চালচিত্র হল সাবেকি দুর্গা প্রতিমার উপরিভাগে অঙ্কিত দেবদেবীর কাহিনিমূলক পটচিত্র, যা প্রধানত অর্ধগোলাকৃতি হয়। চালচিত্রে পঞ্চানন শিব, মহিষাসুর বধ, নন্দীভৃঙ্গী, শুম্ভ-নিশুম্ভের যুদ্ধ প্রভৃতি কাহিনির ধারায় বর্ণিত থাকে। এই চিত্রকলার একটি নিজস্ব রূপরেখা ও শৈলীগত দৃঢ় বুনিয়াদ রয়েছে। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল ‘‘পট লেখা’’, যা বাংলার পটচিত্রের একটি বিশেষ ধারা।[১]
নামকরণ
চালচিত্র শব্দের ‘‘চাল’’ শব্দের অর্থ আচ্ছাদন। প্রতিমার চালির উপরে আঁকা হয় বলে এর নাম চালচিত্র। বীরভূমের দুর্গা পটের উপর আচ্ছাদন হিসেবে এটি ব্যবহার করা হয়। শিল্পীদের ভাষায় এই চালচিত্র হল আসলে ‘‘পটলেখা’’। এটি দুর্গা চালা বা দেবীচাল নামেও পরিচিত।
প্রকারভেদ
প্রতিমার চালির বিভিন্নতার উপর নির্ভর করে প্রতিমার চালচিত্রকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করা যায়। যেমন বাংলা চালি, খোপচালি, টানাচৌড়ি, মঠচৌড়ি ও মার্কিনিচালিতে চালচিত্রের বিভিন্নতা দেখা যায়। আবার চালচিত্রের বিষয়বস্তু অনুসারে একে কয়েকভাগে ভাগ করা যায়, যেমন কৈলাসী, দশাবতারী, বৃন্দাবনী, রামচন্দ্রী ইত্যাদি। তবে বাংলার বনেদি বাড়ির প্রতিমায় কৈলাসী ও দশাবতারী চালচিত্রের অধিক প্রচলন।[২]
বিষয়বস্তু
চালচিত্রের মূল বিষয়বস্তু হল শিবদুর্গা, কৈলাস, শিব অনুচর নন্দীভৃঙ্গী, মহিষাসুর বধ, দশাবতার ইত্যাদি। বীরভূম জেলার হাটসেরান্দির সূত্রধর সমাজে এই ধরনের এক বিশেষ চিত্রসম্ভার দেখা যায়, যাকে দুর্গা পট বলা হয়। তবে এখানে দুর্গা প্রতিমার বদলে দুর্গা পটেই পূজার্চনা করা হয়। দুর্গা পটের উপর অর্ধবৃত্তাকার চালচিত্র থাকে। এই ধরনের চালচিত্রে রাম, সীতা, শিব, নন্দীভৃঙ্গী, ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শুম্ভ-নিশুম্ভ অঙ্কিত থাকে। কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গার চালচিত্রের মধ্যে অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। এখানকার চালচিত্রে মাঝখানে থাকে পঞ্চানন শিব ও পাশে পার্বতী, তার একপাশে থাকে দশমহাবিদ্যা ও অন্য পাশে দশাবতার।[৩] ভারতীয় সংগ্রহালয়ের প্রাক্তন অধিকর্তা বলেছেন- বাংলায় বিভিন্ন ধরনের চালচিত্রের প্রয়োগ আছে ও তাদের মধ্যে বিভিন্নতা লক্ষ্য করা যায়। মঠচৌরি চালির চালচিত্রে দেবীর অবয়বগুলি থাকে উপর থেকে নিচে, একটির নিচে অপরটি। আবার সাবেক বাংলা চালিতে সেগুলো থাক থাক করে আলাদা আলাদা ভাবে থাকে। অন্য দিকে, মার্কিনি চালিতে পটচিত্রগুলি থাকে পাশাপাশি।
