যদিও, যে স্বাতন্ত্র্যসূচক শিল্পের ভাষা তিনি ব্যবহার করেন, তাতে স্বাভাবিকভাবেই ধারা এবং বিষয় মিলিয়ে তার শিল্পের পবিত্রতাই প্রকট হয়। ভাষাগতভাবে জলির শিল্পকর্ম খুবই ব্যক্তিগত। নারীর বহিরঙ্গ ধারার পাশাপাশি তার অনুভূত নারীর অন্তরঙ্গও তার শিল্পকর্মে নির্ভীকতার সঙ্গে উপস্থাপিত হয়েছে (চিত্র 1.24)।

ফারহা জেবা (জন্ম ১৯৬১)

ফারহা জেবা ১৯৯৮ খ্রিষ্টাব্দে মেক্সিকান শিল্পী ফ্রিদা কাহলোর শিল্পকর্ম নিয়ে 'ফ্রিদা কাহলোর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি' নামে প্রদর্শনীতে এক নারী শিল্পীজীবনের ইতিহাস বিবৃত করেছিলেন। ফ্রিদার বিয়োগান্তক জীবনের যন্ত্রণা সময় এবং স্থানের বাধা অতিক্রম করে জীবন জুড়ে প্রসারিত, জেবার অভিব্যক্ততে এটাই ছিল। এই প্রদর্শনীর উল্লেখযোগ্য দিক ছিল একজন শিল্পীর অন্য এক নারীর প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি, সহমর্মিতা এবং সমবেদনা। জেবার শিল্পকর্ম নারীর বিরুদ্ধে নিপীড়ন ও অবিচার অঙ্কিত করেছিল, যে নারী সফলভাবে এইসব বাধা অতিক্রম করেছিলেন। তার কর্মধারা আলঙ্কারিক এবং তার শিল্পমাধ্যের ব্যবহার গতিশীল কোমলতায় ভরা। যে নারীরা তাদের সমসাময়িক কাজের পরিচয় রেখেছেন জেবা তাদের শক্তি ও সামর্থ্যকে তার শিল্পকর্মের মধ্যে প্রকাশ করেছেন (চিত্র 1.27)।

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী (জন্ম ১৯৪৭)

ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী একজন স্বশিক্ষিত শিল্পী; ১৯৪৭ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেছেন। নয়ের দশকে তিনি কাজ শুরু করেন। গোড়ার দিকে তিনি কাঠ, গাছের মূল এবং পাতা দিয়ে শিল্প সৃষ্টি করেছেন। ঘরবাড়ি সাজানোর লক্ষ্যে তিনি প্রকৃতির উপাদান সংগ্রহ করতেন। পরবর্তীতে তিনি গোষ্ঠীগত প্রদর্শনী শুরু করেন এবং অসংখ্য একক প্রদর্শনীও করেছেন। তিনি প্রকৃতির অর্থহীন সৌন্দর্যের বস্তুতে জীবনদান এবং বিক্ষিপ্ত বস্তুকে সামঞ্জস্যপূর্ণ করে তুলেছেন। বস্তুর পুর্ব্যবহারের অভ্যাস হল প্রায়শই নারীর সহজাত। বাংলার নকশিকাঁথার মতো শিলপকর্মে তার এই প্রবণতা লক্ষ করা যায়।

আতিয়া ইসলাম আন (জন্ম ১৯৬২)

