জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত (জন্ম : ১ সেপ্টেম্বর, ১৯৩৯) হলেন একজন বাংলাদেশী সাহিত্যিক, গল্পকার ও ঔপন্যাসিক। ষাটের দশকে গল্প দিয়ে তার সাহিত্যিক জীবন শুরু হয়েছিল। তার গল্পে উঠে এসেছে সামাজিক ও রাজনৈতিক বাস্তবতা, জীবনদর্শন, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ, এমনকি আধুনিক জীবনযাত্রা। তিনি সৃষ্টি করেছেন সাহিত্যে নতুন ধারা 'ছোট উপন্যাস' অর্থাৎ 'উপন্যাসিকা'। তিনি বাংলা সাহিত্যের একজন শক্তিমান লেখক।গল্পকার হিসেবে ১৯৭১ সালে লাভ করেন বাংলা একাডেমি পুরস্কার। ২০১৬ সালে ভূষিত হয়েছেন বাংলাদেশের দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান একুশে পদকে।[১]
প্রাথমিক জীবন
জ্যোতিপ্রকাশ ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের (তৎকালীন ব্রিটিশ ভারত) কুষ্টিয়া জেলার আমলাবাড়িতে তার মামার বাড়িতে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবার নাম কৃষ্ণগোপাল দত্ত ও মায়ের নাম সুধা দত্ত। তিনি ছিলেন তার বাবা-মায়ের পঞ্চম সন্তান। তার পৈতৃক বাড়ি ছিল পাবনা জেলায়। ছেলেবেলা কেটেছে পাবনা জেলা ও বগুড়া জেলায়। ছেলেবেলায় মাকে হারানোর পর তার জীবন দুঃখ-কষ্টে কাটে। মুদি দোকানে কাজ করে, খবরের কাগজ বিলি করে শৈশব পার করেন।[২]
শিক্ষাজীবন
তার শিক্ষাজীবন শুরু হয় বগুড়ার মিউনিসিপ্যাল হাই স্কুলের পাঠ দিয়ে। বগুড়ার সরকারি আজিজুল হক কলেজ থেকে তিনি আইএ পাস করেন। পরে ১৯৬১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক ও ১৯৬২ সালে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। এরপর ১৯৬৩ সালে তিনি সাংবাদিকতা বিভাগে নৈশ কোর্সে ভর্তি হন ও সেখান থেকে ডিপ্লোমা লাভ করেন। তিনি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সাংবাদিকতা বিভাগের প্রথম ব্যাচের ছাত্র। ১৯৬৯ সালের শেষের দিকে উচ্চশিক্ষার লক্ষ্যে যুক্তরাষ্ট্রে যান। সেখানে ফিলাডেলফিয়ার টেম্পল ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিষয়ে তার দ্বিতীয় স্নাকতোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৭২-৭৬ সময়ে পিএইচডি কোর্সে ছাত্র থাকাকালীন কর্মরত ছিলেন ইউনিভার্সিটি অব মিসৌরীর তথ্যসরবরাহ বিভাগে তথ্য বিশেষজ্ঞ হিসেবে। ১৯৮০ সালে এই ইউনিভার্সিটি থেকে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিয়য়ে পিএইচডি ডিগ্রি লাভ করেন।[৩]বাংলাদেশের ইতিহাসে তিনি প্রথম সাংবাদিকতায় পিএইচডি করার সৌভাগ্য লাভ করেন।
পারিবারিক জীবন
জ্যোতিপ্রকাশ ১৯৬৭ সালের ২৪ সেপ্টেম্বর আরেক স্বনামধন্য লেখিকা পূরবী বসুকে বিয়ে করেন। শিক্ষাবিদ ড. গোবিন্দ চন্দ্র দেবের বাড়িতে তাদের প্রথম দেখা হয়। সেই থেকে প্রেম। উচ্চশিক্ষার জন্য জ্যোতিপ্রকাশ যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে গোবিন্দ চন্দ্র দেব ও লেখক বন্ধু হায়াৎ মাহমুদের উদ্যোগে তাদের বিয়ে হয় পূরবীর গ্রামের বাড়ি মুন্সিগঞ্জে।[৪] তাদের দুই সন্তান। মেয়ে জয়ীষা রাগিনী দত্ত ও ছেলে দীপন রাগ দত্ত।
কর্মজীবন
