কঠিন-অবস্থা রসায়ন, (কখনও কখনও পদার্থ রসায়ন ও বলা হয়) বলতে কঠিন পদার্থের উপকরণের সংশ্লেষণ, কাঠামো এবং বৈশিষ্ট্যের অধ্যয়নকে বোঝায়। তবে এটি কেবলমাত্র অ-আণবিক কঠিন পদার্থের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। সুতরাং, নতুন ধরনের উপাদানের সংশ্লেষণ এবং বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কঠিন-অবস্থা রসায়নের সাথে কঠিন অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান, খনিজবিজ্ঞান, কেলাসবিদ্যা, সিরামিক, ধাতুবিদ্যা, তাপগতিবিজ্ঞান, বস্তু বিজ্ঞান এবং তড়িৎ বিদ্যার অনেক বিষয়ের মিল রয়েছে। সংশ্লেষক কণার বিন্যাস প্রকৃতির ভিত্তিতে কঠিন পদার্থকে কেলাসিত ও অকেলাসিত এই দুই ভাগে ভাগ করা যেতে পারে।
ইতিহাস
বাণিজ্যিক পণ্যের সাথে সরাসরি সম্পর্কের কারণে, অজৈব কঠিন পদার্থের রসায়ন প্রযুক্তি দ্বারা দৃঢ়ভাবে চালিত হয়েছে। এই ক্ষেত্রের অগ্রগতি প্রায়শই শিল্পের চাহিদা এবং কখনও কখনও প্রাতিষ্ঠানিক গবেষণার সহযোগিতায় দ্বারা প্রসার লাভ করেছে। [১] বিংশ শতকের আবিষ্কৃত অবদানগুলোর মধ্যে ১৯৫০-এর দশকে পেট্রোলিয়াম প্রক্রিয়াকরণের জন্য জিওলাইট এবং প্ল্যাটিনাম- ভিত্তিক অনুঘটক, ১৯৬০-এর দশকে মাইক্রোইলেকট্রনিক যন্ত্রের মূল উপাদান হিসাবে অতি বিশুদ্ধ সিলিকন এবং ১৯৮০-এর দশকে "উচ্চ তাপমাত্রায় অতিপরিবাহিতা" অন্তর্ভুক্ত। ১৯০০-এর দশকের প্রথম দিকে উইলিয়াম লরেন্স ব্র্যাগের এক্স-রে স্ফটিকবিদ্যার আবিষ্কার একটি উন্মোচনকারী আবিষ্কার ছিল। কঠিন অবস্থার পারমাণবিক স্তরে বিভিন্ন বিক্রিয়ার পরিচালিত হয় তা কার্ল ওয়াগনারের জারণ হার তত্ত্ব, আয়নের বিপরীত ব্যাপন এবং ত্রুটি রসায়ন সম্পর্কিত কাজের দ্বারা উল্লেখযোগ্য উন্নতি লাভ করে। তার অবদানের কারণে, তাকে কখনও কখনও কঠিন-অবস্থা রসায়নের জনক[২] হিসাবে উল্লেখ করা হয়।
সংশ্লেষণ পদ্ধতি
কঠিন অবস্থার যৌগের বৈচিত্র্যের মত, তাদের প্রস্তুতির জন্যও একই রকম বিচিত্র পদ্ধতির [৩] ব্যবহার করা হয়।
কেমি ডাউস
জৈব পদার্থ যেমন, আধান পরিবাহী লবণের জন্য, এই পদ্ধতিগুলো কক্ষ তাপমাত্রায় আশেপাশে প্রয়গ করা হয় এবং প্রায়শই এগুলো জৈব সংশ্লেষণ পদ্ধতির অনুরূপ হয়। কখনো কখনো তড়িৎস্ফটিকীকরণের ফলে জারণ-বিজারণ বিক্রিয়া ঘটে, যা বেকগার্ড লবণ থেকে টেট্রাথায়াফালভ্যালিন প্রস্তুত প্রণালী থেকে প্রতীয়মান হয়।
চুল্লী পদ্ধতি
তাপীয় সহনশীল উপাদানের জন্য, প্রায়ই উচ্চ তাপমাত্রা পদ্ধতি প্রয়োগ করা হয়। উদাহরণস্বরূপ, ভারী কঠিন পদার্থ প্রস্তুত করতে টিউব চুল্লী ব্যবহার করা হয়, যাতে ১১০০° সেলসিয়াস পর্যন্ত তাপমাত্রায় বিক্রিয়া ঘটানো যায়।[৪] বিশেষ যন্ত্রপাতি যেমন, ট্যান্টালাম টিউব দ্বারা গঠিত এক প্রকার চুল্লী যার মধ্য দিয়ে বৈদ্যুতিক বিদ্যুৎ প্রবাহিত হয়, তা ২০০০° সেলসিয়াস পর্যন্ত উচ্চতর তাপমাত্রার জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে। এই ধরনের উচ্চ তাপমাত্রা অনেক সময় বিক্রিয়কের ব্যাপন ঘটাতে প্রয়োজন হয়।
