প্রকৃতপক্ষে নদীটির বাংলা নাম তিস্তা এসেছে ত্রিস্রোতা বা তিন প্রবাহ থেকে। সিকিম হিমালয়ের ৭,২০০ মিটার উচ্চতায় অবস্থিত চিতামু হ্রদ থেকে এই নদীটি সৃষ্টি হয়েছে।[৪] এটি দার্জিলিঙে অবস্থিত শিভক গোলা নামে পরিচিত একটি গিরিসঙ্কটের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে। দার্জিলিং পার্বত্য অঞ্চলে তিস্তা একটি বন্য নদী এবং এর উপত্যকা ঘনবনে আচ্ছাদিত। পার্বত্য এলাকায় এর নিষ্পাশন এলাকার পরিমাণ মাত্র ১২,৫০০ বর্গ কিলোমিটার। পার্বত্য এলাকা থেকে প্রথমে প্রবাহটি দার্জিলিং সমভূমিতে নেমে আসে এবং পরে পশ্চিমবঙ্গের (ভারত) জলপাইগুড়ি জেলাতে প্রবেশ করে। নদীটি নীলফামারী জেলারকালীগঞ্জ সীমান্ত এলাকা দিয়ে বাংলাদেশে প্রবেশ করেছে।
ইতিহাস
অষ্টাদশ শতকের প্রায় শেষ পর্যন্ত এই ধারাটি বিভিন্ন নদীপ্রবাহের মাধ্যমে গঙ্গা নদীতে প্রবাহিত হতো। ১৭৮৭ খ্রিষ্টাব্দের অতিবৃষ্টি একটি ব্যাপক বন্যার সৃষ্টি করেছিল এবং সেই সময় নদীটি গতিপথ পরিবর্তন করে লালমনিরহাট, রংপুর, কুড়িগ্রাম এবং গাইবান্ধা জেলার মধ্যদিয়ে প্রবাহিত হয়ে চিলমারী নদীবন্দরের দক্ষিণে ব্রহ্মপুত্র নদে পতিত হয়। তিস্তা নদীর সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৩১৫ কিমি, তার মধ্যে ১১৫ কিমি বাংলাদেশ ভূখণ্ডে অবস্থিত। তিস্তা একসময় করতোয়া নদীর মাধ্যমে গঙ্গার সঙ্গে সংযুক্ত ছিল এবং এর অংশবিশেষ এখনও বুড়ি তিস্তা নদী নামে পরিচিত।
তিস্তার মাসিক গড় জল অপসারণের পরিমাণ ২,৪৩০ কিউসেক।[৫] ২০১৪ খ্রিষ্টাব্দে তিস্তার ভারতীয় অংশে গজলডোবায় স্থাপিত বাঁধের সবগুলি গেটবন্ধ বন্ধ করে দেয়া হলে তিস্তা নদীর বাংলাদেশ অংশে জলপ্রবাহ শূন্যে নেমে আসে। এর ফলে বাংলাদেশের ১২৫ কিলোমিটার দীর্ঘ তিস্তা অববাহিকায় মানুষের জীবন যাত্রা স্থবির হয়ে পড়ে। এর প্রতিবাদে এপ্রিল মাসে (২০১৪) বাংলাদেশে একটি প্রতিবাদী জনযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়।[৬] এই জনযাত্রার মুখে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কিছু জল ছাড়লে বাংলাদেশের ডালিয়া পয়েন্টে জল স্বল্প সময়ের জন্য উল্লেখযেোগ্যভাবে বৃদ্ধি পায়।[৭]
গতিপথ
তিস্তা নদীর উৎস উত্তর সিকিমের হিমালয় পর্বতমালার ৫,৩৩০ মি (১৭,৪৮৭ ফু) উচ্চতায় অবস্থিত সো লামো হ্রদে।[৮] হ্রদটি শেসচেনের কাছে ডোংখা গিরিপথের উত্তরে অবস্থিত।[৯]
