ঐতিহাসিকদের মতে,১৫০০থেকে ১৬০০ সাল পর্যন্ত বর্তমান গুরুদাসপুরের চাপিলা রাজশাহী অঞ্চলের সদরদপ্তর বিদ্যমান ছিল। যার অনেক মুঘল নির্দশন এখনো কালের সাক্ষী হয়ে দাড়িয়ে আছে।তার অনেক পরে গুরুদাসপুর ১৯১৭ সালে থানা প্রতিষ্ঠিত হয় এবং ১৯৮৪ সালে একে উপজেলায় রূপান্তরিত করা হয়।
নামকরণ
যতদূর জানা যায়, আনুমানিক ১৭৬৭ সালের দিকে 'গুরুদাস' নামক জনৈক পাটনী গুরুদাসপুর চর হতে ঝাউপাড়া পর্যন্ত খেয়া দিত। এই পাটনীর নামানুসারেই এই জায়গার নাম গুরুদাসপুর হয়েছে।
আবার, কেউ কেউ বলেন যে, প্রাচীন আমলে গুরুদাসপুর উপজেলার নামকরণ করা হয়েছে। কথিত আছে ইংরেজ আমলে বড় লর্ড এক ইংরেজকে জিজ্ঞাসা করেছিল তুমি কোন মুল্লক হতে আসিলে, এই যে হুজুর। যে মুল্লকের গুরু গোবিন্দ মাঝি খেয়ানৌকা পাড়াপার করিতেছে। আমি সেই মুল্লক হইতে আসিয়াছি। কালক্রমে মাঝির নাম অনুসারে গুরুদাসপুর নামকরণ করা হইয়াছিল।[৩]
ঐতিহ্য
চলনবিল এ উপজেলার একটি ঐতিহ্য। বর্ষা মৌসুমে দেশের বিভিন্ন প্রান্তর থেকে মানুষ এ বিল দেখতে আসে এবং নৌকা ভ্রমণ করে । খুবজীপুরে একটি যাদুঘর যা অন্য কোন উপজেলায় নাই । বোরো মৌসুমে চলনবিলে ধানের ফসলে এক প্রাকৃতিক মনোরম দৃশ্য সৃষ্টি করে । এ উপজেলা বর্তমানে রসুনের আবাদের জন্য বিখ্যাত । এ উপজেলার নাজিরপুর ইউনিয়নে মামুদপুর ,জোমাই নগর ও বিয়াঘাট গ্রাম এলাকার মোজাফ্ফর জাতের লিচু বিখ্যাত ।[৪]
ঐতিহ্যবাহী জলাভূমি চলনবিলই বাংলাদেশের জলময় ভূ-ভাগের মধ্যে এই সর্ববৃহৎ বিল। রাজশাহী বিভাগের চারটি জেলা আটটি উপজেলা, ৬০টি ইউনিয়ন, ১৬০০ গ্রাম এবং ১৪টি নদী নিয়ে এর বিস্তৃতি। এছাড়া রয়েছে ছোট বড় অনেক জলাশয়।[৪]
প্রস্থে চলনবিল প্রায় ১৩কিলোমিটার, তাড়াশ থেকে নারায়নপুর পর্যন্ত প্রস্থ আর দৈর্ঘে সিংড়া থেকে কাছিকাটা পর্যন্ত প্রায় ২৪ কিলোমিটার।
সিরাজগঞ্জ রায়গঞ্জ উপজেলা এবং পাবনার চাটমোহর উপজেলার অধিকাংশ অংশ এ বিলের মধ্যে পড়েছে। একপাশে নাটোরের সিংড়া উপজেলা, আরেক পাশে গুমানী নদী। চলনবিলের দক্ষিণ-পূর্ব দিকে পাবনার অস্টমনিষা, যেখানে গুমানী এবং বড়াল নদী মিশেছে।[৪]
পুরাতন বক্ষ্মপুত্র গতিপথ পরিবর্তন করে যুমনা জন্মের সময় চলনবিলের উৎপত্তি। সম্ভবত করতোয়া আর আত্রাই নদীর বিস্তৃতি অংশ পরিত্যক্ত হয়ে বিশাল একটা জলাশয়ের সৃষ্টি হয়। এ বিলের সৃষ্টি ঐতিহাসিকভাবে আত্রাই এবং বড়াল নদীর সাথে জড়িত। আত্রাই নদী এই বিলের প্রধান পানি সরবরাহকারী নদী, আর বড়াল নদী দিয়ে এর পানি সরাসরি যুমাতে নিস্কাষিত হয়।[৪]
