কায়িন রাজ্য (ফ্লোন: ဖၠုံ ခါန်ႋ ကၞ င့ ်; সগাও কারেন: က ညီ ကီၢ ် စဲၣ ်, বর্মী: ကရင်ပြည်နယ်) হলো মিয়ানমারের একটি রাজ্য। মিয়ানমারের সামরিক সরকার কারেন রাজ্যকে কায়িন রাজ্য নাম দিয়েছে। এর রাজধানী হপা-আন যা পা-আন হিসেবেও লেখা হয়।
উত্তর-উত্তরপশ্চিমে ও দক্ষিণ-দক্ষিণপূর্বে দাওনা পর্বতশ্রেণী এবং উত্তরপশ্চিমে কারেন পাহাড় থাকায় কায়িন রাজ্যটি পার্বত্য।[২] এর পূর্বে থাইল্যান্ডের মায় হং সন, তাক এবং কাঞ্চনবুড়ি প্রদেশ। এর পশ্চিম ও দক্ষিণে মন রাজ্য এবং বাগো অঞ্চল। উত্তরে মান্দালয় অঞ্চল, শান রাজ্য এবং কায়াহ রাজ্য।
বর্তমানে যা কারেন রাজ্য হিসেবে পরিচিত তা পূর্বে ১১ শতাব্দীর মাঝে গঠিত বাগান সাম্রাজ্যের বর্মী রাজ্যগুলোর অংশ ছিল। ১৩ থেকে ১৬ শতাব্দীর সময়কালে, অঞ্চলটির বেশিরভাগ অংশ হানতাওয়াদি রাজ্যের অন্তর্গত ছিল এবং এই অঞ্চলের উত্তরের অংশ আভা রাজ্যের একটি অন্তর্গত তাউঙ্গুরের অন্তর্ভুক্ত ছিল। অঞ্চলটি ১৬ থেকে ১৯ শতাব্দী পর্যন্ত তাউঙ্গু রাজবংশ এবং কোনবাউং রাজবংশের অংশে পরিণত হয়েছিল। প্রথম অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের (১৮২৪-১৮২৬) পর ব্রিটিশরা বর্তমান কারেন রাজ্যের দক্ষিণ তৃতীয়াংশ (সালউইন নদীর নিচে) এবং বাকি ১৮৫২-এর দ্বিতীয় অ্যাংলো-বার্মিজ যুদ্ধের পরে দখল করেছিল।
ব্রিটিশ উপনিবেশিক যুগের শেষের দিকে (১৯৪৫-১৯৪৮), কারেন নেতা আজকের কারেন রাজ্যসহ মন রাজ্য এবং তানিন্থারি অঞ্চলটির অনেকাংশ জুড়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের মধ্যেই একটি পৃথক রাষ্ট্র গঠনের উপর জোর দিয়েছিলেন। তারা ১৯৪৭ সালের ফেব্রুয়ারির প্যাংলং চুক্তিতে স্বাক্ষর করতে অস্বীকৃতি জানায় যা ছিল ১৯৪৭ সালের বার্মার সংবিধানের ভিত্তি। তারা ১৯৪৭ সালের এপ্রিলের স্বাধীনতা-পূর্ব নির্বাচন বর্জন করেছিল।[৪] তা সত্ত্বেও, সংবিধান কারেনদের একটি রাজ্য মঞ্জুর করেছিল, যদিও কারেন ব্রিটিশদের কাছ থেকে যা চেয়েছিল তার চেয়ে কম অঞ্চল দেওয়া হয়। সংবিধানে দশ বছরের সময়কালে রাজ্যগুলোকে ইউনিয়ন থেকে বের হওয়ার অধিকারের নিশ্চয়তা দেওয়া হয়েছে। (প্যাংলং চুক্তি কেবল শান এবং কাচিনকে রাজ্য দিয়েছে; চিনরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করলেও তারা কোন রাজ্য পায় নি।) কারেন ন্যাশনাল ইউনিয়ন (কেএনইউ) এতে সন্তুষ্ট ছিল না এবং সম্পূর্ণ স্বাধীনতা চেয়েছিল। ১৯৪৯ সালে, কেএনইউ একটি বিদ্রোহ উত্থাপন করেছিল যা আজ অবধি অব্যাহত আছে।[৫] কেএনইউ ইনসেইনের যুদ্ধে যাওয়ার উপলক্ষে ৩১ শে জানুয়ারিকে 'বিপ্লব দিবস' হিসাবে পালন করে।
