চেঙ্গিস খান ও ওগেদাই খানের অধীনে গুয়ুক সামরিক দায়িত্ব পালন করেছেন। তিনি মেরকিত গোত্রের ওগুল কাইমিশকে বিয়ে করেন। তিনি ১২৩৬-১২৪১ সালে রাশিয়া ও মধ্য ইউরোপ অভিযানে অংশ নেন। এই অভিযানে তার চাচাত ভাই বাতু খান ও সৎ ভাই কাদান অংশ নিয়েছিলেন। রাইয়াজান অবরোধে তার সেনাদল অংশ নিয়েছে। ওশেতিয়ার রাজধানী মাগাস অবরোধেও তার বাহিনী অংশ নেয়। অভিযানকালে বিজয় উদযাপনের ভোজ অনুষ্ঠানে গুয়ুকের সাথে বাতু খানের ঝগড়া বাধে।[১][২] গুয়ুক এবং চাগাতাই খানের নাতি বুরি উভয়ে রাগান্বিত হয়ে ভোজ উৎসব থেকে বেরিয়ে যান। এই খবর খাগানের কাছে পৌছানোর পর তাদেরকে মঙ্গোলিয়ায় তলব করা হয়। ওগেদাই তাদের সাথে সাক্ষাত করতে অস্বীকার করেন এবং তার ছেলে গুয়ুককে মৃত্যুদণ্ডের হুমকি দেন। পরে তিনি শান্ত হয়ে গুয়ুককে ডেকে এনে পরিবারের সদস্যদের সাথে কলহের কারণে তিরস্কার করেন। এরপর গুয়ুককে পুনরায় ইউরোপে পাঠিয়ে দেয়া হয়।
১২৪১ সালে ওগেদাই মারা যান। এরপর তার বিধবা স্ত্রী তুরগেন রাজপ্রতিভূ হিসেবে দায়িত্ব নেন। ১২৪৬ সালে তুরগেন তার ছেলে গুয়ুক খানকে খাগান হিসেবে নির্বাচন করাতে সক্ষম হন। চেঙ্গিস খানের ছোট ভাই তেমুগে ক্ষমতা নেওয়ার চেষ্টা করলে গুয়ুক খান মঙ্গোলিয়া ফিরে এসে নিজ অবস্থান সংহত করেন।
ক্ষমতালাভ
১২৪৬ সালের ২৪ আগস্ট মঙ্গোল রাজধানী কারাকোরামে গুয়ুক খানের অভিষেক হয়। অনেক বিদেশি দূত এতে উপস্থিত ছিলেন। তাদের মধ্যে ছিলেন পোপ চতুর্থ ইনোসেন্টের দূত জিওভান্নি দা পিয়ান, গ্র্যান্ড ডিউক দ্বিতীয় ইয়ারোস্লাভ, আর্মেনিয়ার রাজার ভাই, চতুর্থ কিলিজ আরসালান, আব্বাসীয় খলিফা আল-মুসতাসিমের দূত ও দিল্লির সুলতানআলাউদ্দিন মাসুদের দূত।[৩]
পোপের প্রতিনিধি ক্যাথলিক রাজ্যসমূহে মঙ্গোল হামলার প্রতিবাদ করার পর গুয়ুক জানান যে তারা চেঙ্গিস খান ও ওগেদাই খানের যুগে মঙ্গোল প্রতিনিধিদের হত্যা করেছিল। গির্জা ও মঙ্গোলদের মধ্যকার সম্পর্ক নিয়ে তিনি পোপকে পাঠানো চিঠিতে লেখেন, "আপনাকে অবশ্যই স্বচ্ছ মন নিয়ে বলতে হবে: 'আমরা আপনার প্রজা হব; আমরা আপনাকে আমাদের সামর্থ্য প্রদান করব'। দায়িত্বপালন এবং আনুগত্য স্বীকারের জন্য আপনাকে অবশ্যই আপনাদের সব রাজাকে নিয়ে ব্যক্তিগতভাবে উপস্থিত হতে হবে। শুধুমাত্র তখনই আমরা আপনার আত্মসমর্পণ মেনে নেব। এবং যদি আপনি ঈশ্বরের আদেশ মেনে না নেন এবং আমাদের নির্দেশের বাইরে যান আমরা আপনাকে আমাদের শত্রু হিসেবে ধরে নেব।"
পূর্বে তুরগেন কর্তৃক নিযুক্ত প্রাদেশিক কর্মকর্তাদের মধ্যে আরগুন আঁকা ছাড়া বাকিদের অব্যাহতি দেয়া হয়। তিনি চাগাতাই খানাতেরকারা হালাকুর বদলে ইয়েসু মংকেকে ক্ষমতায় বসান।এছাড়াও তিনি তার বাবার কর্মকর্তা মাহমুদ ইয়ালাভাচ, মাসুদ বেগ এবং চিনকাইওকে প্রদেশের পদে পুনর্বহাল করেন।
শাসনকাল (১২৪৬–১২৪৮)
