কাঞ্জি (漢字) জাপানি ভাষার৩টি ব্যবহারিত লিপি বা ছবি-অক্ষর লিপি, হিরাগানা এবং কাতাকানার সঙ্গে এক সাথে ব্যবহৃত হয়। কাঞ্জি ছবি-অক্ষর লিপি জাপানি ভাষাতে হচ্ছে গৃহীত চীনা ছবি-অক্ষর লিপি। বর্তমানে জাপানি ভাষায় প্রায় দুই হাজারের মতো সরকার-অনুমোদিত কাঞ্জি ছবি-অক্ষর আছে, যেগুলি গণমাধ্যমগুলিতে ব্যবহৃত হয়। তবে এগুলির বাইরেও আরও বেশ কিছু কাঞ্জি প্রচলিত।
ইতিহাস
আদিতে জাপানি ভাষার কোনও লিখন পদ্ধতি ছিল না। ৫ম শতাব্দীতে চীনা ভাষা থেকে চিত্রভিত্তিক কাঞ্জি বর্ণগুলি গৃহীত (ধার) করা হয়। চীনার ছবি-অক্ষর লিপি ইতিহাস অনেক পুরনো। এগুলি ৩০০০ থেকে ৫০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে প্রচলিত। এগুলি প্রথমে চীনা ভাষা লিখতে ব্যবহৃত হত। পরবর্তীতে এগুলি পার্শ্ববর্তী জাপান, কোরিয়া ও ভিয়েতনামে ছড়িয়ে পড়ে। এই লিপি চীনেহান্যি, জাপানেকাঞ্জি, কোরিয়ায়হাঞ্জা এবং ভিয়েতনামেচ্যুনম্ নামে পরিচিত। ৫ম শতকে এসে জাপানে প্রায় সর্বত্র কাঞ্জি লিপি ব্যবহৃত হতে থাকে, যদিও তার আগেও এই লিপির ব্যবহারের নিদর্শন পাওয়া গেছে। এই আদি পর্যায়ে যারা কাঞ্জিতে লিখত, তারা ছিল মূলত চীন ও কোরিয়া থেকে আগত অভিবাসী। এরা জাপানি রাজদরবারে অনুলেখকের কাজ করত। কিছু কিছু অভিজাত জাপানি এই অনুলেখকদের কাছ থেকে লিখতে ও পড়তে শিখে নেন। তবে ৬ষ্ঠ শতকের মধ্যভাগে যখন চীন থেকে জাপানে বৌদ্ধধর্মের প্রসার ঘটে, তখনই সাধারণ জাপানি জনগণ কাঞ্জি পড়তে ও লিখতে বেশি আগ্রহী হয়ে ওঠে।
কাঞ্জির প্রচলনের কয়েক শতবছর পরে জাপানিরা তাদের নিজস্ব সাহিত্য রচনা শুরু করে। এগুলির মধ্যে ছিল ৭১২ সালের ইতিহাসগ্রন্থ "পূর্বকালিক বিষয়ের নথিপত্র" (古事記 কোজিকি), ৭২০ সালের ইতিহাসগ্রন্থ "জাপানের ইতিকথা" (日本書紀 নিহোন্ শোকি), ৭৫৯ সালের কাব্যগ্রন্থ "দশ হাজার পত্র" (万葉集 মান্-ইয়ৌ-শুউ), ইত্যাদি। এই গ্রন্থগুলি সম্পূর্ণ কাঞ্জিতে লেখা, তখনও কানা লিপির উদ্ভব হয় নি। জাপানে যখন কাঞ্জি ব্যবহার করা শুরু হয়, তখন প্রতিটি কাঞ্জি বর্ণের জন্য এর চীনা উচ্চারণও ধার করা হয়। এই কারণে সমসাময়িক কাঞ্জি দুইভাবে পাঠ করা সম্ভব। এগুলিকে বলে ওন্-পাঠ (音 ওন্) এবং কুন্-পাঠ (訓 কুন্)। ওন্-পাঠে জাপানি ধ্বনিব্যবস্থার মধ্যে থেকে আদি চীনা উচ্চারণের সাথে যথাসম্ভব সাদৃশ্য রক্ষার চেষ্টা করা হয়। অন্যদিকে, কুন্-পাঠে কাঞ্জিগুলি জাপানি নিজস্ব রীতিতে উচ্চারণ করা হয়। ওন্-পাঠগুলি আবার তিন রকম হতে পারে। কাঞ্জিগুলি চীন থেকে জাপানে চীনের ইতিহাসের বিভিন্ন পর্বে আমদানি হয়, এবং এগুলির ওন্-পাঠ তাই তিন রকম। এগুলি হল গো-ওন্ (呉音 গো ওন্), কান্-ওন্ (漢音 কান্ ওন্), এবং তৌ/সৌ-ওন্ (唐/宋音 তৌ/সৌ-ওন্)।