রাজ্যটির বেশিরভাগ অংশ তখন থেকেই যুদ্ধক্ষেত্র। বেসামরিক লোকেরা যুদ্ধের কবলে পড়েছে। কেএনইউ বর্তমানে বিশ্বের দীর্ঘতম চলমান প্রতিরোধ গঠন করেছে। ১৯৮৯ সালে সামরিক সরকার কারেন রাজ্যের ইংরেজি নাম পরিবর্তন করে কায়িন রাজ্য রাখে।
১৯৭৬ সাল থেকে কেএনইউ একটি স্বাধীন কারেন রাজ্যের পরিবর্তে একটি যুক্তরাষ্ট্রীয় ব্যবস্থার জন্য আহ্বান জানিয়েছে। ২০১২ সালের জানুয়ারিতে মিয়ানমারের সামরিক সমর্থিত বেসামরিক সরকার পূর্ব কায়িন রাজ্যের রাজধানী হপা-আনে কেএনইউয়ের সাথে যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করেছে। রেলমন্ত্রী অং মিন এবং কেএনইউর জেনারেল মুতু সায় পো শান্তি আলোচনার নেতৃত্ব দিয়েছেন।[৬]
ভূগোল
কায়িন ১৫°৪৫' উত্তর এবং ১৯°২৫' উত্তর অক্ষাংশ এবং ৯৬°১০' পূর্ব এবং ৯৮°২৮' পূর্ব দ্রাঘিমাংশে অবস্থিত। এই অঞ্চলের পর্বতশ্রেণী এবং ক্রান্তীয় অঞ্চলে সমুদের কাছে এর অবস্থানের ফলে এখানের জলবায়ু উষ্ণ ও আর্দ্র। পূর্ব পার্বত্য অঞ্চলের সবচেয়ে উষ্ণ মাসের তাপমাত্রা কখনও ২২.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস (৭১.৯ ডিগ্রি ফারেনহাইট) এর নিচে নামে না। রাজ্যের পশ্চিম এবং দক্ষিণের নিম্নভূমিগুলো ক্রান্তীয় মৌসুমি জলবায়ুর অঞ্চলে অবস্থিত। এই অঞ্চলে সর্বনিম্ন বার্ষিক বৃষ্টিপাত ৩,০০০ মিলিমিটার (১২০ ইঞ্চি) এবং সর্বাধিক ৪,৮০০ মিলিমিটার (১৯০ ইঞ্চি)। অঞ্চলগুলো গ্রীষ্মে বেশিরভাগ বৃষ্টিপাত হয়। কারেন রাজ্যের কয়েকটি নদী এবং খাঁড়ি পাহাড়ের অবস্থানের কারণে দক্ষিণ থেকে উত্তরে প্রবাহিত হয়। রাজ্যের প্রধান নদীগুলো হলো থানলউইন (সালউইন নদী), থাওগিইন (ময়েই নদী), গাইং এবং আতারান।
সরকার
শাসন বিভাগ
আইন বিভাগ
বিচার বিভাগ
প্রশাসনিক বিভাগসমূহ
কারেন রাজ্য একটি শহর ও নয়টি মফস্বল নিয়ে গঠিত। এখানে ৪টি জেলা, ৭টি শহরাঞ্চল ও ৪,০৯২টি গ্রাম আছে।
জেলা
হপা-আন জেলা
মায়াওয়াদি জেলা
কাওকারিক জেলা
হপাপুন জেলা
শহরাঞ্চল
হপা-আন শহরাঞ্চল
হ্লেইংবুওয়ে শহরাঞ্চল
হপাপুন শহরাঞ্চল
থানডাংগিই শহরাঞ্চল
মায়াওয়াদি শহরাঞ্চল
কাওকারিক শহরাঞ্চল
কিয়েনসাইকগি শহরাঞ্চল
পাইং কিওন শহরাঞ্চল
শহর ও মফস্বল
হপা-আন
হ্লেইংবুওয়ে
হপাপুন
থানডাং
থানডাঙ্গই
মায়াওয়াদি
কাওকারেক
কিয়েনসাইকগি
পাইথনসু
কিয়াইকডন
কিওনডো
সুকালি
ওয়াইলে
কামামাউং
পাইংকিওন
শানিইওয়াথিত
বাওগালি
গ্রাম
তাগোনডাইং
কালে
হতিমাহতো
নান-থাইং-তুম
কিওঙ্গাওয়ান
উইনপাউক
তাউংডি
মায়োহং
আনানকুইন
ফাবইয়া
কারেসো
কিয়াকবিলু
পু লেইন
কিয়েকিওয়া
খনখান
আপলন
কান্নি
হতিপালামাউ
হলাগাজাইং
কাওয়ানকাথাউং
উইনহটাং
লুতশান
পায়া-নগোক্টো
কাতোক্রা
কাইংডাও