জ্যোতিপ্রকাশের কর্মজীবন শুরু হয় তার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াকালীন সময়ে। তখন তিনি ইষ্ট বেঙ্গল পাবলিশার্সে গ্রন্থমুদ্রণ ও প্রকাশনার কাজে যোগদান করেন। তৎকালীন বাংলার আধুনিক প্রকাশক গল্পলেখক আহমদ মীর 'বার্ডস এ্যান্ড বুকস' প্রতিষ্ঠা করলে তিনি সেখানে যোগ দেন। এ সময়ে তিনি সেবাব্রত চৌধুরী, হায়াৎ মাহমুদ, হুমায়ুন চৌধুরী, শামসুল হকদের সাথে 'লিটল ম্যাগাজিন'-এর সম্পাদনার দায়িত্বে ছিলেন। পরে এনামুল হক সম্পাদিত দ্বি-মাসিক সাহিত্যপত্র 'উত্তরণ'-এর সহ-সম্পাদক হিসেবে কাজ করেন। মাসিক সিনে ম্যাগাজিন 'পরিচয়'-এ সম্পাদক হিসেবে কর্মরত থাকাকালীন তিনি সাহিত্য-সংস্কৃতিতে আরও আকৃষ্ট হন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে ১৯৬২ সালে তিনি বাংলা একাডেমিতে প্রথমে সহকারী প্রকাশনা অফিসার ও পরে সহকারী সংকলন অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৫ সালের শেষের দিকে তিনি প্রমিত বাংলা অভিধান রচনায় অবদান রাখেন। পরের বছর ১৯৬৬ সালে তিনি তৎকালীন পাকিস্তান অবজারভারে সহকারী সম্পাদক পদে যোগ দেন। একই সময়ে তিনি 'হলিডে' পত্রিকায় নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন। ১৯৬৯ সালে যুক্তরাষ্ট্রে যান এবং সেখানে ১৯৮০ সাল থেকে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আটবছর লুইজিয়ানার গ্রাম্বলিং স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সাংবাদিকতা বিভাগে অধ্যাপনা করেন।[৩] পরে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত বিখ্যাত প্রকাশনাসংস্থা জন উইলি অ্যান্ড সন্সের সম্পাদনার দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি বাংলাদেশের অন্যতম বৃহৎ এনজিও 'প্রশিকা'র তথ্য উপদেষ্টা পরিচালক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছেন। এছাড়া খণ্ডকালীন অধ্যাপক হিসেবে যোগ দেন ঢাকার ইস্ট ওয়েস্ট ইউনিভার্সিটিতে যোগাযোগ ও তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগে।[২]
সাহিত্যজীবন
তার সাহিত্য জীবনে 'লিটল ম্যাগাজিন' ও 'উত্তরণ'-এর প্রভাব লক্ষণীয়। এই দুটি সাহিত্যপত্রে কাজ সরার সময় থেকে তার লেখালেখি শুরু হয়। তার সাহিত্য জীবন দুটি পর্যায়ে বিভক্ত। প্রথম পর্যায় ১৯৫৮ সাল থেকে ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত। মাঝে দীর্ঘ ১৮ বছর বিদেশে উচ্চশিক্ষা, নতুন দেশ ও ভাষা, কর্ম সব মিলিয়ে লেখালেখি থেকে দূরে ছিলেন। তার দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয় ১৯৮৭ সালে দেশে আসার পর থেকে।১৯৮৭ সালের পরে তিনি আবার নিয়মিত লেখালেখি শুরু করেন।[৫]
গল্প
১৯৬৫ সালে তার প্রথম গল্পগন্থ দুর্বিনীত কাল প্রকাশিত হয়। তার গল্পে রয়েছে ছন্দময় কবিতার ছোঁয়া ও সাংকেতিময়তা। তার পরমাত্মীয় গল্পে তিনি সাইদ ও শ্রীমন্ত দুই ধর্মের অনুসারী দুই বন্ধুর দুটি চরিত্রের আড়ালে ১৯৪৭ সালের দেশবিভাগ ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির বর্ণনা দিয়েছেন। তার অন্যান্য গল্পগন্থ ফিরে যাও জ্যোৎস্নায়, প্লাবনভূমি, যে তোমায় ছাড়ে, নামহীন ফিরিবে সে নীল জ্যোৎস্নায়, জলজকুসুম, হিম চন্দ্রাতপে-এ তিনি সমাজের বিভিন্ন শ্রেণির মানুষ, সামাজিক ও রাজনৈতিক নিপীড়নের বর্ণনা দিয়েছেন।