আতিয়া ইসলাম আন সমাজের একক-মনস্কভাবে নারীর গৌন অবস্থানের বিষয় নিয়ে চিত্রাঙ্কন করেন। তার ধারা এবং ভাষা হল এককথায় অপূর্ব। আপাতদৃষ্টিতে মনে হবে তিনি পরাবাস্তব উপাদান নিয়ে কাজ করছেন, কিন্তু সেগুলো অবচেতনের মধ্যে দিয়ে নয়। তিনি সমাজের পিছিয়েপড়া এবং সহায়সম্বলহীন নারীদের প্রতিতিধিত্বকারী বিশেষ প্রতীককে প্রতিষ্ঠা করার কাজ করেছেন (চিত্র 1.28)। তার চিত্রগঠনে উপাদানের ব্যবহার বাস্তবের কাছাকাছি, কিন্তু ঠিক সেরকম নয়, যা একটা বিচিত্র ভৌগোলিক লাইন ও আকার এক অগভীর এবং অবাস্তব জায়গা তৈরি করে। আবুল মনসুরের ভাষ্য অনুযায়ী, ... আনের মতো শিল্পীকে বুঝতে হলে তার নারীত্বকে অনুধাবন করতে হবে, এছাড়া তার মূল্যায়ন অধুরা ... সম্পূর্ণ চিত্রকল্পের কেন্দ্রে আছে নারী।

নিলুফার চমন (১৯৬২)

নিলুফার চমন হলেন আরো একজন নারী শিল্পী যিনি বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত মূলধারার চিত্রশিল্পকে সম্পূর্ণ অবজ্ঞা করেছিলেন এবং নিজস্ব পথে চলেছেন। নিলুফারের রংগুলো হল সূক্ষ্ম, তার ধারা হল আকৃতিগত, জলে ভাসমান এবং পরিবর্তনশীলতার প্রক্রিয়ায় রত। তার ক্যানভাসে মানবজাতি, প্রাণীজগৎ এবং গাছপালা সমান গুরুত্ব সহকারে অঙ্কিত হয়েছে। এটা এরকম নয় যে, তারা সব আলাদা, আসলে সকলেই পরস্পর পরিব্যাপ্ত। এক জল-প্লাবিত বিশ্বে যৌনতা এবং পুনরুৎপাদনের অবিরাম জীবনচক্র তার শিল্পকর্মকে একটা বিশিষ্টতা দান করেছে (চিত্র 1.26)। আবুল মনসুর লিখেছেন, 'যদিও তিনি পুরুষের সংগঠিত বর্বরতা এবং দুরাচারের দ্বারা গভীরভাবে আহত ও বিদ্রোহী হয়েছিলেন, তার তীব্র বিষয়গত অনুভূতির জন্যে সরাসরি বিবরণের পরিবর্তে তিনি রূপকধর্মী অভিব্যক্তিবাদের মাধ্যম গ্রহণ করেছিলেন।' তার সাম্প্রতিক শিল্পকর্মের মধ্যে ঐতিহ্যগত প্রতীক, যেমন হাত, পদ্ম ইত্যাদি ব্যবহৃত হয়েছে। তার স্থাপনাগুলোও উল্লেখযোগ্য।

কনক চাঁপা চাকমা (জন্ম ১৯৬৩)

কনক চাঁপা চাকমার অনুপ্রেরণার উৎস হল চাকমা জনগণ এবং তার জন্মভূমি রাঙামাটির প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তিনি ঐতিহ্যপূর্ণ বিষয়বস্তুকে প্রতিনিধিত্ব করার জন্যে মূল ধারার শিল্পের স্বীকৃত ভাষা ব্যবহার করেন (চিত্র 1.29)। নারীদের বিভিন্ন কার্যকলাপ তার শিল্পকর্মের প্রধান কেন্দ্রবিন্দু।

নাসিমা হক মিটু (জন্ম ১৯৬৭)

নাসিমা হক মিটু ভাস্কর্যে চক্রাকার কৌশল পছন্দ করেছিলেন। তার শিল্পকর্ম খুবই সরল ও পবিত্র অথচ অর্থপূর্ণ ও প্রতীকী ধারার (চিত্র 1.30)। এটা এরকম যে, এর উদ্দেশ্য হল ব্যাখ্যা নয়, অন্তর্নিহিত অর্থ খোঁজা। তার শিল্পকর্ম হল পুরুষ এবং নারীর মধ্যে বৈপরীত্য ও সম্পর্কের অভিব্যক্তি।