কাঞ্জির গো-ওন্ পাঠপদ্ধতি সবচেয়ে প্রাচীন। চীন ও কোরিয়া থেকে যে প্রথম প্রজন্মের অধিবাসীরা জাপানে অভিবাসী হয়েছিল, তারা এই গো (চীনা ভাষাতেউ) উচ্চারণে কথা বলত। তারা মূলত দক্ষিণ চীনের নিম্ন ইয়াংসে নদীর অববাহিকা থেকে এসেছিল। চীনের ইতিহাসের ছয় রাজবংশ পর্বে, ২২২-৫৮৯ খ্রিষ্টাব্দ সময়কালে, এই উচ্চারণ প্রচলিত ছিল। এরপর ৭ম থেকে ৯ম শতক পর্যন্ত জাপানি সন্ন্যাসী ও পণ্ডিতেরা চীন সফরে যান এবং সেখান থেকে কাঞ্জি লিপিগুলির কান্-ওন্ পাঠপদ্ধতি জাপানে নিয়ে আসেন। তারা যখন চীনে গিয়েছিলেন, তখন চীনে চলছিল থাং রাজবংশের রাজত্ব (৬১৮-৯০৭ খ্রিষ্টাব্দ)। তাং রাজবংশের রাজধানী চাংগানে যে উচ্চারণে কথা বলা হত, সেগুলিই জাপানি কাঞ্জি লিপির কান্-ওন্ পাঠপদ্ধতির ভিত্তি। কান্-ওন্ প্রচলনের প্রায় সাথে সাথেই জাপানি রাজদরবার এগুলিকে জাপানে কাঞ্জির সরকারি উচ্চারণ পদ্ধতি হিসেবে ঘোষণা দেয়। এর বহু পরে ১৪শ শতকে তৌ/সৌ-ওন্ পাঠপদ্ধতির প্রচলন ঘটে, এই উচ্চারণগুলি মূলত সাংহাইয়ের আশেপাশের এলাকায় প্রচলিত ছিল। তবে জাপানি কাঞ্জি লিপিতে তৌ/সৌ-ওন্ পাঠপদ্ধতির ব্যবহার খুব অল্প কিছু শব্দে (বিশেষত জেন পরিভাষাগুলিতে) সীমাবদ্ধ।
এই ঐতিহাসিক কারণগুলির জন্য জাপানি ভাষার প্রতিটি কাঞ্জি অক্ষর একাধিক ওন্ পাঠপদ্ধতিতে উচ্চারণ করা সম্ভব। জাপানে এই কাঞ্জি লিপিগুলিই ছিল লিখিত ভাবপ্রকাশের প্রধান বাহন, কেননা এগুলি জাপানি সভ্যতা থেকে সে সময়ে অনেক উন্নত চীনা সভ্যতা থেকে আমদানি করা হয়েছিল। চীনা লিপিভিত্তিক এই কাঞ্জিগুলিকে জাপানে তাই বলা হত 真名 মানা, অর্থাৎ আসল লিপি। কাঞ্জিগুলির পাশাপাশি হেই পর্বে (৭৯৪-১১৮৫) জাপানে দুইটি শব্দলিপিভিত্তিক বর্ণমালার আবির্ভাব ঘটে। এই বর্ণমালাগুলিকে অপ্রধান লিখন পদ্ধতি হিসেবে গণ্য করা হত, তাই এদের নাম দেওয়া হয় (仮名, かな, カナ) কানা, অর্থাৎ অস্থায়ী লিপি। কাঞ্জি ও কানা লিপির এই মর্যাদাভিত্তিক পার্থক্য আজও বজায় আছে।
Kaiser, Stephen (1991). Introduction to the Japanese Writing System. In Kodansha's Compact Kanji Guide. Tokyo: Kondansha International. আইএসবিএন৪-৭৭০০-১৫৫৩-৪.
Miyake, Marc Hideo (2003). Old Japanese: A Phonetic Reconstruction. New York, London: RoutledgeCurzon.