গুয়ুক তার মায়ের বেশ কিছু অজনপ্রিয় ফরমান বাতিল করে দিয়েছিলেন। তিনি বাগদাদ ও ইসমাইলিদের উপর হামলার জন্য পদক্ষেপ নেন। এছাড়া চীনের সুং রাজবংশের বিরুদ্ধেও পদক্ষেপ নেয়া হয়। সেলজুক শাহজাদাদের মধ্যে ক্ষমতা নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল। এসময় গুয়ুকের নির্দেশে রুকনউদ্দিন মসনদে বসেন। এই সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নের জন্য ২,০০০ মঙ্গোল সৈনিক প্রেরণ করা হয়। গুয়ুক জর্জিয়াকে দুইভাগে বিভক্ত করে ডেভিড উলুকে ক্ষমতায় বসান।[৪] ১২৪৩ সালে সিলিসিয়ান আর্মেনিয়ার রাজা প্রথম হেতুয়াম মঙ্গোলদের সাথে সন্ধি করে তার ভাইকে মঙ্গোল দরবারে প্রেরণ করেন। ১২৪৭ সালে একটি চুক্তি অনুসারে সিলিসিয়ান আর্মেনিয়া মঙ্গোল সাম্রাজ্যের করদ রাজ্যে পরিণত হয়। গুয়ুজ খান আব্বাসীয় ও ইসমাইলিদের পূর্ণ আত্মসমর্পণ দাবি করেছিলেন।
তিনি সাম্রাজ্যব্যপী আদমশুমারির নির্দেশ দিয়েছিলেন। ১২৪৬ সালে তার ফরমান অনুসারে বিভিন্ন বস্তুর উপর ১/৩০-১/১০ অংশ কর আরোপ করা হয়। জর্জিয়া ও আর্মেনিয়ার পুরুষদের উপর মাথাপিছু ৬০ সিলভার ড্রাম কর ধার্য করা হয়।[৫] তার শাসনামলে উইঘুরদের এলাকা বৃদ্ধি পায়।
তিনি আমুকানকে কোরিয়ায় প্রেরণ করেন। ১২৪৭ সালে মঙ্গোলরা ইওম-জুর কাছে শিবির স্থাপন করে। রাজা গোজং তার রাজধানী কাংওয়া থেকে কাইসঙে স্থানান্তর করতে রাজি না হওয়ার পর আমুকানের বাহিনী ১২৫০ সাল পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপে অভিযান চালায়।
বাতু খান গুয়ুকের নেতা নির্বাচিত হওয়াকে সমর্থন না করলেও তাকে মেনে নিয়েছিলেন। ১২৪৭ সালে তিনি ভ্লাদিমিরের আন্দ্রেই এবং আলেক্সান্ডার নেভস্কিকে তাদের বাবার মৃত্যুর পর কারাকোরামে প্রেরণ করেন। গুয়ুক খান আন্দ্রেইওকে ভ্লাদিমির-সুজদাইয়ের এবং আলেক্সান্ডারকে কিয়েভের শাসক নিযুক্ত করেন।[৬] ১২৪৮ সালে গুয়ুক তার সাথে সাক্ষাতের জন্য বাতু খানকে মঙ্গোলিয়ায় আসার নির্দেশ দেন। অনেকের কাছে একে বাতুকে গ্রেপ্তারের পদক্ষেপ বলে মনে হয়েছিল। নির্দেশ পাওয়ার পর বাতু খান একটি বড় আকারের বাহিনী নিয়ে অগ্রসর হন। গুয়ুকও পশ্চিমে যাত্রা করেন।
পথিমধ্যে গুয়ুক বর্তমান শিনজিয়াঙে মারা যান। তাকে বিষপ্রয়োগ করে হত্যা করা হয়েছে এমন মত রয়েছে। তবে কিছু আধুনিক ইতিহাসবিদদের মতে তিনি স্বাস্থ্যগত কারণে স্বাভাবিকভাবে মারা যান।[৭] এরপর তার স্ত্রী ওগুল কাইমিশ রাজপ্রতিভূ হিসেবে ক্ষমতা নিলেও গুয়ুক খানের সন্তানরা ক্ষমতাসীন হননি। ১২৫১ সালে মংকে খান তার উত্তরসূরি হন।
পরবর্তী সময়
গুয়ুক খান মঙ্গোলদেরকে ইউরোপীয়দের বিরুদ্ধে নিয়োজিত করতে চেয়েছিলেন। তবে তার মৃত্যুর পর মঙ্গোলরা দক্ষিণ চীনের সাথে প্রতিদ্বন্দ্বিতায় লিপ্ত হয়। কুবলাই খানের সরকারি নথিতে গুয়ুক খানকে দিনজং (চীনা: 定宗) হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।