কলিকাতা গ্রাম বা ডিহি কলিকাতা ছিল বাংলার একটি অধুনালুপ্ত জনপদ। সপ্তদশ শতাব্দীর শেষ ভাগে পরস্পর-সংলগ্ন কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুর গ্রাম তিনটিকে কেন্দ্র করে কলকাতা মহানগরীর উত্থান ঘটে। ব্রিটিশ ঐতিহাসিকেরা ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির প্রশাসক জব চার্নককে এই শহরের প্রতিষ্ঠাতার মর্যাদা দিয়েছিলেন। জব চার্নক সুতানুটি গ্রামে বসতি স্থাপন করেন।
সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের তুলনায় কলিকাতা গ্রামটি ছিল কম গুরুত্বসম্পন্ন। তবে স্থানপ্রাচুর্যের কারণে এই অঞ্চলে ব্রিটিশদের বসতি স্থাপনে বিশেষ সুবিধা হয়।[১] টমাস বাওরের ১৬৮৭ সালের মানচিত্র এবং জর্জ হেরনের ১৬৯০ সালের মানচিত্রে সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের উল্লেখ থাকলেও, এই দুই অঞ্চলের মধ্যবর্তী কলিকাতা গ্রামের কোনো উল্লেখ ছিল না।[২] যদিও ১৫৯০ সালে আবুল ফজল তাঁর আইন-ই-আকবরি গ্রন্থে ‘কলকাতা’ নামে একটি স্থানের উল্লেখ করেন।[১]
ইতিহাস
১৬৯০ সালের ২৪ অগস্ট ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বাংলা সদর কার্যালয় প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে জব চার্নক নামে এক ইংরেজ বণিক সুতানুটিতে উপস্থিত হন। কলিকাতা গ্রামে স্থানীয় লোকেদের বসতি না থাকায়, এই গ্রামটি ইংরেজরা সহজেই দখল করে নিতে পারে। ১৬৯৬ সালে কোনোরূপ আইনি অধিকার ব্যতিরেকেই বর্তমান জিপিও অঞ্চলে ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গের নির্মাণকাজ শুরু হয়। ১৬৯৮ সালের ১০ নভেম্বর জব চার্নকের জামাতা ও উত্তরাধিকারী চার্লস আয়ার এই অঞ্চলের পূর্বতন জমিদার সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবারের কাছ থেকে কলিকাতা ও তৎসংলগ্ন তিনটি গ্রামের জমিদারি ক্রয় করলে এই অঞ্চলের উপর কোম্পানির আইনি অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়।[২] এই দিন থেকেই কলকাতায় ব্রিটিশ শাসনের সূত্রপাত ঘটে। উল্লেখ্য, আওরঙ্গজেবের অধীনে মুঘল সাম্রাজ্য তখনও শক্তিশালী ছিল।
সাবর্ণ রায়চৌধুরী পরিবার কবে কলিকাতা গ্রামের জমিদারি লাভ করেন, তা সঠিক জানা যায় না। শোনা যায়, ১৬০৮ সালে মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গিরের জ্ঞাতিভাই রাজা মানসিংহের কাছ থেকে এক বিশাল ভূসম্পত্তি লাভ করেছিলেন। তবে অন্য মতে, এই বংশের প্রতিষ্ঠাতা কেবলমাত্র রাজা মানসিংহের প্রশংসাই অর্জন করেছিলেন, কোনো সম্পত্তি লাভ করেননি।[৩] এই কারণে ঠিক কতদিন সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা কলিকাতা, সুতানুটি ও গোবিন্দপুরের জমিদারি সত্ত্ব ভোগ করেন, তা জানা যায় না। তবে ১৬৯৮ সালের পূর্বাবধি তাঁরাই এই অঞ্চলের জমিদার ছিলেন এবং মুঘল সম্রাটের কাছ থেকে কিছু সুযোগসুবিধাও পেতেন। তাঁরা স্বেচ্ছায় এই অঞ্চলের জমিদারি হস্তান্তর করেন, করেছিলেন মুঘল রাজদরবারের চাপে।[৪]
কর্নেল মার্ক উডের ১৭৮৪ সালের মানচিত্রে (১৭৯২ সালে উইলিয়াম বেইলি কর্তৃক প্রকাশিত) জোড়াবাগান ঘাট থেকে বাবুঘাট পর্যন্ত অঞ্চলটিকে ডিহি কলিকাতা নামে চিহ্নিত করা হয়েছে।[৫]
ব্রিটিশরা কলিকাতাকে ‘ক্যালকাটা’ নামে অভিহিত করত। সেই থেকেই এই মহানগর ‘কলিকাতা’ বা ‘ক্যালকাটা’ নাম ধারণ করে।
“The pivot of the settlement must be sought in what is now Dalhousie Square, but was then known as the Lall Bagh or Park. In the centre was the Lall Dighi, or great Tank, which has been in existence before the coming of Charnock within what was the cutcherry (court-house) of the former zemindars (landlords)… There was no Strand Road, and the waves of the Hooghly lapped the ramparts of the Fort. To the south there extended from Koila Ghat to Chandpal Ghat the mouth of a creek, navigable for large boats, which passed along Hastings Street and made way through Creek Row and Wellington Square to Beliaghata near the Salt Lakes… Beyond Chitpore Road, which formed the eastern boundary of the settlement, lay more pools, swamps and rice-fields, dotted here and there with the struggling huts of fishermen, falconers, wood-cutters, weavers and cultivators.”[৬]
