ঈমান, তাকওয়া ও তাওয়াক্কুল (একমাত্র আল্লাহর উপর নিরংকুশ ভরসা) এবং সর্বাবস্থায় সকল ক্ষেত্রে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টি অর্জনকে জীবনের পরম ব্রত ও লক্ষ্য স্থির করে একমাত্র আল্লাহ তায়ালার সত্ত্বার সাথে ভয় ও আশার সম্পর্ক স্থাপন এবং তাতে অবিচল থাকা।
মহানবি হজরত মুহাম্মদ (সা.)-এর বাণী ‘আমি ও আমার সাহাবীগণ যে মত-পথের উপর প্রতিষ্ঠিত’-এর আলোকে আহলুস সুন্নাহ ওয়াল জামাআতের মতাদর্শ অনুসরণে আম্বিয়া আলাইহিমুস সালামের নিষ্পাপ হওয়ার বিশ্বাস এবং সাহাবায়ে কিরাম রাদিয়াল্লাহু আনহুমের যথাযথ মার্যাদা ও তাঁদের সত্যের মাপকাঠি হওয়ার বিশ্বাস অন্তরে সুদৃঢ় করা ও তদনুসারে জীবন যাপন।
উপমহাদেশে ইসলামি রেনেসাঁর অগ্রদূত হজরত শাহ ওয়ালিউল্লাহ মুহাদ্দিসে দেহলভি (রহ.)-এর চিন্তাধারার অনুসারী ও অনুগামী হজরত কাসেম নানুতুবি (রহ.) ও হজরত রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি (রহ.) প্রমুখ আকাবিরে দেওবন্দের চিন্তা-চেতনার অনুসরণ এবং তালিম-তরবিয়াতসহ জীবনের সকল ক্ষেত্রে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতি, আদর্শ ও কর্মপদ্ধতি অনুসরণ।
আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ কর্তৃক প্রণীত পাঠ্যক্রম ও পাঠ্যসূচি, শিক্ষা, গবেষণা, প্রশিক্ষণ, ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, মাদ্রাসা পরিচালনা ইত্যাদিতে প্রভাবমুক্ত থেকে স্বকীয় বৈশিষ্ট্য বজায় রাখা।
ইতিহাস
প্রেক্ষাপট
১৬০০ সালে ইংল্যান্ডের রানি প্রথম এলিজাবেথ প্রদত্ত সনদের মাধ্যমে প্রাচ্যের জলপথে একচেটিয়া বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। ১৬১২ সালে এই কোম্পানি মুঘল প্রশাসন থেকে সুরাটে বাণিজ্য করার অধিকার লাভ করে। ১৬১৫ সালে মুঘল সম্রাটজাহাঙ্গীরের অনুমতি পেয়ে কোম্পানি দক্ষিণ ভারতের পশ্চিম ও পূর্ব উপকূলে বাণিজ্যকুঠি স্থাপন করে।[৯] আস্তে আস্তে এই কোম্পানি সারা ভারতে বাণিজ্যের প্রসার ও রাজনৈতিক আধিপত্য বিস্তার করতে থাকে। ১৭৫৭ সালে পলাশীর যুদ্ধে বাংলার নবাব কোম্পানির হাতে পরাজিত হলে কার্যত ভারতে কোম্পানি শাসনের সূচনা ঘটে।[১০] দ্বাদশ শতাব্দী হতে ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষমতার কেন্দ্র থাকা মুসলমানদের ক্ষমতা ইংরেজদের হাতে চলে যাওয়ার পর এবং মুসলমানদের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক ভাবে পঙ্গু করার জন্য ইংরেজদের সবার্ত্মক প্রচেষ্টার কারণে মুসলিম সমাজে অবনতি হয়। মুসলমানদের এই অবনতি থেকে উদ্ধারের জন্য শাহ ওয়ালিউল্লাহ দেহলভী সংস্কার কাজ শুরু করেন।[১১] তার মৃত্যুর পর তার ছেলে শাহ আবদুল আজিজ এই সংস্কার কাজ চালিয়ে যান। তিনি ভারতকে দারুল হারব ঘোষণা করে জিহাদ করা ফরজ মর্মে ফতোয়া জারি করেন।[১২] এইজন্য তিনি সৈয়দ আহমদ বেরলভিকে নির্বাচন করেন। সৈয়দ আহমদ বেরলভি ও তার শিষ্য শাহ ইসমাইল শহীদ ১৮৩১ সালে বালাকোট যুদ্ধে মারা যান।