কারেন রাজ্যের পার্বত্য অঞ্চলের কারণে, বেশিরভাগ গ্রাম ছোট এবং একেকটিতে ৪০টিরও কম পরিবার রয়েছে। তাই কারেনের বিশাল জনসংখ্যা কয়েকশ গ্রাম, এমনকি কয়েক হাজার গ্রামাঞ্চল জুড়ে বিস্তৃত।[৭]
জনসংখ্যা ও ধর্ম
জনসংখ্যা
১৯৭৩ সালের আদমশুমারির পর থেকে কারেন রাজ্যের জনসংখ্যা ৮,৫৮,৪২৯ জন থেকে বেড়ে ১৯৮৩ সালে ১,০৫৫,৩৫৯ জন হয় এবং ২০১৪ সালের আদমশুমারিতে তা ১,৫৭৪,০৭৯ জন হয়। অর্থাৎ ১৯৮৩ এবং ২০১৪ সালের আদমশুমারির মধ্যে কারেন রাজ্যের জনসংখ্যা প্রায় ৪৯ শতাংশ বেড়েছে। দেশের অন্যান্য রাজ্য ও অঞ্চলগুলোর সাথে তুলনামূলকভাবে কারেন রাজ্যের জনসংখ্যা একাদশতম স্থানে রয়েছে যা কেবল তানিন্থায়ি অঞ্চল, নায় পাই তাও ইউনিয়ন অঞ্চল এবং চিন রাজ্যের জনসংখ্যার চেয়ে বেশি। মোট জনসংখ্যার অনুপাতের দিক দিয়ে, কারেন রাজ্যের জনসংখ্যা ১৯৮৩ সালে ৩ শতাংশ থেকে ২০১৪ সালে ৩.১ শতাংশে উন্নীত হয়েছে।[৮]
কারেন রাজ্যের অন্যতম প্রধান অর্থনীতি পর্যটন। ২০১২ সালে কেএনইউ এবং মিয়ানমার সরকারের মধ্যে প্রাথমিক যুদ্ধবিরতি চুক্তি সাক্ষরের পরে, কারেন রাজ্যে দর্শনার্থীর সংখ্যা অনেক বেড়েছে।[৯] কারেন রাজ্যে ২০১৩ সালে ৪০,০০০ জন এরও বেশি পর্যটক এসেছে এবং এরপরে ২০১৪ সালে ৫০,০০০ জন এসেছে। ২০১৬ সালে পর্যটকের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১,৫০,০০০ জন।[৯]
সীমান্ত ব্যবসা
মিয়ানমারের ১৫ টি সীমান্ত বাণিজ্যিক এলাকার মধ্যে কারেন রাজ্যের মায়াওয়াডি সীমান্ত বাণিজ্য এলাকা দ্বিতীয় বৃহত্তম।[১০] এটি থাইল্যান্ড এবং মিয়ানমারের মধ্যে প্রধান সীমান্ত বাণিজ্যিক পথ। থাইল্যান্ডের চেম্বার অফ কমার্স অনুসারে, ২০১৫ সালে মাও সট থেকে মায়াওডির মাধ্যমে দুই দেশের মধ্যে মাসিক বাণিজ্যের মূল্য ছিল প্রায় ৩ বিলিয়ন থাই বাত (প্রায় ৯০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার)।[১১]
কৃষি
কারেন রাজ্য একটি কৃষিপ্রধান রাজ্য। বর্তমানে, কারেন রাজ্যে ৪,৬০,০০ একরের বেশি ধানের ক্ষেত এবং ২,৬০,০০০ একর রাবার গাছের আবাদ রয়েছে।[১২] থানডাং এলাকায় ৯০০০ একরও বেশি কফির জমি রয়েছে। কায়িন রাজ্য সরকার কৃষিক্ষেত্রের উন্নতির জন্য নতুন কৃষিকাজ প্রযুক্তি ব্যবহারের চেষ্টা করছে।[১২]
শিল্প
২০১৬ সালে, সরকার দেশি-বিদেশী বিনিয়োগকারীদের হপা-আন শিল্প অঞ্চলে আকৃষ্ট করার কৌশল ঘোষণা করেছিল।[১৩] তবে বিদ্যুৎ সরবরাহের ঘাটতি হপা-আন শিল্প অঞ্চলের উন্নয়নে বাধা সৃষ্টি করে। কায়িন রাজ্য সরকার একটি জাপানি সংস্থার সাথে একযোগে বিদ্যুতের প্রয়োজন মেটাতে ১৮০০ মেগাওয়াট কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের জন্য সমীক্ষা চালানোর চেষ্টা করছে। অন্যদিকে, সম্প্রদায়ের সদস্য এবং স্থানীয় পরিবেশ দলগুলো কয়লার নির্গমনের প্রভাব নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে।[১৪]