গলন পদ্ধতি
একটি বহুল প্রচলিত পদ্ধতি বিক্রিয়কসমুহকে একত্রে গলানোর পর প্রাপ্ত কঠিনীভূত দ্রব্যকে শীতল করা। উদ্বায়ী বিক্রিয়কের ক্ষেত্রে বিক্রিয়কগুলকে প্রথমে একটি এম্পুলের মধ্যে নেয়া হয়। তারপর এম্পুলগুলোকে শীতল করে (যেমন, তরল নাইট্রোজেনের মধ্যে ডুবিয়ে রেখে) বন্ধ করে দেয়া হয়। এরপর বদ্ধ এম্পুলগুলোকে চুল্লিতে রেখে নির্দিষ্ট মাত্রায় হিট ট্রিটমেন্ট করা হয়।
দ্রবণ পদ্ধতি
অধঃক্ষেপ কিংবা বাষ্পীভবন দ্বারা দ্রবণ থেকে কঠিন পদার্থ প্রস্তুত করা যায়। কখনও কখনও দ্রাবককে হাইড্রোথার্মাল বা চাপের মধ্যে স্ফুটনাংকের চেয়ে বেশি তাপমাত্রায় রাখা হয়। এই পদ্ধতির আরেকটি বৈচিত্র্য হল ফ্লাক্স পদ্ধতির ব্যবহার, যেখানে অপেক্ষাকৃত নিম্ন গলনাঙ্কের লবণকে উচ্চ তাপমাত্রার দ্রাবক হিসাবে ব্যবহার করা হয় যার মধ্যে কাঙ্ক্ষিত বিক্রিয়া ঘটানো যেতে পারে। এই পদ্ধতি খুবই কার্যকরী হতে পারে।
গ্যাসীয় বিক্রিয়া
অনেক কঠিন পদার্থ সক্রিয় গ্যাসের সাথে তীব্রভাবে বিক্রিয়া করে যেমন, ক্লোরিন, আয়োডিন, অক্সিজেন ইত্যাদি। অন্যান্য কিছু ধাতু গ্যাসের সাথে সংযোজন ঘটায় যেমন কার্বন মনোক্সাইড বা ইথিলিন। এই ধরনের বিক্রিয়া প্রায়ই উভয় দিক খোলা একটি নলে ঘটানো হয়, যার মধ্য দিয়ে গ্যাস প্রবাহিত হয়। এর একটি বৈচিত্র্য হল থার্মোগ্র্যাভিটি পরিমাপক (টিএজিএ) যন্ত্রের ভিতরে বিক্রিয়া ঘটানো। এসব ক্ষেত্রে বিক্রিয়ার সময় স্টকিওমেট্রিক তথ্য পাওয়া যেতে পারে, যা উপাদান শনাক্তকরণে সাহায্য করে।
গ্যাসীয় বিক্রিয়ার একটি বিশেষ অবস্থা হল একটি রাসায়নিক পরিবহন বিক্রিয়া। এটি প্রায়ই একটি আবদ্ধ এম্পুল এর মধ্যে পরিবহন সংঘটকের (যেমন আয়োডিন) উপস্থিতিতে ঘটানো হয়। তারপর এম্পুলটিকে একটি জোন চুল্লীতে স্থাপন করা হয়। এতে অবশ্যই দুটি টিউব চুল্লী একত্রে যুক্ত করা থাকে, যার ফলে একটি তাপমাত্রার নতি প্রয়োগ করা যায়। এই পদ্ধতিতে প্রাপ্ত উপাদান এক্স-রে অপবর্তন দ্বারা উপাদানের গঠন নির্ণয়ের জন্য ব্যবহার করা যেতে পারে।
কৃত্রিম পদ্ধতি এবং বৈশিষ্ট্যায়ন এই অর্থে অনেকটাই সম্পর্কিত যে একটির বদলে কয়েকটি বিক্রিয়া মিশ্রণ তৈরি করে তাদের উপর তাপ চিকিৎসা বা হিট ট্রিটমেন্ট প্রয়োগ করা হয়। কোন অনুপাতে বিক্রিয়ক নিলে তা নতুন কঠিন যৌগ বা পরিচিত কঠিন যৌগের দ্রবণ তৈরি করবে তা খুঁজে বের করার জন্য সাধারণত স্টকিওমেট্রিতে ভিন্ন ভিন্ন পদ্ধতি রয়েছে। বিক্রিয়ার উৎপাদ চিহ্নিত করার একটি প্রধান পদ্ধতি হল চূর্ণ বিভাজন, কারণ অনেক কঠিন পদার্থের বিক্রিয়া পলিক্রিস্টালাইন পিণ্ড বা গুঁড়া উৎপন্ন করে। চূর্ণ বিভাজনের মাধ্যমে মিশ্রণে পরিচিত উপাদানের শনাক্তকরণ সহজতর হয়। যদি এমন কোন কেলাসের বিন্যাস পাওয়া যায় যা বিভাজন তথ্যভাণ্ডারের সাথে মিলে না, তবে বিন্যাসটিকে সেখানে লিপিবদ্ধ করার চেষ্টা করা যেতে পারে, অর্থাৎ প্রতিসাম্য এবং একক কাঠামোর আকার শনাক্ত করা যায়। (যদি উপাদানটি কেলাসিত না হয় তবে সাধারণত এর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য নির্ণয় করা আরও বেশি কঠিন হয়ে থাকে )