[১৩] কিন্তু মুসলমানদের আন্দোলন চলতে থাকে। ১৮৫৭ সালে এসে তা সিপাহি বিদ্রোহে রূপ নেয়। এক পর্যায়ে উত্তরপ্রদেশেরসাহারানপুর জেলারথানা ভবনকে কেন্দ্র করে একটি স্বাধীন এলাকার সৃষ্টি হয়। এই এলাকায় অস্থায়ী সরকার গঠন করে প্রধান বিচারপতি হন রশিদ আহমদ গাঙ্গুহি, প্রধান সেনাপতি কাসেম নানুতুবি ও আমিরুল মুমিনীন বা রাষ্ট্রপ্রধান হন ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি।[১৪] ১৮৫৭ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর এই অস্থায়ী সরকারের নেতৃত্বে শামলীর যুদ্ধ সংঘটিত হয়। এই যুদ্ধে জামেন শহীদ নিহত হন। অপরাপর নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন করেন। স্বাধীন থানা ভবন সরকারের পতন ঘটে। এই সিপাহি বিদ্রোহ ব্যর্থ হলে ইংরেজ সরকার ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি, কাসেম নানুতুবি, রশিদ আহমদ গাঙ্গুহির বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা ও পুরস্কার ঘোষণা করে।[১৫][১৬] এই বিদ্রোহ ব্যর্থ হলেও এটি ঔপনিবেশিক প্রশাসনে অতি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনয়নে সমর্থ হয়। ভারত সরকার আইন, ১৮৫৮ পাসের মাধ্যমে ভারতে কোম্পানি শাসনের অবসান ঘটে এবং সরাসরি ব্রিটিশ সরকারের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়।[১৭] দীর্ঘদিন আত্মগোপনের পর ১৮৫৯ সালে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কি মক্কায় হিজরত করতে সক্ষম হন।[১৫] কিছুদিন পর সাধারণ ক্ষমা ঘোষিত হলে কাসেম নানুতুবি ও রশিদ আহমদ গাঙ্গুহিও আত্মগোপন থেকে মুক্ত কর্মক্ষেত্রে পদার্পণ করেন।[১৮]
১৮৫৭ সালে এটি প্রচার করা হয় যে, ইশ্বর ব্রিটিশদের পক্ষে আছেন বলেই তারা যুদ্ধে জয়লাভ করেছে। শিক্ষাব্যবস্থায় রদবদলের মাধ্যমে তারা সাধারণ জনগণকে খ্রিস্টধর্মে ধমার্ন্তরিত করতে প্ররোচিত ও উৎসাহিত করে।[১৯] স্বাধীনতা সংগ্রাম, যুদ্ধ ও ইংরেজদের ষড়যন্ত্রের কারণে মুসলমানদের শিক্ষা ও সংস্কৃতি পর্যুদস্ত হয়ে পড়ে। ধর্মীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোও পৃষ্টপোষকতার অভাবে ধ্বংস হয়ে যায়। মুসলিম সমাজে অনৈসলামিক সংস্কৃতি প্রভাব বিস্তার করে।[২০] এমতাবস্থায় আপাততঃ সশস্ত্র সংগ্রামের ধারা স্থগিত রেখে সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী স্বাধীনতা আন্দোলন ও ইসলামের চেতনায় একদল কর্মী তৈরির লক্ষ্যে ইমদাদুল্লাহ মুহাজিরে মক্কির ইঙ্গিতে ও কাসেম নানুতুবির নেতৃত্বে এবং সিপাহি বিদ্রোহে অংশগ্রহণকারী কয়েকজন ব্যক্তির মাধ্যমে ১৮৬৬ সালের ৩০ মে ভারতের উত্তরপ্রদেশস্থ সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক বস্তিতে সাত্তা মসজিদের প্রাঙ্গনে ছোট্ট একটি ডালিম গাছের ছায়ায় দারুল উলুম দেওবন্দের গোড়া পত্তন করা হয়।[২০]
ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভের পর ভারত ও পাকিস্তান নামে নতুন রাষ্ট্র সৃষ্টি হলে কওমি মাদ্রাসার সরকারি স্বীকৃতি লাভের জন্য তোড়জোড় শুরু হয়। পাকিস্তান আমলে সর্বপ্রথম আতহার আলী, ছিদ্দিক আহমদ, শামসুল হক ফরিদপুরী এ মাদ্রাসাগুলোর সরকারি স্বীকৃতির দাবি উত্থাপন করেন।[২৬] আতহার আলী স্বীকৃতির বিল আনার জন্য শফি উসমানিকে চিঠি লিখেন, যা এখনো সংরক্ষিত আছে।