পেসমেকার হলো এমন এক ধরনের ডিভাইস যেটি অনিয়ন্ত্রিত হৃৎস্পন্দন নিয়ন্ত্রণ করে। হৃৎপিন্ডের ডান অ্যাট্রিয়াম প্রাচীরে উপর দিকে অবস্থিত বিশেষায়িত কার্ডিয়াক পেশিগুচ্ছে গঠিত ও স্বয়ংক্রিয় স্নায়ুতন্ত্রে নিয়ন্ত্রিত একটি ছোট অংশ যা বৈদ্যুতিক তরঙ্গ প্রবাহ ছড়িয়ে দিয়ে হৃৎস্পন্দন সৃষ্টি করে এবং স্পন্দনের ছন্দময়তা বজায় রাখে তাকে পেসমেকার বলে। আবার মানুষের হৃৎপিন্ডে সাইনো-অ্যাট্রিয়াল নোড হচ্ছে পেসমেকার। এটি অকেজো বা অসুস্থ হলে হৃৎস্পন্দন সৃষ্টি ও নিয়ন্ত্রণের জন্য যে কম্পিউটারাইজড বৈদ্যুতিক যন্ত্র দেহে স্থাপন করা হয় তাকেও পেসমেকার বলে। অর্থাৎ পেসমেকার দু ধরনের। একটি হচ্ছে হৃৎপিন্ডের অবিচ্ছেদ্য অংশরুপী সাইনো অ্যাট্রিয়াল নোড, যা প্রাকৃতিক পেসমেকার নামে পরিচিত। অন্যটি হচ্ছে যান্ত্রিক পেসমেকার, এটি অসুস্থ প্রাকৃতিক পেসমেকারকে নজরদারির মধ্যে রাখে।[৩]
ইতিহাস
১৯৫৮ সালে হৃৎস্পন্দনের শব্দ শোনার জন্য কম্পনযন্ত্র বানাতে গিয়ে পেসমেকার আবিষ্কার করে বসেন যুক্তরাষ্ট্রের উইলসন গ্রেটব্যাচ[৪]। তবে ১৯৬০ সালে প্রথম মানুষের শরীরে পেসমেকার স্থাপন করা হয়। ওই রোগী বেঁচেছিলেন ১৮ মাস। [৫]
পেসমেকার কার্যক্রম
অসুস্থ ও দূর্বল হৃৎপিন্ডে বিদ্যুৎ তরঙ্গ সৃষ্টি করে স্বাভাবিক স্পন্দন হার ফিরিয়ে আনার ও নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে বুকে বা উদরের চামড়ার নিচে স্থাপিত ছোট একটি যন্ত্র হলো পেসমেকার। হৃৎপিন্ডের সুস্থতা পরিমাপের প্রাথমিক ধাপ হলো হৃৎস্পন্দনের পরীক্ষা-নিরীক্ষা। মানুষের স্বাভাবিক হৃৎস্পন্দন মিনিটে ৬০-৯০ বার। হৃৎস্পন্দন স্বাভাবিক এর চেয়ে ধীর লয় বা দ্রুত গতিসম্পন্ন কিংবা অনিয়ত হলে অর্থাৎ অস্বাভাবিক স্পন্দন হলে তাকে অ্যারিথমিয়া বলে। পেসমেকার ব্যবহার করে সব ধরনের অ্যারিথমিয়ার হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যায়, বাকি জীবন সক্রিয় থাকা যায়।
পেসমেকারের গঠন ও কর্মপদ্ধতি
একটি লিথিয়াম ব্যাটারি, কম্পিউটারাইজড জেনারেটর ও শীর্ষে সেন্সরযুক্ত কতগুলো তার নিয়ে একটি পেসমেকার গঠিত হয়। সেন্সরগুলোকে ইলেক্ট্রোড বলে। ব্যাটারি জেনারেটরকে শক্তি সরবরাহ করে। এ দুটি জিনিস একটি পাতলা ধাতব বাক্সে আবৃত থাকে। তারগুলোর সাহায্যে জেনারেটরকে হৃৎপিন্ডের সঙ্গে যুক্ত করা হয়। ইলেক্ট্রোডগুলো হৃৎপিন্ডের বৈদ্যুতিক কর্মকাণ্ড শনাক্ত করে তারের মাধ্যমে জেনারেটরে প্রেরণ করে।
