পুরাতত্ত্ব বা পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন হল প্রাচীন যুগের দ্রব্যাদি; বিশেষত যেগুলো ভূমধ্যসাগরীয় সভ্যতা, গ্রিস ও রোম এর প্রাচীনকাল, প্রাচীন মিশর এবং অন্যান্য প্রাচীন পূর্বাঞ্চলীয় সংস্কৃতি থেকে প্রাপ্ত। মধ্য প্রস্তর যুগ এর হস্তশিল্প এবং এশিয়া ও অন্যান্য অঞ্চলের সভ্যতার নির্দশনগুলোর পুরাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। চিনসহ অন্যান্য সংস্কৃতির হস্তশিল্পগুলোকেও বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়। চিনের ব্রোঞ্জনির্মিত শিল্পগুলো দুই থেকে তিন হাজার বছরের পুরনো এবং শতাব্দী ধরে সংগ্রহ ও অনুকরণ করা হয়েছে। প্রাক-কলম্বিয়ান যুগের মেসো আমেরিকা সংস্কৃতিতে প্রাচীন ওলমেক সভ্যতার নিদর্শন মেলে যেগুলো মাটির নিচে চাপা পড়েছিল এবং স্প্যানিশদের বিজয় পর্যন্ত সময়ের ঐতিহ্য বহন করে।[১]
সংজ্ঞা
পুরাতত্ত্বের সংজ্ঞা খুব সুস্পষ্ট নয়। জাদুঘরে ‘পুরাতত্ত্ব বিভাগ’ বেশ পরে চালু হয়। উদাহরণস্বরূপ, গথিক শিল্প এখন আর সাধারণভাবে পুরাতত্ত্ব হিসেবে গণ্য হয় না যদিও তা ১৭০০ তা সেভাবেই বিবেচিত হতো। ১৫১৩ সালে ইংরেজি ভাষায় antiquities ( পুরাতত্ত্ব) প্রথম শব্দটি পাওয়া যায় এবং এরপর থেকেই বিভিন্ন অর্থে ব্যবহৃত হয়। বর্তমানে চারুকলাবিহীন হস্তশিল্পগুলোকে পুরাতত্ত্ব হিসেবে আর তেমন গুরুত্ব দেওয়া হয় না। ১৬০৫ সালে ফ্রান্সিস বেকন লিখেছেন “পুরাতত্ত্ব হল ইতিহাসের বিবর্ণরূপ বা ইতিহাসের অবশেষ যা কোনভাবে মহাকালের করালগ্রাস হতে বেঁচে গেছে।”
বাণিজ্যে শব্দটির আধুনিক অর্থ প্রয়োগ করা হয়। ব্রিটিশ নিলামঘর ক্রিস্টির ‘পুরাতত্ত্ব বিভাগ’ এর মতে “অন্ধকার যুগের সভ্যতার প্রারম্ভ অবধি , পশ্চিম ইউরোপ থেকে কাস্পিয়ান হ্রদ পর্যন্ত, মিশরের সংস্কৃতি, গ্রিস, রোম ও পূর্বাঞ্চল” এর দ্রব্যসমূহ পুরাতত্ত্বের অন্তর্ভুক্ত। [২] আরেকটি নিলামঘর বনহ্যামস অপেক্ষাকৃত ক্ষৃদ্র সংজ্ঞা ব্যবহার করে- “খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ অব্দ থেকে ১২শ শতক পর্যন্ত, ভৌগোলিকভাবে মিশর থেকে পূর্বাঞ্চল ও ইউরোপ” স্থানে প্রাপ্ত দ্রব্যই পুরাতত্ত্ব। [৩] শব্দটির দাপ্তরিক প্রয়োগ বেশ আধুনিক, শিল্পকলার ইতিহাসের সূক্ষ্ম বিশ্লেষণে অনাগ্রহী এবং সংরক্ষণযোগ্য সব যুগের জন্য প্রয়োগ করা হয় যেমন জর্ডান এ ১৭৫০ সালে, হংকং এ ১৮০০ সালে প্রভৃতি।