[৬] ১৯৮৯ সালে প্রকাশিত পুনরুদ্ধার গল্পে তিনি ব্যক্তির নিজের ক্রোধানুভূতির মাধ্যমে ১৯৬৯ সালের দেশের রাজনৈতিক অস্থিরতার বর্ণনা দিয়েছেন এবং এ থেকে উদ্ধার পাওয়ার আকাঙ্ক্ষা ব্যক্ত করেছেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ নিয়েও তিনি গল্প লিখেছেন। এসব গল্পে যুদ্ধের ভয়াবহ সত্যকে তুলে ধরেছেন। আমৃত্যু আজীবন গল্পে যুদ্ধপরাধী রাজাকারদের পরিচয় ও তাদের প্রতি সমাজের সাধারন মানুষের ঘৃণা এবং তাদের নিয়ে তাদের পরিবার ও আত্মীয়স্বজনদের লজ্জা প্রকাশ পেয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা গল্প আমৃত্যু আজীবনের বিপরীত, এতে মুক্তিযুদ্ধাদের আত্মত্যাগ ও তাদের নিয়ে মানুষের গর্ব ও অহংকার বর্ণিত হয়েছে। আমার ফুরানোর কাল গল্পের মাধ্যমে তিনি একজন বালকের চিন্তার বিকাশের পাশাপাশি যুদ্ধের বিবরণ দিয়েছেন। এছাড়া গল্পকল্প ও বাঁচামরার জীবন লিখেছেন আধুনিক জীবনধারা নিয়ে। আধুনিক জীবনযাত্রার আড়ালে চিরচেনা জীবনের দূরে সরে যাওয়া ব্যক্ত করেছেন এই গল্পে।[৭]
উপন্যাস ও স্মৃতিকথা
তিনি ১৯৫৮ সালে কুয়াশা নামে একটি কিশোর রহস্যোপন্যাস লেখেন। সাহিত্যে 'ছোট উপন্যাস' নামে একটি নতুন ধারা সৃষ্টি করেছেন। তার এই রচনাগুলো গল্প থেকে বড় এবং উপন্যাসের মত বিস্তৃত পটভূমি থাকলেও আকারে ছোট। তার এই ধরনের উপন্যাসগুলো হল শূন্য নভে ভ্রমি, স্বপ্নের সীমানায় পারাপার, উড়িয়ে নিয়ে যা কালোমেঘ। তার রচিত স্মৃতিকথা সময় ভোলে না কিছু। বহে নিরন্তর নামে একটি অংশ অন্যদিন ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয়েছে।[৬]
গ্রন্থতালিকা
গল্পগ্রন্থ
দূর্বিনীত কাল (১৯৬৫)
বহে না সুবাতাস (১৯৬৭)
সিতাংশু তোর সমস্ত কথা (১৯৬৯)
দিন ফুরানোর খেলা (১৯৮৮)
পুনরুদ্ধার (১৯৮৯)
উড়িয়ে নিয়ে যা কালমেঘ (১৯৯২)
স্বদেশ দূরদেশ (১৯৯৪)
নির্বাচিত গল্প (১৯৯৪)
পরমাত্মীয়
আমৃত্যু আজীবন
ফিরে যাও জ্যোৎস্নায় (১৯৯৭)
প্লাবনভূমি (২০০০)
মুক্তিযোদ্ধারা (২০০১)
জলপরী তো নাচবেই (২০০২)
গল্প সংগ্রহ (২০০১)
গল্পকল্প ও বাঁচামরার জীবন (২০০৫)
না আলো না আঁধার (২০০৫)
শ্রেষ্ঠ গল্প (২০০৮)
শূন্য গগনবিহারী
কালপুরুষ
বিবি হাওয়ার আপনজন ও নারী জীবনের অন্যান্য গল্প
যাদু ও বাস্তবতার গল্প
চন্দ্রালোকে ছায়াহীন
যে তোমায় ছাড়ে
নামহীন ফিরিবে সে নীল জ্যোৎস্নায়
জলজকুসুম
হিম চন্দ্রাতপে
হিম জীবন
জীবনে গল্প আছে
গল্পকল্প ও বাঁচামরার জীবন
প্রিয় গল্প
উপন্যাস
শূন্য নভে ভ্রমি
স্বপ্নের সীমানায় পারাপার
উড়িয়ে নিয়ে যা কালোমেঘ
অনুবাদ
লেখকের কথা, ফখরুজ্জামান চৌধুরীর সঙ্গে
Exile of the rose and other Stories (১৯৯৭)
ওয়ান মিলিয়ন এন্ড ওয়ান লাভ স্ট্র্যাটেজিজ ফর মিটিং ইওর ড্রিম পার্টনার
প্রবন্ধগ্রন্থ
ভিন্ন নদী একই স্রোত (১৯৯০)
সময় অসময়ের মুক্তিযুদ্ধ
ছড়ানো জীবনের নানা লেখা
বাংলাদেশ : সমাজ ও অর্থনীতি
কিশোর রহস্যোপন্যাস
কুয়াশা (১৯৫৮)
সম্পাদনা
তোমার সাম্রাজ্যে, যুবরাজ - হায়াৎ মামুদ সহযোগে
নজরুল বিষয়ক রচনা সংকলন (১৯৭৩)
সপ্তক - হায়াৎ মামুদ ও সেবাব্রত চৌধুরী সহযোগে (১৯৬৩)
↑ কখ"জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত"। দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড। ২৬ মে ২০১৬ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৬।
↑ কখনাহার মনিকা (১ সেপ্টেম্বর ২০১৩)। "জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত : জীবনপঞ্জি"। গল্পপাঠ। ২৩ ফেব্রুয়ারি ২০১৯ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ২৪ অক্টোবর ২০১৬।