তথ্যসূত্র

  • 1. Robert Skelton, 'Folk Art Other than Paintings andTextiles' in Robert Skelton and Mark Francis (eds.) Arts of Bengal: The Heritage of Bengal and Eastern India, (London 1979), 57.
  • 2. Sila Basak, Banglar Brataparban, (Calcutta1998), 2.
  • 3. Niharranjan Roy, Bangalir Itihas: Adiparba, (Calcutta1990), 483.
  • 4. Ibid., 484.
  • 5. Pupul Jayakar, The Earth Mother, (Calcutta1990), 117.
  • 6. Stella Kramrisch, 'Foreword,' ibid.,21.
  • 7. Sudhansu Kumar Ray, The Ritual Art of the Bratas of Bengal, (Calcutta 1961), 42.
  • 8. S. Basak, op.cit., 35.
  • 9. Ibid., 29.
  • 10. P. Jayakar, op. cit., 42–43.
  • 11. Dineshchandra Sen, Brihatbanga, Vol. 1,(Calcutta 1993), 425.
  • 12. Ibid., 426.
  • 13. Jasimuddin, 'Pallishilpa' in Mihir Bhattarchaya and Dipankar Ghose (eds.), Bangiya Shilpa Parichoy, (Kolkata 2004),50–58.
  • 14. Mohammad Sayeedur Rahman, 'Decorative Arts,' in An Anthology of Crafts of Bangladesh, Dr. Enamul Haque (ed.), (Dhaka 1987), 28.
  • 15. Jasimuddin,op. cit., 50.
  • 16. Heide-Goettner Abendroth, 'Nine Principles of Matriarchal Aesthetics,' in Art and Its Significance, An Anthology of Aesthetics, David Ross (ed.), (New York 1994), 568.
  • 17. Partha Mitter, Art and Nationalism in Colonial India 1850–1922, (Cambridge 1994), 75.
  • 18. Jogesh Chandra Bagal, 'History of the Govt. College of Art and Craft,' Centenary Government College of Art and Craft Calcutta, (Calcutta 1966), 49–50.
  • 19. Germaine Greer, The Obstacle Race, (New York1979), 7.
  • 20. Kama] Sarkar, Bhorater Bhaskar O Chitrashilpi, (Calcutta1984), 50.
  • 21. Ibid., 217.
  • 22. Ibid., 221.
  • 23. Kishore Chatterjee, 'Three Women Painters of Bengal,' in The Crafts of Bengal and Eastern India, R. P. Gupta (ed.), (Calcutta 1982), 84.
  • 24. Anupam Hayat, Meherbanu Khanam, (Dhaka 1997), 54.
  • 25. Ibid., 56.
  • 26. Ibid., 66.
  • 27. K. Sarkar, op. cit., 216.
  • 28. A. Hayat, op. cit., 59.
  • 29. K. Chatterjee, op. cit., 84–85 and K. Sarkar, op. cit., 109–110.
  • 30. Vide K. Sarkar, Ibid., 199 andK. Chatterjee, Ibid., 85.
  • 31. K. Sarkar, Ibid., 216.
  • 32. Ibid., 108.
  • 33. Ibid., 26–27.
  • 34. Ibid., 54.
  • 35. Ibid., 25.
  • 36. Ibid., 27.
  • 37. Ibid., 236.
  • 38. Ibid., 169.
  • 39. Ibid., 187.
  • 40. Ibid., 57.
  • 41. Mohammad Nazrul Islam Aghrani, Shilpi Shashibhusanpal O Maheshwarpasha School of Art, unpublished dissertation (1988), 18.
  • 42. 'Rumi Islam a Woman Painter,' Contemporary Arts in Pakistan, Vol. 11, No. 4 (Winter 1961).
  • 43. Nasim Ahmed Nadvi, 'Introduction,' She a Group Art Exhibition, (Dhaka 1994).
  • 44. Anna Islam, 3rd Solo Show, Naima Hague, (Dhaka2000).
  • 45. Abul Mansur, Dipa Haq Ekak Chitra Pradarshani, (Dhaka1998).
  • 46. S. Manzoorul Islam, Sojourn Exhibition of Works by Rokeya Sultana, La Galerie, Dhaka.
  • 47. Forms and Elements, Unity and Diversity, compiledand edited by Nasimul Khabir, (Dhaka 2006).
  • 48. Abul Mansur, Anne 2000, 1st Solo Painting Exhibition, (Dhaka2000).
  • 49. Abul Mansur, Niloofar Chaman Drawings in Mixed Media1994, Dhaka.
  • 50. Loc. cit.