[২৭]বাংলাদেশের স্বাধীনতা উত্তর সময়ে আশির দশকে প্রতিষ্ঠিত হয় বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ, যা সংক্ষেপে বেফাক নামে পরিচিত। প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে এটি স্বীকৃতির দাবি নিয়ে কাজ করতে থাকে। এক্ষেত্রে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন হারুন ইসলামাবাদী, নূর উদ্দিন গহরপুরী, আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী, আবুল ফাতাহ মুহাম্মদ ইয়াহইয়া সহ বেফাকের প্রমুখ দায়িত্বশীল ব্যক্তিবর্গ।[২৬][২৭] বেফাকের প্রতিকূলতার কারণে আবদুল জাব্বার জাহানাবাদী তরুণদের মাধ্যমে স্বীকৃতির দাবি জোরালো করার চিন্তা করেন। ফলশ্রুতিতে নব্বইয়ের দশকে তার পৃষ্ঠপোষকতায় গড়ে উঠে ‘বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা পরিষদ’ ও ‘কওমি মাদ্রাসা ছাত্র পরিষদ’। স্বীকৃতির দাবিতে জনমত তৈরির জন্য এই দুই সংগঠন ক্ষুদ্র পরিসরে প্রচার কাজ শুরু করে।[২৬] ১৯৯২ সালের ২৯ মার্চ ঢাকা জেলা ক্রীড়া সমিতি মিলনায়তনে আয়োজিত ইসলামী ছাত্র মজলিসের কলেজ প্রতিনিধি সম্মেলনে কওমি মাদ্রাসা শিক্ষার সরকারি স্বীকৃতি সহ ১৩ দফা জাতীয় শিক্ষা দাবি উত্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে সেই দাবিতে এক লক্ষ স্বাক্ষর সংগ্রহ করে তৎকালীন বিএনপি সরকারের শিক্ষামন্ত্রী বরাবর জমা দেয়া হয়।[২৮] ২০০৫ সালের ১৫ এপ্রিল আজিজুল হকপল্টন ময়দানে ‘কওমি মাদ্রাসা জাতীয় ছাত্র কনভেশন’ আয়োজন করে স্বীকৃতির দাবি তুলে ধরেন।
পরের বছর ২০০৬ সালের ১৬ আগস্ট থেকে ২০ আগস্ট পর্যন্ত তিনি ঢাকার মুক্তাঙ্গনে লাগাতার ৫ দিন অনশন ও অবস্থান কর্মসূচি পালন করেন। ৫ম দিন তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়া তার কার্যালয়ে একটি ওলামা সম্মেলন ডেকে কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসের সনদকে মাস্টার্সের সমমান ঘোষণার আশ্বাস দিলে তিনি অবস্থান কর্মসূচি স্থগিত করেন।[২৭] আজিজুল হকের এ কর্মসূচির ফলে স্বীকৃতির দাবি সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ে এবং ব্যাপক জনমত তৈরি হয়। তার সাথে উবায়দুল হক, মুহিউদ্দীন খান, ফজলুল হক আমিনী, সৈয়দ ফজলুল করিম প্রমুখ একাত্মতা ঘোষণা করেন।[২৬] কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা রক্ষার প্রশ্নে আপোষহীন অবস্থান নেন মুফতি আব্দুর রহমান।[২৭] খালেদা জিয়া তার সরকারের মেয়াদ শেষ হওয়ার পূর্ব মূহুর্তে কওমি সনদের রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতির ঘোষণা দেন এবং ২০০৬ সালের ২০ ডিসেম্বর মন্ত্রণালয় এসংক্রান্ত গেজেটও প্রকাশ করে।[২৮] তবে সেটি বাস্তবায়নের কোনো সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ গ্রহণের সময় বা সুযোগ ঐ সরকার পায়নি৷ তখন বিরোধী দল আওয়ামী লীগ এ দাবির সাথে একমত ছিলেন না।[২৯] ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে আওয়ামী লীগের ঘনিষ্ঠ হিসেবে পরিচিত ফরীদ উদ্দীন মাসঊদ ও রুহুল আমিনের মাধ্যমে এই স্বীকৃতির দাবি আবার সামনে আসে।[২৬][৩০]শেখ হাসিনা ক্ষমতায় আসার পর প্রথমে ২৫ সদস্য এবং পরে ৬২ সদস্যের আলেমদের প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ করে কওমি মাদ্রাসার শিক্ষা সনদের স্বীকৃতির দাবি জানায়। প্রতিনিধিদলে আজিজুল হক ও শাহ আহমদ শফীও ছিলেন।