তিস্তা নদী ছাঙ্গু, ইউমথাং ও ডোংকিয়া লা পর্বতশ্রেণী থেকে উৎপন্ন ছোট ছোট নদীর জলে পুষ্ট। সিকিমের রংপো ও পশ্চিমবঙ্গের তিস্তাবাজার শহরের কাছে ত্রিবেনীতে মিলিত হয়েছে। তিস্তা নদী উভয় রাজ্যের সীমানা নির্দেশ করছে। তিস্তা সেতুর (যে সেতুটি দার্জিলিং ও কালিম্পং শহরের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষা করে) ঠিক আগে তিস্তা তার প্রধান উপনদী রঙ্গিত নদীর সঙ্গে মিলিত হয়েছে। এখান থেকে তিস্তার গতি দক্ষিণমুখী। শিলিগুড়ি শহর থেকে ২২ কিলোমিটার দূরে সেবকের করোনেশন সেতু পেরিয়ে তিস্তা পশ্চিমবঙ্গের সমভূমি অঞ্চলে প্রবেশ করেছে। তারপর পশ্চিমবঙ্গের জলপাইগুড়ি জেলা,কোচবিহার জেলা ও বাংলাদেশের রংপুর জেলার মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হয়ে তিস্তা মিশেছে ব্রহ্মপুত্রে।
ভূগোল
সিকিমের মধ্যে দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার সময় তিস্তা নদী অনেকগুলি গিরিখাত সৃষ্টি করেছে। তিস্তার পথে নানা ধরনের বনভূমি দেখা যায়। নিম্ন অববাহিকায় ক্রান্তীয় পর্ণমোচী ও গুল্ম শ্রেণীর গাছপালা বেশি চোখে পড়ে। উচ্চ অববাহিকায় দেখা যায় আল্পীয় বনভূমি। নদী উপত্যকায় প্রচুর সাদা বালি পাওয়া যায়, যা এখানকার নির্মাণশিল্পের একটি প্রধান কাঁচামাল। নদীর জলে বড় বড় বোল্ডার দেখা যায় বলে তিস্তার্যাফটিং অভিযাত্রীদের কাছে এক আদর্শ নদী।
রংপো ও লোহাপুল শহরের কাছে তিস্তার বেশ খরস্রোতা। এখানে হোয়াইট রিভার র্যাফটিং খুব জনপ্রিয়। তিস্তাবাজার ও মেল্লি শহরের কাছে গ্রুপ র্যাফটিং-এর ব্যবস্থা রয়েছে। তিস্তা শান্তদর্শন নদী হলেও, নদীর গভীরের জল বেশ খরস্রোতা। ১৯১৫ সালে দার্জিলিঙের মিউনিসিপ্যাল ইঞ্জিনিয়ার জি. পি. রবার্টসন নদী সমীক্ষা করতে এসে নৌকার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে জলে ডুবে মারা যান। নৌকাটি একটি নিমজ্জিত বোল্ডারে ধাক্কা খেয়ে এক ঘূর্ণির মধ্যে পড়ে যায়। যাত্রীদের কোনো খোঁজই পাওয়া যায়নি।
বর্ষাকালে তিস্তায় দুকুল ছাপিয়ে বন্যা হয়। এই সময় তিস্তার আশেপাশের পাহাড়ে ধ্বস নামতেও দেখা যায়।
নদীপথ পরিবর্তন
১৫০০ সালের পর থেকে বাংলার অনেক নদীর নদীখাতই ভৌগোলিক কারণে পরিবর্তিত হয়েছে। তিস্তা নদীর তাদের মধ্যে একটি।[১০]
তিস্তা নদী আগে জলপাইগুড়ির দক্ষিণে তিনটি ধারায় প্রবাহিত হত: পূর্বে করতোয়া, পশ্চিমে পুনর্ভবা ও মধ্যে আত্রাই। সম্ভবত এই তিনটি ধারার অনুষঙ্গেই ত্রিস্রোতা নামটি এসেছিল, যেটি কালক্রমে বিকৃত হয়ে দাঁড়ায় তিস্তা। তিনটি ধারার মধ্যে পুনর্ভবা মহানন্দায় মিশত। আত্রাই চলন বিলের উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে করতোয়ায় মিশত। তারপর আত্রাই-করতোয়ার যুগ্মধারাটি জাফরগঞ্জের কাছে মিশত পদ্মায়। ১৭৮৭ সালের এক বিধ্বংসী পর তিস্তা তার পুরনো খাত পরিবর্তন করে দক্ষিণ-পূর্ব দিকে প্রবাহিত হয়ে ব্রহ্মপুত্র নদে গিয়ে মেশে।[১০]