Read other articles:

UnReal Serie de televisión Logo de la serie.Creado por Marti NoxonSarah Gertrude ShapiroProtagonistas Shiri Appleby Craig Bierko Freddie Stroma Jeffrey Bowyer-Chapman Johanna Braddy Aline Elasmar Nathalie Kelley Josh Kelly Ashley Scott Breeda Wool Constance Zimmer B.J. Britt Monica Barbaro Denée Benton Kim Matula Michael Rady Meagan Tandy Gentry White Genevieve Buechner Adam Demos Bart Edwards Brennan Elliott Caitlin FitzGerald Alex Hernández Alex Sparrow N.º de temporadas 5N.º de episod...

 

Widya SaputraWidya Saputra pada tahun 2023LahirWidyaningrum Surya Nugraha26 Februari 1985 (umur 38)Cimahi, Jawa Barat, IndonesiaNama lainWidya Trio Laris[1]Widya Cat LadyAlmamaterUniversitas PadjadjaranPekerjaanPembawa acara Praktisi humasTahun aktif1993 - sekarangAnak1Karier acara olahragaGenreSportscasterOlahragaMotoGP, Sepakbola, TinjuTempat kerjaTPI (1998-1999) Trans7 (2003–2008) MetroTV (2010–2023) Widyaningrum Surya Nugraha, dikenal secara profesional dengan n...

 

Artikel ini tidak memiliki referensi atau sumber tepercaya sehingga isinya tidak bisa dipastikan. Tolong bantu perbaiki artikel ini dengan menambahkan referensi yang layak. Tulisan tanpa sumber dapat dipertanyakan dan dihapus sewaktu-waktu.Cari sumber: Setia Band – berita · surat kabar · buku · cendekiawan · JSTOR SetiaAsalBandung, IndonesiaGenrePop melayupop rockpopTahun aktif2012 - sekarangLabelTrinity Optima Production (2012-2021) MSI Record (2019-2...

Australian singer and songwriter Karise EdenEden in June 2012Background informationBorn (1992-07-11) 11 July 1992 (age 31)Gosford, New South Wales, AustraliaGenresBlues, pop, soulOccupation(s)Singer, songwriterInstrument(s)Vocals, banjo, double bass, guitarYears active2012–presentLabelsUniversalWebsitewww.kariseeden.com.auMusical artist Karise Eden (born 11 July 1992)[1] is an Australian singer and songwriter. In 2012, she became the winner of the first series of The Voice...

 

This article does not cite any sources. Please help improve this article by adding citations to reliable sources. Unsourced material may be challenged and removed.Find sources: Municipalities of San Marino – news · newspapers · books · scholar · JSTOR (February 2022) (Learn how and when to remove this template message) MunicipalityCastelli (Italian)CategoryUnitary parliamentary diarchic directorial republicLocationSan MarinoNumber9Populations966 (...