[৩১] ২০০৯ সাল থেকেই প্রধানমন্ত্রী আলেমদের সঙ্গে যে আলোচনার সূত্রপাত করেন, সেটি ২০১০ সালে গ্রহণ করা শিক্ষানীতিতেও স্থান পায়। ২০১২ সালে কওমি সনদের স্বীকৃতি বাস্তবায়নে শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে বাংলাদেশ কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা কমিশন গঠন করে সরকার।[৩২]
নানা প্রতিকূলতার কারণে কমিশনের কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হয়।[২৬] পরিশেষে ২০১৬ সালের ১০ ডিসেম্বর হাটহাজারী মাদ্রাসায় শাহ আহমদ শফীর সঙ্গে দেশের শীর্ষস্থানীয় আলেমদের এক বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। সে বৈঠকে কওমি মাদ্রাসার স্বকীয়তা পূর্ণমাত্রায় বজায় রেখে দারুল উলুম দেওবন্দের মূলনীতির আলোকে কওমি সনদের স্বীকৃতি গ্রহণ করার সিদ্ধান্ত হয়।[২৬] আলেমদের ঐক্যমতের পর ২০১৭ সালে ১১ এপ্রিল শাহ আহমদ শফীর নেতৃত্বে দেশের শীর্ষ আলেমরা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে সাক্ষাৎ করলে প্রধানমন্ত্রী আনুষ্ঠানিকভাবে কওমি সনদের স্বীকৃতির ঘোষণা প্রদান করেন।[২৬] ১৩ এপ্রিল শিক্ষা মন্ত্রণালয় থেকে এসংক্রান্ত গেজেট প্রকাশিত হয়।[৩৩] প্রজ্ঞাপন জারির পর আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশের অধীনে অভিন্ন প্রশ্নে ১৫ মে প্রথমবারের মতো সারা দেশে মোট ২১৮টি কেন্দ্রে দাওরায়ে হাদিস পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়।[২৮] ২০১৮ সালের ১৩ আগস্ট এই আইনের খসড়ার অনুমোদন দেয় মন্ত্রিসভা। ১০ সেপ্টেম্বর প্রথমবার তা সংসদে তোলা হয়। ১৯ সেপ্টেম্বর বিলের ওপর দেওয়া জনমত যাচাই, বাছাই কমিটিতে পাঠানো এবং সংশোধনী প্রস্তাবগুলোর নিষ্পত্তি শেষে কণ্ঠভোটে বিলটি পাস হয়।[৩৪] ৮ অক্টোবর রাষ্ট্রপতির সম্মতিলাভের পর এটি আইনে পরিণত হয়। আইনটি পাসের জন্য ২০১৮ সালের ৪ নভেম্বর শুকরানা মাহফিল আয়োজনের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে সংবর্ধনা প্রদান করা হয়।[৩০]
সরকার স্বীকৃত ৬টি শিক্ষাবোর্ডের বাইরে প্রাথমিক, নূরানী, হাফেজী, কুরআন সহ বিভিন্ন বিশেষায়িত শিক্ষাবোর্ড কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৬০-এর দশকে কারী বেলায়েত হুসাইনের উদ্ভাবিত নূরানী পদ্ধতির আলোকে গড়ে উঠে নূরানী তা’লীমুল কুরআন বোর্ড বাংলাদেশ। নূরানী পদ্ধতি হলো একটি শিক্ষাপদ্ধতি যার মাধ্যমে শিশুদের সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কুরআন ও বেসিক ইসলামি শিক্ষা দেওয়া হয়।[৪১] ১৯৯৫ সালে চট্টগ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় নূরানী তালীমুল কোরআন বোর্ড চট্টগ্রাম বাংলাদেশ।[৪২] ১৯৮৯ সালে চরমোনাই পীর সৈয়দ ফজলুল করিম বাংলাদেশ কুরআন শিক্ষা বোর্ড গঠন করেন।[৪৩] এছাড়াও চাকরিজীবীদের জন্য নৈশকালীন মাদ্রাসার কার্যক্রম চালাতে গড়ে উঠেছে বাংলাদেশ নৈশ মাদ্রাসা শিক্ষাবোর্ড।[৪৪]