প্রাচীনত্ব
বাংলায় প্রতিমা নির্মাণ ধারার দুটি উল্লেখযোগ্য রীতি হল বিষ্ণুপুর রীতির প্রতিমা ও কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমা। এর মধ্যে অধিক জনপ্রিয় কংসনারায়ণ রীতির প্রতিমার প্রধান বৈশিষ্ট্য হল চালচিত্র। সেই সময়েও প্রতিমার পিছনে অর্ধবৃত্তাকার চালির ব্যবহার ছিল। নবদ্বীপ শাক্তরাসের ৩০০-৪০০ বছরের প্রাচীন প্রতিমাগুলিতে চালচিত্রের ব্যবহার লক্ষ্য করা যায়। বৈষ্ণব রাসের সাথে সাথে যখন শাক্ত রাসের প্রচলন হয় তখন সুবিশাল দেবীচালা বা চালচিত্রের জনপ্রিয়তা হ্রাস পেলেও বর্তমানে অনেক ঠাকুরেই চালচিত্রের ঐতিহ্য ফিরেছে।[৪]নবদ্বীপের চালচিত্র শিল্পী তপন ভট্টাচার্য বলেছেন-
“
প্রায় হারিয়ে যাওয়া একটি চিত্রকলা ফের ফিরে আসছে দেখে ভাল লাগছে।
”
ঐতিহ্য
কৃষ্ণনগর রাজবাড়ির রাজরাজেশ্বরী দুর্গায় চালচিত্রের ব্যবহারে অনন্যতা লক্ষ্য করা যায়। কলকাতার দর্পনারায়ণ ঠাকুর স্ট্রিটের বৈষ্ণবদাস মল্লিক ও হাওড়ার রামকৃষ্ণপুরের বসু পরিবারে পট লেখার ঐতিহ্য এখনও ঠিকে আছে।[৩] উত্তর কলকাতার চোরাবাগানের রামচাঁদ শীল পরিবারের বিমানবিহারী শীল চালচিত্র প্রসঙ্গে বলেছেন-
“
আগে চালিতে পট লেখা হলেও ভাল চালচিত্র শিল্পী সংখ্যায় কমে যাওয়ায় এখন দেবীর চালচিত্রে ব্যবহার করা হয় হাতে আঁকা চালচিত্র
”
কৃষ্ণনগরের চালচিত্র শিল্পী বিশ্বনাথ পাল কলকাতার বিভিন্ন বনেদি পরিবারে পট লেখেন।[৩] তিনি বলেছেন-
“
বনেদি পরিবার আজও হাতে আঁকা পট পছন্দ করে। পুজোর আগে এখনও খিদিরপুর ও উত্তর কলকাতার বেশ কিছু বাড়িতে পট লিখতে যেতে হয়।
”
পদ্ধতি
প্রতিমার চালির উপরিভাগে অর্ধগোলাকৃতি বাঁশের খাঁচা করে তার উপর কাদালেপা এক প্রস্থ মোটা কাপড় টানটান করে লাগিয়ে কাপড়ের বারতি অংশ বাঁশের খাঁচার পিছন দিকে মুড়ে দেওয়া হয়। কাদালেপা কাপড়টি শুকিয়ে গেলে তার উপর খড়ি গোলার কয়েকটি আস্তরণ দেওয়া হয়। এর উপর পরিকল্পিত কাহিনিমূলক চিত্র আঁকা হয়।
ব্যবহৃত রঙ
রঙ করার ক্ষেত্রে প্রাকৃতিক রঙ ব্যবহৃত হয়, যা বাংলার পটচিত্রের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। চালচিত্রে সাধারণত নীল, হলুদ, সবুজ, লাল, খয়েরি, কালো ও সাদা রঙ ব্যবহার করা হয়। প্রকৃতপক্ষে চালচিত্রের অঙ্কনরীতি বাংলার পটচিত্রের অনুকরণ করেছে।[১] চালচিত্রে সাদা রঙের জন্য খড়িমাটি, হলুদ রঙের জন্য পিউরি, নীলের জন্য খেতের নীল, কালো রঙের জন্য ভুষোকালি ও লাল রঙের জন্য মেটে সিন্দুর ব্যবহার করা হয়।[৩]