 

No debe confundirse con José María Irigoyen de la O. José María Irigoyen Rodríguez Gobernador de Chihuahua 4 de mayo de 1846-25 de agosto de 1846Predecesor Cayetano JustinianiSucesor Ángel Trías Álvarez 14 de junio de 1839-18 de septiembre de 1839Predecesor José María Irigoyen de la OSucesor José María Irigoyen de la O 1 de enero de 1839-22 de enero de 1839Predecesor Berardo RevillaSucesor Simón Elías González Senador al Congreso de la Unión de Méxicopor Chihuahua 1 de enero ...

Istana Odawara 小田原城 Odawara, Prefektur Kanagawa, Jepang Istana Odawara Jenis Istana Jepang gaya Hirayama Dibangun 1447, dibangun ulang 1633, 1706 Digunakan Zaman Edo Diruntuhkan 1872 Dibukauntuk umum ya Pertempuran/Perang Pengepungan Odawara (1561)Pengepungan Odawara (1569)Pengepungan Odawara (1590) Istana Odawara (小田原城code: ja is deprecated , Odawara-jō) adalah istana yang terletak di Kota Odawara, Prefektur Kanagawa, Jepang. Sejarah Odawara dahulu merupakan benteng Kla...

 

Radio City Music Hall 概要所在地 ニューヨーク市マンハッタン区アベニュー・オブ・ジ・アメリカス 1260号座標 北緯40度45分35秒 西経73度58分45秒 / 北緯40.75972度 西経73.97917度 / 40.75972; -73.97917座標: 北緯40度45分35秒 西経73度58分45秒 / 北緯40.75972度 西経73.97917度 / 40.75972; -73.97917所有者 Tishman Speyer Properties(運営マディソン・スクエア・ガーデン社)&...

 

Biografi ini tidak memiliki sumber tepercaya sehingga isinya tidak dapat dipastikan. Bantu memperbaiki artikel ini dengan menambahkan sumber tepercaya. Materi kontroversial atau trivial yang sumbernya tidak memadai atau tidak bisa dipercaya harus segera dihapus.Cari sumber: Omar Ali Saifuddien III dari Brunei – berita · surat kabar · buku · cendekiawan · JSTOR (Pelajari cara dan kapan saatnya untuk menghapus pesan templat ini) Biografi ini memerlukan l...

هذه المقالة يتيمة إذ تصل إليها مقالات أخرى قليلة جدًا. فضلًا، ساعد بإضافة وصلة إليها في مقالات متعلقة بها. (أبريل 2016) التهاب جلد الأطراف الضموري المزمن معلومات عامة الاختصاص طب الجلد  من أنواع التهاب جلد الأطراف،  وداء لايم  تعديل مصدري - تعديل   التهاب جلد الأطراف ا

 

Head of the Catholic Church from 891 to 896 PopeFormosusBishop of RomeChurchCatholic ChurchPapacy began6 October 891Papacy ended4 April 896PredecessorStephen VSuccessorBoniface VIPersonal detailsBornc. 816Rome, Papal StatesDied(896-04-04)4 April 896 (aged c. 80)Rome, Papal States Pope Formosus (c. 816 – 896) was the bishop of Rome and ruler of the Papal States from 6 October 891 until his death on 4 April 896. His reign as pope was troubled, marked by interventions ...

 

US pulp fantasy magazine This article is about the magazine. For the old-time radio program with a similar title, see The Witch's Tale. The November 1936 issue; cover art by Elmer Stoner. The Witch's Tales was an American pulp magazine edited by Tom Chadburn which published two issues in November and December 1936. It was a companion to a radio program, called The Witch's Tale, which had begun broadcasting in May 1931. With the exception of the lead story in each issue, all the stories were r...

19th-century Mandaean priest RishamaYahya Bihramࡉࡀࡄࡉࡀ ࡁࡉࡄࡓࡀࡌTitleGanzibraPersonalBornc. 1811Basra Vilayet, Ottoman Empire (now Iraq)Diedlate 1800sSuq esh-Shuyuk, Basra Vilayet, Ottoman Empire (now Iraq)ReligionMandaeismChildrenYasmin Bana (daughter), Mhatam (son), and othersParentAdam YuhanaKnown forRevival of the Mandaean priesthoodOther namesYahia BihramOccupationMandaean priestRelativesRam Zihrun (cousin) Part of a series onMandaeism Prophets Adam Seth Noah ...