২০১৮ সালে তাবলিগ জামাতের বিভাজনকে কেন্দ্র করে তাবলিগের কেন্দ্রীয় আমির সাদ কান্ধলভীর অনুসারী মাদরাসাগুলোর পরীক্ষা স্থগিত করে দেয় কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিয়াতিল কওমিয়া বাংলাদেশ। পরবর্তীতে আল হাইআতুল উলয়া নিয়ন্ত্রণের বাইরে গিয়ে আলাদা বোর্ড প্রতিষ্ঠা করে সাদ অনুসারী কয়েকটি মাদ্রাসা, যা জাতীয় কওমী মাদরাসা শিক্ষাবোর্ড নামে পরিচিত।[৪৫]
২০২১ সালের এপ্রিলে কওমি মাদ্রাসার সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষ আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ একটি বিজ্ঞপ্তি জারি করে, যাতে কওমি মাদ্রাসার অভ্যন্তরে ছাত্র-শিক্ষকদের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার ঘোষণা প্রদান করা হয়।[৪৬]
২০২২ সালের শুরুর দিকে কওমি মাদ্রাসাকে রাষ্ট্রীয় নিয়ন্ত্রণে আনার উদ্যোগ নেয় সরকার। এলক্ষ্যে শিক্ষা আইনের খসড়ায় কওমি মাদ্রাসাকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।[৪৭] তবে কওমি শিক্ষার স্বকীয়তা নষ্ট হওয়ার কারণ দেখিয়ে সরকারের নিবন্ধনের প্রস্তাবে রাজি হয় নি কওমি বোর্ডের নেতৃবৃন্দ।[৪৮] ফলশ্রুতিতে সরকারের এই উদ্যোগ বাতিল হয়। মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. আবু বকর ছিদ্দীক বলেন, এটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত।[৪৯]
২০২২ সালের ২৫ জুন হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশের নায়েবে আমির মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী প্রধানমন্ত্রী বরাবর "কওমি ধারার দ্বীনি শিক্ষা ও শিক্ষকের মান উন্নয়নকল্পে সদয় দৃষ্টি আকর্ষণ" শীর্ষক একটি চিঠি প্রদান করে ৮ টি সুপারিশ তুলে ধরেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ১০ আগস্ট স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালের সভাপতিত্বে একটি সভার আয়োজন করে। সভায় যোগ দিতে শিক্ষামন্ত্রী, শিক্ষাউপমন্ত্রী, ধর্ম প্রতিমন্ত্রী, জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব, কারিগরি ও মাদ্রাসা শিক্ষা বিভাগের সচিব, ধর্ম বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সচিব, পুলিশ মহাপরিদর্শক, এনএসআই মহাপরিচালক, ডিজিএফআই মহাপরিচালককে অনুরোধ করা হয়। পাশাপাশি ছয়টি কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ডের সভাপতি ও মহাসচিবকেও বৈঠকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।[৫০] পরবর্তীতে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এই বৈঠকে অংশগ্রহণে অপারগতা প্রকাশ করে এবং মুহাম্মদ মিজানুর রহমান চৌধুরী চিঠিকে এখতিয়ার বহির্ভূত কর্মকাণ্ড হিসেবে উল্লেখ করে।[৫১]
পাঠ্যক্রম
কওমি মাদ্রাসার প্রথম ধাপ: মক্তব ২ বছর, নাজেরা ২ বছর, হেফজ ২-৩ বছর প্রত্যয়নের মাধ্যমে ইবতেদায়ি-১ বছর (৫ম শ্রেণি সমাপনী পরীক্ষার সমমান) সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
দ্বিতীয় ধাপ: মিজান ১ বছর, নাহবেমির ১ বছর, হেদায়াতুন্নাহু ১ বছর, কাফিয়া ১ বছর, শরহে বেকায়াহ ১ বছর, জালালাইন ১ বছর, মেশকাত ১ বছর, দাওরা হাদিস ১ বছর (মাস্টার্স পরীক্ষার সমমান) সার্টিফিকেট প্রদান করা হয়।
উচ্চতর গবেষণা: দাওরা হাদিসের পর ফিকহ/মুফতি (১-২ বছর), উলুমুল হাদিস (২-৩ বছর), তাফসির বিভাগ (১-২ বছর)।[৫২]