বর্ষায় এই বিল হয়ে ওঠে কানায় কানায় পূর্ণ। মাছের জন্য পরিণত হয় অভয়ারণ্যে। এ সময় দূরে দূরে অবস্থিত গ্রামগুলো অপরূপ দেখায়। শীতের সময় এসব গ্রাম মেতে ওঠে পানকৌড়ি, মাছরাঙা, শালিক, বক ও বুনো কবুতরসহ নানা পাখির কলতান আর উড়োউড়িতে।[৪]
১৯১৯ সালে ইম্পেরিয়াল গেজেটিয়ার অব ইন্ডিয়ার হিসেব মতে, চলবিলের আয়তন ৫০০ বর্গমাইল বা প্রায় ১৪২৪ বর্গকিলোমিটার। অপরদিকে ১৯৬৮ সালের জরিপ মোতাবেক চলবিলের আয়তন ৮০০ বর্গমাইল বা প্রায় ২০৭২ কিলোমিটার।[৪]
বর্তমানে চলনবিল অনেকখানি হ্রাস পেয়ে আয়তন দাঁড়িয়েছে ১১৫০ বর্গকিলোমিটারে। সংকুচিত হওয়ার পেছনে রয়েছে অনেক কারণ। বর্ষা মৌসুমে বিলে পলি পড়া (২২২.৫ মিলিয়ন ঘনফুট), অপরিকল্পিত বসতবাড়ি স্থাপন, জাতীয় প্রয়োজনে সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল থেকে নাটোরের বনপাড়া পর্যন্ত প্রায় ৫৫ কিলোমিটার এর মহাসড়ক নির্মাণ উল্লেখযোগ্য।[৪]
এঅঞ্চলের মানুষের অভিমত, চলনবিল মাছ হচ্ছে তাদের শস্যখনি, বাস্তবেও তাই। এখানকার মাটি উর্বর। বিল শুকিয়ে গেলে উর্বর মাটিতে কৃষকগণ ধানের চারা রোপণ করেই উল্লাসে ফেটে পড়েন। তারা জানেন স্বল্প ব্যয়ে তাদের গোলা ভরে যাবে। শুধু তাই নয়, বর্ষার শেষ নাগাদ চলে এখানে মাছ ধরার মহোৎসব। সেই হিসেবে চলবিল মৎস্যখনিও বটে।[৪]
এখানে পাওয়া যায় দেশী পুঁটি, গজার, বোয়াল, শৈল, টাকি, টেংরা, পাতাসী, খলসে, বাইম, কাকলা, চিতল, চেলা, আইকর, শিংসহ নানান ধরনের দেশি মাছ। এই বিপুল মাছের ভান্ডারে আছে প্রচুর কাঁকড়া।[৪]
চলনবিল এলাকায় জমজমাট হয়ে উঠেছে হচ্ছে ঝিনুক-মুক্তার বাণিজ্য। এ বিলে প্রাকৃতিক নিয়মে ঝিনুকের পেটে প্রচুর মুক্তার জন্ম হয়। এখনাকর নাীরা ঝিনুক কুড়িয়ে পেট চিড়ে মুক্তা সগ্র করে বড় কারবারিদের হাতে তুলে দেন আর মাছ চাষীদের হাতে তুলে দেন ঝিনুকের মাংস। তারা পান এর বিনিময় মূল্য।[৪]
প্রশাসনিক এলাকা
গুরুদাসপুর উপজেলায় ১টি পৌরসভা, ৬ টি ইউনিয়ন, ৬৩ টি ওয়ার্ড, ১০৬ টি মৌজা এবং ১২৮ টি গ্রাম রয়েছে।
মোট জনসংখ্যা প্রায় ১,৯৪,২২৮ জন। তন্মধ্যে, পুরুষ ৯১,০৭১ ও মহিলা ১,০৩,১৫৭ জন।[৬]
মোট জনসংখ্যার ৯৪.০৭% মুসলিম, ৫.৪৯% হিন্দু এবং অন্যান্য ধর্মাবলম্বী ০.৪৪%।[৬]
শিক্ষা