 

District in Champasak province, LaosKhong District, Laos ເມືອງໂຂງDistrictCountryLaosProvinceChampasak provinceTime zoneUTC+7 (ICT) Khong District, Laos is a district (muang) of Champasak province in southwestern Laos. The district borders Cambodia in the far south and is known for the Khonephapheng Waterfalls and the Si Phan Don (4000 Islands) area.[1] References ^ Maplandia world gazetteer vteDistricts of Southern LaosAttapeu province Phouvong Samakkhixay※ Sanamxay ...

 

This article has multiple issues. Please help improve it or discuss these issues on the talk page. (Learn how and when to remove these template messages) This article relies largely or entirely on a single source. Relevant discussion may be found on the talk page. Please help improve this article by introducing citations to additional sources.Find sources: H. B. Thom – news · newspapers · books · scholar · JSTOR (March 2016) This article needs addition...

1985 film by John Hughes This article is about the film. For the television show based on the film, see Weird Science (TV series). For other uses, see Weird Science. Weird ScienceTheatrical release poster by Tom JungDirected byJohn HughesWritten byJohn HughesBased onMade of the Future by Al FeldsteinProduced byJoel SilverStarring Anthony Michael Hall Ilan Mitchell-Smith Kelly LeBrock Bill Paxton Robert Downey Jr. CinematographyMatthew F. LeonettiEdited by Chris Lebenzon Mark Warner Scott K. W...

 

Book by Colin Dexter The Daughters of Cain Cover of the first editionAuthorColin DexterCountryUnited KingdomLanguageEnglishSeriesInspector Morse series, #11GenreCrime novelPublisherMacmillanPublication date11 November 1994Media typePrint (Hardcover)Pages320ISBN0-333-63004-1OCLC31763316Dewey Decimal823/.914 20LC ClassPR6054.E96 D38 1994Preceded byThe Way Through the Woods Followed byDeath Is Now My Neighbour  The Daughters of Cain is a crime novel by Colin Dexter....

 

This article includes a list of general references, but it lacks sufficient corresponding inline citations. Please help to improve this article by introducing more precise citations. (April 2009) (Learn how and when to remove this template message) A government built house in the Belconnen district of Canberra Government-owned housing in Canberra and the Australian Capital Territory has a history stemming from the decision to build the National Capital in the bush. In the early years Canberra...

American film and television director duo Russo brothersJoe (left) and Anthony Russo in 2019BornAnthony Russo (1970-02-03) February 3, 1970 (age 53)Cleveland, Ohio, U.S.Joseph Russo (1971-07-18) July 18, 1971 (age 52)Cleveland, Ohio, U.S.OccupationsFilm directorsfilm producersscreenwritersactorsYears active1997–presentParentBasil Russo (father) Anthony Russo (born February 3, 1970) and Joseph Russo (born July 18, 1971), collectively known as the Russo brothers (ROO-soh), are ...

 

German illustrator Primate drawings from Brehms Tierleben Robert Kretschmer (1812–1872[1]) was a German illustrator, known for his illustrations in Brehms Tierleben. References ^ Lot 168 : ROBERT KRETSCHMER (GERMAN, 1812-1872) Further reading Andreas Daum, Wissenschaftspopularisierung im 19. Jahrhundert: Bürgerliche Kultur, naturwissenschaftliche Bildung und die deutsche Öffentlichkeit, 1848–1914. Munich: Oldenbourg, 1998, ISBN 3-486-56337-8 Luca Zordan: Zwischen Mytho...

 

Strategi Solo vs Squad di Free Fire: Cara Menang Mudah!