সংক্ষেপে এই ছিল অষ্টাদশ শতাব্দীর প্রথম ভাগের কলিকাতা। ধীরে ধীরে ব্রিটিশরা সুতানুটি ত্যাগ করে কলিকাতাতেই বসতি স্থাপন করতে শুরু করেন।[৭]
পুরনো দুর্গের উত্তরভাগের অঞ্চলটিকে বলা হত ‘হোয়াইট টাউন’। ইংরেজরা এই হোয়াইট টাউনের সীমার মধ্যেই বসবাস করত। সুতানুটি, চিৎপুর ও গোবিন্দপুরের স্থানীয় অধিবাসী-অধ্যুষিত অঞ্চলগুলিকে বলা হত ‘ব্ল্যাক টাউন’। ব্ল্যাক টাউন ও হোয়াইট টাউনের মধ্যে একটা সুস্পষ্ট বিভেদরেখাও বিদ্যমান ছিল।[৮]
কলিকাতার যুদ্ধ
১৭৫৬ সালে কলকাতায় দুর্গনির্মাণে বিরক্ত হয়ে নবাবসিরাজদ্দৌল্লা কলিকাতা আক্রমণ করেন। কলিকাতা অধিকারের পর সিরাজ এই শহরের নাম পরিবর্তন করে তাঁর দাদামশায় আলিবর্দি খানের নামানুসারে ‘আলিনগর’ রাখেন। ১৭৫৮ সালে ইংরেজরা কলকাতা পুনরুদ্ধার করলে পুর্বতন নামটিই আবার বহাল হয়। তবে সিরাজের কলকাতা দখল ছিল ইংরেজদের নিকট এক দুঃস্বপ্নের সময়। এই যুদ্ধে গোবিন্দপুর, সুতানুটি, কলিকাতা ও চিৎপুরের মধ্যে কেবলমাত্র ‘হোয়াইট টাউন’ নামে পরিচিত কলিকাতাই সর্বাধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ‘ব্ল্যাক টাউন’ খুব একটা ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি। কেবল বড়োবাজারে অগ্নিসংযোগ করা হয়েছিল এবং ইংরেজরা গোবিন্দপুর গ্রামটি জ্বালিয়ে দিয়েছিল। হুগলি নদীর ৪০ কিলোমিটার ভাটিতে ফলতা নামক এক গ্রামে ইংরেজরা পালিয়ে যায়। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর যুদ্ধে সিরাজদ্দৌল্লার পরাজয় ঘটলে বাংলায় ব্রিটিশ প্রাধান্য সুপ্রতিষ্ঠিত হয় এবং কলিকাতা এক বিশেষ মর্যাদা লাভ করে।[৯]
কলকাতা পুনর্দখলের পর ব্রিটিশরা ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ পুনরায় নির্মাণ করেন। গোবিন্দপুর গ্রামটি ধ্বংস করে ফেলা হয়। এই গ্রামের অধিবাসীরা উত্তরের গ্রামগুলিতে আশ্রয় নেন। বর্তমানে এই অঞ্চলটিই ময়দান নামে পরিচিত।[১০]
ময়দানের উত্তরে এসপ্ল্যানেডের দক্ষিণে শহরের সর্বাপেক্ষা গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ভবন ও বেশ কিছু বিলাসবহুল ব্যক্তিগত বাড়ি গড়ে ওঠে। মিসেস ফে লিখেছেন, “এসপ্ল্যানেডকে মনে হয় প্রাসাদে নির্মিত।” শহরের শ্বেতাঙ্গ জনসমাজ এরপর চৌরঙ্গীর দিকে সরে আসে। চৌরঙ্গী সেই সময় ছিল একটি ছোটো গ্রাম। বৈঠকখানা, ধর্মতলা, জানবাজারে দেশীয়রা এবং পর্তুগিজ, আর্মেনিয়ান প্রভৃতিরা এসে বসবাস শুরু করেন। এই অঞ্চলটি হোয়াইট ও ব্ল্যাক টাউনের মধ্যে সংযোগস্থল হয়ে ওঠে।[৮]
পাদটীকা
↑ কখCotton, H.E.A., Calcutta Old and New, 1909/1980, p. 1, General Printers and Publishers Pvt. Ltd.
↑Debashish Bandopadhyay alleges that the British paid a bribe to the Mughal Darbar or court to obtain the legal rights to the land. This was however not an uncommon practice in the Mughal empire, nor in today's India. Bandopadhyay Debashis, Purano Kolkatar gharbari, (বাংলা), pp. 1-2, second impression, 2002, Ananda Publishers Private Limited, আইএসবিএন৮১-৭৭৫৬-১৫৮-৮
↑ কখLahiri Choudhury, Dhriti Kanta,Trends in Calcutta Architecture, in Calcutta, the Living City, Vol I, pp. 156-160, edited by Sukanta Chaudhuri, Oxford University Press, আইএসবিএন০-১৯-৫৬৩৬৯৬-১.
↑Sinha, Pradip, Siraj’s Calcutta, in Calcutta, the Living City, Vol I, pp. 8-9, edited by Sukanta Chaudhuri, Oxford University Press, আইএসবিএন০-১৯-৫৬৩৬৯৬-১