রেনেলের মানচিত্রে (১৭৬৪-১৭৭৭) দেখা যায় তিস্তা উত্তরবঙ্গের একাধিক শাখায় (পুনর্ভবা, আত্রাই, করতোয়া ইত্যাদি) প্রবাহিত হত। সবকটি ধারা উত্তরবঙ্গের এখনকার পশ্চিমতম নদী মহানন্দায় মিশত। তারপর হুরসাগর নাম নিয়ে অধুনা গোয়ালন্দের কাছে জাফরগঞ্জে পদ্মায় মিশত। হুরসাগর নদীটি এখনও আছে। তবে পদ্মার বদলে এটি এখন মেশে যমুনা নদীতে।[১১]
জলপ্রবাহ বণ্টন
১৯৮৩ খ্রিষ্টাব্দের জুলাই মাসে বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে মন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠকে তিস্তা নদীর জল বণ্টনের ব্যাপারে স্থির হয় যে, তিস্তা নদীর জলের শতকরা ৩৬ শতাংশ পাবে বাংলাদেশ এবং ৩৯ শতাংশ পাবে ভারত। বাকী ২৫ শতাংশ জল নদীটির সংরক্ষিত রাখা হবে। কিন্তু কী ভাবে এই জল ভাগাভাগি হবে সে বিষয়ে কোন দিকনির্দেশনা ছিল না। বহুকাল পরে ২০০৭ খ্রিষ্টাব্দের ২৫, ২৬ ও ২৭ সেপ্টেম্বর অনুষ্ঠিত একটি যৌথবৈঠকে বাংলাদেশ তিস্তার জলের ৮০ শতাংশ দু’দেশের সমান অংশে ভাগ করে অবশিষ্ট ২০ শতাংশ নদীর জন্য সংরক্ষিত রাখার বিষয়ে প্রস্তাব দেয়। ভারত এই প্রস্তাবে অসম্মতি প্রকাশ করে। নীলফামারীর তিস্তা নদীর উজানে ভারত জলপাইগুড়ি জেলার মালবাজার মহকুমায় গজলডোবা বাঁধ নির্মাণ করে বাংলাদেশে স্বাভাবিক জলপ্রবাহ নিয়ন্ত্রণ করছে । ২০১৩ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তিস্তা নদীর মূল জলপ্রবাহের উল্লেখযোগ্য অংশ বাংলাদেশের তিস্তায় আসতে দেয়া হয়েছে। ২০১৪ খ্রিস্টাব্দের শুষ্ক মৌসুমে ভারত কর্তৃক তিস্তার জলপ্রবাহ বন্ধ করে দেয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশের জল-ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ড. আইনুন নিশাত বলেন যে, ‘তিস্তার মূল প্রবাহ ভারত প্রত্যাহার করে নিয়েছে। তিস্তায় ডালিয়া ব্যারাজে উজান থেকে আসা জলপ্রবাহ প্রায় শূন্য। এখন যে ৬০০-৭০০ কিউসেক জল যা আসছে তা, ধারণা করি, ভারতের গজলডোবা ব্যারাজের ভাটির উপনদী থেকে’।