শব্দটির সুস্পষ্টতার অভাবে এটি শিক্ষা পাঠ্যক্রমে আর ব্যবহৃত হয় না। এর সবকিছু না হলেও অধিকাংশ বিষয় প্রত্নতত্ত্ব এ আলোচিত হয়। পুরাতত্ত্ব ও এন্টিক এর মধ্যে সাধারণ বিষয় নগণ্য বা নেই; এন্টিক বলতে তিন শত বৎসরের বেশি পুরনো এবং প্রত্নতত্ত্ব কর্তৃক আবিষ্কৃত নয় এমন দ্রব্যসমূহ বুঝিয়ে থাকে।
ইতিহাস
পুরাতত্ত্বের অনুধাবনের মাধ্যমে, ধ্বংসাবশেষ ও বস্তুশিল্প চর্চার মাধ্যমে কোন সভ্যতাকে পুনরাবিষ্কার করা যায়। মার্কুস টেরেনটিয়াস ভারো এবং যোসেফাস এর ‘এন্টিকিউটিস অফ দ্যা জেওস’ মধ্যযুগে হারিয়ে গিয়েছিল; যখন প্রাচীন বস্তুসমূহ সেগুলোর জাদুকরী ক্ষমতা বা দুষ্প্রাপ্যতার জন্য সংগ্রহ করা হতো। [৪] মূল্যবান খোদিত মণি ও পাথর মূলত মুকুট বা শিরোভূষণের জন্য সংরক্ষিত হতো। [৫] গজদন্তনির্মিত পাত সুরাপাত্রের আবরণ বা ঢাকনা হিসেবে ব্যবহৃত হতো। চার্চসমূহে রোমান স্তম্ভ পুনঃস্থাপিত করা হতো। [৬]সারকোফাগি এর নতুন অধিকারী হতে পারতো। ভস্মাধার, পবিত্র জলের পাত্ররূপে কাজ করতো। মানবপ্রতিকৃতিধারী ভাস্কর্যগুলো ‘মূর্তি’ নামে পরিচিত যেগুলোর পরিচয় উন্মোচিত করে পুনস্থাপনা করা যেতো। ক্যাম্পিডোগিলোর ইকুয়েস্ট্রিয়ান স্ট্যাচু অফ মার্কুস আউরেলিয়াসকেমহান কন্সট্যান্টাইন এর প্রতিমূর্তি ভাবা হতো এবং পাভিয়াতে নাগরিক ভূমিকার কারণে ‘রেজিসোল’ সংরক্ষিত হয়। রোমে রোমান ব্রোঞ্জমূর্তি স্পিনারিও লেখ ম্যাজিস্টার গ্রেগরিয়াস কর্তৃক প্রশংসিত হয়। ক্যারোলিংগিয়ান রিনাইস্যান্স এর চর্চা পরবর্তীকালের এন্টিক শিল্পীদের প্রেরণা ছিল। উট্রেচ স্যাল্টার এর লেখা ও চিত্রসহ সম্পূর্ণ কাজটি পুনর্নিমাণের উদ্যোগ নিয়েছিলেন। [৭]
অবৈধ বাণিজ্য
প্রায় সব দেশেই বর্তমানে পুরাতত্ত্বের রপ্তানি, আইন দ্বারা কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৯৭০ সালে ইউনেস্কো কনভেনশন দ্বারা পুরাতত্ত্ব আমদানি, রপ্তানি, মালিকানা হস্তান্তর প্রতিরোধ ও নিষিদ্ধ করা হয় যদিও বেআইনিভাবে পুরাতত্ত্বের বাণিজ্য চলতেই থাকে।[৮]ইউফ্রোনিওস ক্র্যাটার একটি প্রকৃষ্ট উদাহরণ যার খবর জানা যায়। [৯] এছাড়া জেটি মিউজিয়ামের বিজয়ী যুবকের ব্রোঞ্জমূর্তির ঘটনাটি আরেকটি উল্লেখযোগ্য দৃষ্টান্ত। পুরাতাত্ত্বিক জালিয়াতি বা নকল পুরাত্ত্বের কারণে বিষয়টি আরও জটিল হয়ে গেছে যেমন এত্রুসক্যান যোদ্ধার টেরাকোটা, পারসিয়ান রাজকন্যার মমি,[১০] জেটি কৌরোস প্রভৃতি।