পরিবহন
কারেন রাজ্যে হপাপুন বিমানবন্দর ও হপা-আন বিমানবন্দর থাকলেও বর্তমানে এগুলো গণপরিবহনের জন্য ব্যবহৃত হয় না।
২০১৫ সালে, এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক (এডিবি) কায়িন রাজ্যের আইন্দু এবং কাওকারেক শহরগুলোকে সংযোগকারী একটি ৬৬.৪ কিলোমিটার রাস্তার উন্নয়নের জন্য ১০০ মিলিয়ন ডলার ঋণ অনুমোদন করেছে।[১৫]
হপা-আনে সালউইন নদী। পেছনের পাহাড়টি হলো জয়েগাবিন পর্বত।
শিক্ষা
কায়িন রাজ্যের প্রধান বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হলো:
হপা-আন বিশ্ববিদ্যালয়
কম্পিউটার বিশ্ববিদ্যালয়, হপা-আন
প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, হপা-আন
মিয়ানমারে শিক্ষাগত সুযোগ ইয়াংগুন এবং মান্দালয় শহরের বাইরে সীমাবদ্ধ। এটি বিশেষ করে কারেন রাজ্যের একটি সমস্যা যেখানে বছরেরও বেশি সময় ধরে সরকার এবং বিদ্রোহীদের মধ্যে লড়াইয়ের ফলে হাজার হাজার শরণার্থী এবং অভ্যন্তরীণভাবে উচ্ছেদকৃত মানুষ রয়েছে। পরিসংখ্যান অনুসারে, কারেন রাজ্যে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ১০% এরও কম শিক্ষার্থী উচ্চ বিদ্যালয়ে উত্তীর্ণ হয়।[১৬] উচ্চশিক্ষার সকল প্রতিষ্ঠান হপা-আন শহরে অবস্থিত।
২০০২-২০০৩ শিক্ষাবর্ষ
প্রাথমিক
মাধ্যমিক
উচ্চ
বিদ্যালয়
১১৩৯
৭৮
৩১
শিক্ষক
৩৪০০
১২০০
৪০০
শিক্ষার্থী
১,৪৮,০০০
৪৭,০০০
১২,০০০
স্বাস্থ্যসেবা
মিয়ানমারে স্বাস্থ্যসেবার সাধারণ অবস্থা খুব খারাপ। যদিও স্বাস্থ্যসেবা নামেমাত্র বিনামূল্য, বাস্তবে, রোগীদের ঔষধ এবং চিকিত্সার জন্য এমনকি সরকারি ক্লিনিক এবং হাসপাতালগুলোতে খরচ করতে হয়। সরকারি হাসপাতালে কিছু প্রাথমিক সুবিধা ও সরঞ্জামের অভাব রয়েছে।
সাধারণত, ইয়াঙ্গুন এবং মান্দালয়ের বাইরে স্বাস্থ্যসেবা অবকাঠামোগুলো দুর্বল তবে কারেন রাজ্যের মতো সংঘাতময় অঞ্চলে বিশেষত খারাপ। রাজ্যে জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব খারাপ। নিচে রাজ্যের জনস্বাস্থ্য ব্যবস্থার সংক্ষিপ্তসার রইল:[১৭]
↑https://wikileaks.org/plusd/cables/06RANGOON698_a.html NORTH KAREN STATE - WHERE DO YOU RUN? "The mountainous terrain in northern Karen State cannot support large villages, so most villages have no more than 40 households."
↑The 2014 Myanmar Population and Housing Census: Kayin State। Nay Pyi Taw: Ministry of Immigration and Population। ২০১৫। পৃষ্ঠা 11।