নতুন দশাটির একক কাঠামো সম্পর্কে জানার পর, পরবর্তী পদক্ষেপ হল দশাটির স্টকিওমেট্রি বা উপাদানের মধ্যবর্তী অবস্থা প্রতিষ্ঠিত করা। এটি কয়েকটি উপায়ে করা সম্ভব।
কখনও কখনও মূল মিশ্রণের অনুপাত হতেও এর সূত্র পাওয়া যায়। এটি ঘটে যদি শুধুমাত্র একটি উপাদান বা একক পাউডার প্যাটার্ন খুঁজে পাওয়া যায় অথবা যদি কেউ কোনও নির্দিষ্ট উপাদানের মিশ্রণ জ্ঞাত উপকরণের উপায়ে তৈরি করতে চেষ্টা করে-তবে এটি হওয়া বিরল। নতুন উপাদানের বিশুদ্ধ নমুনার জন্য, সংশ্লেষণ পদ্ধতির পরিমার্জিত করতে প্রায়ই উল্লেখযোগ্য প্রচেষ্টার প্রয়োজন। যদি বিক্রিয়ার মিশ্রণ থেকে উৎপাদ আলাদা করা সম্ভব হয় তবে সেটির মৌলিক বিশ্লেষণ করা যেতে পারে। আরেকটি পদ্ধতির জন্য স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ এবং ইলেক্ট্রন বিম এর মধ্যে বৈশিষ্ট্যপূর্ণ এক্সরে তৈরি করা প্রয়োজন। প্রতিবিম্ব তৈরির ক্ষমতা এবং উপাত্ত তৈরির গতির কারণে এক্স-রে বিচ্ছুরণ ব্যবহার করা হয় [৬]।
স্ক্যানিং ইলেক্ট্রন মাইক্রোস্কোপ এর পদ্ধতিতে প্রায়ই প্রস্তুতিমূলক পদ্ধতিগুলি পুনর্বিবেচনা এবং পরিমার্জন করা প্রয়োজন হয়। এই পদ্ধতিটি কোন উপাদানের দশা কোন গঠন এবং স্টকিওমেট্রিতে স্থিতিশীল তার সাথে সম্পর্কিত বা অন্য কথায়, উপাদানটির দশা চিত্রের আকার কেমন দেখায় তার সাথে। [৭] ডিএসসি বা ডিটিএর মতো তাপ বিশ্লেষণ কৌশল এটি পদ্ধতির একটি গুরুত্বপূর্ণ হাতিয়ার। এর জন্য সিঙ্ক্রোট্রনের তাপমাত্রা-নির্ভরশীল চূর্ণ বিভাজনের আবির্ভাবের কাছে এটি কৃতজ্ঞ।
দশা সম্পর্কিত জ্ঞানের বৃদ্ধির ফলে প্রায়ই পুনরাবৃত্তিমূলক কৃত্রিম পদ্ধতি পরিমার্জনা আরও বাড়ে। নতুন পর্যায়ে দশাগুলোকে তাদের গলনাঙ্ক এবং স্টকিওমেট্রিক ডোমেন দ্বারা চিহ্নিত করা হয়। পরের ধাপটি অনেক অ-স্টকিওমেট্রিক কঠিন যৌগের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। এক্সআরডি থেকে প্রাপ্ত কোষের মান সমসত্ত্বতা পরিসর চিহ্নিত করার জন্য বিশেষভাবে সহায়ক।
পরবর্তী বৈশিষ্ট্যায়ন
সমস্ত ক্ষেত্রে না হলেও বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই নতুন আবিষ্কৃত কঠিন যৌগগুলোকে পুনরায় চিহ্নিত করা হয় [৮] যা কঠিন-অবস্থা পদার্থবিজ্ঞান থেকে কঠিন-অবস্থা রসায়নের মধ্যে একটি সূক্ষ্ম পার্থক্যের সৃষ্টি করে।
আলোকীয় বৈশিষ্ট্য
অধাতব পদার্থের জন্য, প্রায়ই অতিবেগুনী/ভিআইএস বর্ণালি পাওয়া যায়। অর্ধপরিবাহীর ক্ষেত্রে এটি শক্তিস্তরের পার্থক্য সম্পর্কে ধারণা দিয়ে থাকে।