কওমি মাদ্রাসা কেন্দ্রিক সবচেয়ে আলোচিত সংগঠন হলো হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। ২০১০ সালের ১৯ জানুয়ারি এটি আত্মপ্রকাশ করে। ২০১১ সালে এটি সরকার ঘোষিত নারী উন্নয়ন নীতিমালার বিরোধিতা শুরু করে। এটি মূলত আলোচনায় আসে ১৩ দফা কর্মসূচি দিয়ে ২০১৩ সালের শাপলা চত্বর সমাবেশের মাধ্যমে।[৫৩] মানবাধিকার সংগঠন অধিকারের তথ্যমতে, এই সমাবেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর আক্রমণে প্রায় ৬১ জন নিহত হয়।[৫৪] পরবর্তীতে হেফাজতের একটি অংশের সাথে সরকারের সখ্য গড়ে উঠে। ফলশ্রুতিতে সরকার কওমি মাদ্রাসাকে সরকারি স্বীকৃতি প্রদান করে।[৫৫] ২০১৮ সালে হেফাজতের দাবি মতো পাঠ্যপুস্তক সংশোধন করা হয়।[৫৬] এর আগে ২০১৭ সালে সুপ্রিম কোর্ট চত্বরে স্থাপিত গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণ করা হয়।[৫৭] ২০২০ সালে দারুল উলুম হাটহাজারীর ছাত্র আন্দোলনের পর হেফাজতের নেতৃত্বে পরিবর্তন আসে। একই বছর ডিসেম্বরে শেখ মুজিবুর রহমানের নির্মাণাধীন ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে সরকার এবং হেফাজতে ইসলামের মধ্যে ভাস্কর্য বিতর্ক শুরু হয়। ২০২১ সালে হেফাজত ঘোষিত মোদী-বিরোধী বিক্ষোভ ১৭ জন নিহত হয়। সব মিলিয়ে ২০২২ সালের মে পর্যন্ত হেফাজতের বিরুদ্ধে ২৫৪টি মামলায় কমপক্ষে এক লাখ ৮০ হাজার জনকে আসামি করা হয় এবং ব্যাপক ধরপাকড় করা হয়।[৫৮] হেফাজতের কর্মকাণ্ডের রাষ্ট্রীয় প্রভাব সম্পর্কে বিবিসি বাংলায় উল্লেখ করা হয়, এর কর্মকাণ্ড অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে যেমন প্রভাবিত করেছে, তেমনি প্রভাবিত করছে শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সমাজজীবনকেও।[৫৯]
রাজনৈতিক দল
নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৬টি দল কওমি মাদ্রাসাকেন্দ্রিক। দলগুলো হলো ইসলামী আন্দোলন, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্যজোট।[৬০]
কওমি মাদ্রাসায় জাতীয় সংগীত গাওয়া হয় না। কওমি সংশ্লিষ্টদের মতে, কওমি মাদ্রাসা মূলত কোরআন-হাদিসের শিক্ষা প্রদান করে থাকে। কোরআন-হাদিস একটি সংগীত দ্বারা শুরু করা যায় না।[৬১]
জঙ্গিবাদ
কওমি মাদ্রাসার ছাত্রদের জঙ্গিবাদে জড়িয়ে পড়া নিয়ে সমালোচনা হলেও বাংলাদেশ পুলিশের দেওয়া তথ্যমতে, আটক হওয়া জঙ্গিদের মধ্যে কওমি মাদ্রাসা থেকে আসা শিক্ষার্থীর সংখ্যা অনেক কম।[৬২]
↑বোস, সুগত (২০০৪)। Modern South Asia : history, culture, political economy [আধুনিক দক্ষিণ এশিয়া: ইতিহাস, সংস্কৃতি, রাজনৈতিক অর্থনীতি] (২য় সংস্করণ)। নিউইয়র্ক: রাউটলেজ। পৃষ্ঠা ৭৬। আইএসবিএন0-415-30786-4। ওসিএলসি52270088।
↑শাকিল, সালমান তারেক (১৯ মার্চ ২০১৯)। "ওয়াজ মাহফিল কি পেশায় পরিণত হচ্ছে?"। বাংলা ট্রিবিউন। ৭ এপ্রিল ২০২৩ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ৭ এপ্রিল ২০২৩।
↑পারভেজ, আজিজুল (৫ নভেম্বর ২০১৬)। "রাজনৈতিক বিভেদেই ভেস্তে যায় উদ্যোগ"। দৈনিক কালের কণ্ঠ। ২৪ নভেম্বর ২০২১ তারিখে মূল থেকে আর্কাইভ করা। সংগ্রহের তারিখ ১৯ সেপ্টেম্বর ২০২১।