[১২] একটি সংবাদ প্রতিবেদনে বলা হয়, 'তিস্তার জলের ব্যাপারে ভারত আন্তর্জাতিক আইন ও মামলার উদাহরণ মানছে না। ফলে বাংলাদেশ অংশে তিস্তা মরে গেছে। জল বণ্টনের ব্যাপারে ভারতের একগুয়েমিতা, অনৈতিক ঢিলেমি ও হটকারীতায় তিস্তা তীরবর্তি ও আশেপাশের প্রকৃতি রুক্ষ হয়ে উঠেছে। তলদেশে অজস্র পাথর, নুড়ি, বালি আর পলি পড়ে তিস্তার বুকে শুষ্ক মৌসুমে উত্তপ্ত বালুর স্তুপ। অন্যদিকে বর্ষাকালে মুল গতিপথ বদলিয়ে তিস্তা প্রচন্ডভাবে আছরে পড়ে দুই তীরে। ফলে নির্দয় ভাঙ্গনে ফি বছর ২০ হাজার মানুষ বাড়িঘর, গাছপালা, আবাদী জমি হারিয়ে পথের ভিখেরী হয়। নদীর প্রবাহ পথে বিশাল চর ও উভয় তীরে ভাঙ্গনের তান্ডবে তিস্তার বাংলাদেশ অংশে এর প্রস্থ কোন কোন জায়গায় ৫ কিলোমিটারেরও বেশি। কোন জায়গায় ৫০০ মিটার।[১৩]
তিস্তার জল দিয়ে ন’লক্ষ হেক্টর জমিকে সেচসেবিত করে তুলতে চায় পশ্চিমবঙ্গ। আর বাংলাদেশ চায় সাত লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের জল দিক তিস্তা। নদী-বিশেষজ্ঞদের মতে, এই ১৬ লক্ষ হেক্টর জমিতে সেচের জন্য নদীর জল দিতে গেলে শুখা মরসুমে তিস্তায় প্রতি সেকেন্ডে ১৬০০ ঘন মিটার জল থাকা দরকার। অথচ এখন থাকে প্রতি সেকেন্ডে ১৫০-২০০ ঘন মিটার জল। সিকিমে তিস্তার উপরে তৈরি জলবিদ্যুৎ প্রকল্প থেকে ছাড়া জল পশ্চিমবঙ্গের তিস্তা ব্যারাজ ধরে রাখতে পারে না। অর্থাৎ সেচের জন্য তিস্তার কাছে যতটা জল প্রত্যাশা করা হচ্ছে, বাস্তব অবস্থার সঙ্গে সেই চাহিদা মোটেই সামঞ্জস্যপূর্ণ নয় বলে মনে করছেন নদী-বিশেষজ্ঞেরা।[১৪]
↑মানিক মোহাম্মদ রাজ্জাক (ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। "উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের নদী"। বাংলাদেশের নদনদী: বর্তমান গতিপ্রকৃতি (প্রথম সংস্করণ)। ঢাকা: কথাপ্রকাশ। পৃষ্ঠা ১২১-১২৩। আইএসবিএন984-70120-0436-4।|সংগ্রহের-তারিখ= এর |ইউআরএল= প্রয়োজন (সাহায্য)উদ্ধৃতি শৈলী রক্ষণাবেক্ষণ: ISBN ত্রুটি উপেক্ষিত (link)
↑বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন, ২০১৪)। "তিস্তা নদী"। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। সংগ্রহের তারিখ ৮ জুলাই ২০১৫।এখানে তারিখের মান পরীক্ষা করুন: |তারিখ= (সাহায্য)[স্থায়ীভাবে অকার্যকর সংযোগ]
↑ কখ
Majumdar, Dr. R.C., History of Ancient Bengal, First published 1971, Reprint 2005, p. 4, Tulshi Prakashani, Kolkata, আইএসবিএন৮১-৮৯১১৮-০১-৩.
↑
Majumdar, S.C., Chief Engineer, Bengal, Rivers of the Bengal Delta, Government of Bengal, 1941, reproduced in Rivers of Bengal, Vol I, 2001, p. 45, published by Education department, Government of West Bengal.