সাক্ষরতার হার ৩৪.৯১%। পুরুষ ৩৯.৬১%, মহিলা ৩০.০১%[২]। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান: ডিগ্রী কলেজ-৪ টি, মাধ্যমিক স্কুল এন্ড কলেজ-৫ টি, কারিগরি কলেজ ৭ টি, মাধ্যমিক বিদ্যালয় -২৭ টি, সিনিয়র মাদ্রাসা -২ টি, দাখিল মাদ্রাসা ১৯ টি, এবতেদায়ি মাদ্রাসা-২০ টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়- ৪৯টি, বে-সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়- ২৯টি।
কলেজ ৫ টি, হাইস্কুল ২৪ টি, মাদ্রাসা ৫৭ টি, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ৭৮ টি, কারিগরি প্রতিষ্ঠান ১টি।
সংস্কৃতি
সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের মধ্যে ক্লাব ৪০ টি, পাবলিক লাইব্রেরি ৩ টি, সিনেমা হল ২ টি, থিয়েটার মঞ্চ ১ টি, জাদুঘর ১ টি।
প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন
চলনবিল অঞ্চলের ইতিহাস, ঐতিহ্য ও সংস্কৃতি রক্ষার উদ্দ্যেশ্যে। গুরুদাসপুর উপজেলার খুবজীপুর গ্রামে ১৯৭৮ সালে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে চলনবিল জাদুঘর। এটি বাংলাদেশ প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের আওতাধীন। অন্যান্য প্রাচীন নিদর্শনের মধ্যে পিপলা গ্রামে মুঘল আমলের একটি মসজিদ উল্লেখযোগ্য।[৭]
নাটোর জেলা সদর থেকে ৫০ কি.মি. পূর্বে গুরুদাসপুর উপজেলা থেকে ৪ কিঃ মিঃ উত্তরে খুবজীপুর ইউনিয়নে চলনিবল যাদুঘর অবস্থিত। গুরুদাসপুুর উপজেলা থেকে যে কোনো যানবাহনে যাওয়া যায়।
স্বাস্থ্য কেন্দ্র: উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ১ টি, স্বাস্থ্য কেন্দ্র ৪ টি, চক্ষু হাসপাতাল ১ টি।
পশু হাসপাতাল ১ টি।
তথ্যসূত্র
↑বাংলাদেশ জাতীয় তথ্য বাতায়ন (জুন ২০১৪)। "এক নজরে উপজেলা"। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার। ২০ সেপ্টেম্বর ২০১৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০১৪।
↑ কখগবাংলপিডিয়া (২০১২)। "Gurudaspur Upazila"। এশিয়াটিক সোসাইটি। ১৭ অক্টোবর ২০১৪ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জুলাই ২০১৪।
↑"পটভূমি"। ২৮ ফেব্রুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২২।
↑ কখগঘঙচছজঝঞ"ঐতিহ্য"। ২৮ জানুয়ারি ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২২।
↑"ইউনিয়ন"। ১৬ এপ্রিল ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৫ জানুয়ারি ২০২২।