পেসমেকারে অপরিবাহী আবরণযুক্ত ১-৩ টি তার থাকে। পেসমেকারের তারকে লিড বলে। হৃৎপিন্ডের বিভিন্ন প্রকোষ্ঠে তার প্রবেশের ধরন অনুযায়ী পেসমেকার ৩ রকম।
এক-প্রকোষ্ঠ পেসমেকার: এ ধরনের পেসমেকারে একটি তার থাকে যা জেনারেটর থেকে হৃৎপিন্ডের শুধু ডান অ্যার্টিয়াম বা ডান ভেন্ট্রিকলে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বহন করে।
দ্বি-প্রকোষ্ঠ পেসমেকার: এ ধরনের পেসমেকারে দুটি তার থাকে যা জেনারেটর থেকে হৃৎপিন্ডের দুটি প্রকোষ্ঠে অর্থাৎ ডান অ্যার্টিয়াম ও ডান ভেন্ট্রিকলে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বহন করে।
ত্রি-প্রকোষ্ঠ পেসমেকার: এ ধরনের পেসমেকারে তিনটি তার থাকে যার একটি জেনারেটর থেকে ডান অ্যাট্রিয়ামে, আরেকটি ডান ভেন্ট্রিকলে এবং অন্যটি বাম ভেন্ট্রিকলে বিদ্যুৎ তরঙ্গ বহন করে। এটি অত্যন্ত দুর্বল হৃৎপেশির হৃৎপিন্ডে স্থাপন করা হয়। পেসমেকার এক্ষেত্রে ভেন্ট্রিকল দুটিকে সংকোচন ক্ষমতার উন্নতি ঘটিয়ে রক্তপ্রবাহে উন্নতি ঘটায়।
প্রতিস্থাপন
পেসমেকার সার্জারি করে বুকের ভেতরে বসিয়ে দিতে হয়। সার্জারি করতে এক ঘণ্টার বেশি সময় লাগে না। ২-১ দিনের মধ্যেই রোগী বাড়ি ফিরে যেতে পারে এবং ২ সপ্তাহ মধ্যেই মোটামুটি ভাবে তার স্বাভাবিক কাজকর্ম শুরু করতে পারে। তবে বেশি পরিশ্রম শুরু করার আগে বেশ কয়েক সপ্তাহ বিশ্রাম নেওয়া প্রয়োজন। পেসমেকারের ব্যাটারি ৫ থেকে ১৫ বছর পর্যন্ত কাজ করে। তারপর সেটিকে বদলাতে হয়। অনেক সময়ে জরুরী প্রয়োজনে অস্থায়ী পেসমেকারও বসানো হয়। সেক্ষেত্রে পেসমেকার শরীরের বাইরে থাকে এবং সংলগ্ন তারটি কোনো শিরার মধ্যে দিয়ে হৃদ্পিণ্ডে নিয়ে যাওয়া হয়।
কার্যপদ্ধতি
জেনারেটরের কম্পিউটার চিপ এবং হৃৎপিন্ডে যুক্ত সেন্সরবাহী তার ব্যক্তির চলন, রক্তের তাপমাত্রা, শ্বসন ও বিভিন্ন শারীরিক কর্মকাণ্ড মনিটর করে। প্রয়োজনে কর্মকাণ্ডের ধারা অনুযায়ী হৃৎপিন্ডকে তাল মিলিয়ে চলতে সাহায্য করে। এসব তথ্য কাজে লাগিয়ে পেসমেকার ঠিক করে দেয় কোন ধরনের বিদ্যুৎ তরঙ্গ লাগবে এবং কখন লাগবে। এসব উপাত্ত পেসমেকারে রক্ষিত থাকে যা দেখে চিকিৎসকেরা পেসমেকারে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনতে পারেন।