এনামুল হক মনি (জন্ম: ২৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬) চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণকারী বাংলাদেশ জাতীয় ক্রিকেট দলের সাবেক আন্তর্জাতিক ক্রিকেটার। দলে মূলতঃ বামহাতে অর্থোডক্স বোলিং করতেন এনামুল হক। টেস্ট ক্রিকেট খেলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথম আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবে আইসিসি কর্তৃক মনোনীত হয়েছেন তিনি।
শৈশবকাল
তিনি বাংলাদেশের চট্টগ্রাম বিভাগের কুমিল্লা জেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এনামুল হকের ডাক নাম মনি। ১৯৮৮-৮৯ মৌসুমে তিনি বাংলাদেশ বিমান ক্রিকেট দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন তিনি এবং ঢাকা লীগ জয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ফলশ্রুতিতে তিনি পরবর্তী মৌসুমে জাতীয় ক্রিকেট দলের সদস্য হিসেবে মনোনীত হন। এরপর থেকেই দলের অন্যতম সদস্য ও অবিচ্ছেদ্য অংশ ছিলেন মনি। কিন্তু উচ্চ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকদের মনোযোগ আকর্ষণে ব্যর্থ হলেও অন্তরালে থেকে অনেক সাফল্য অর্জন করেছিলেন স্বীয় মহিমায়।
আইসিসি ট্রফি
মূলতঃ তিনি একজন অল-রাউন্ডার ছিলেন। আইসিসি ট্রফিতেই অধিকতর সফল ছিলেন এনামুল হক। ১৯৯০, ১৯৯৪ এবং ১৯৯৭ সালে অনুষ্ঠিত ৩টি আইসিসি ট্রফিতে তিনি সর্বমোট ৩৫টি উইকেট দখল করেন।
১৯৯০ সালে ২য় রাউন্ডে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে তিনি স্মরণীয় ভূমিকা পালন করেন। প্রথমে ড্যানিশরা ব্যাটিং করে নির্ধারিত ৬০ ওভারে ৯ উইকেটের বিনিময়ে ২৩৩ রান করে। এর জবাবে চট্টগ্রামের তিন ব্যাটসম্যান - নূরুল আবেদীন (৮৫), আকরাম খান (৫০) এবং মিনহাজুল আবেদীন নান্নু (৩৭) রান করে বাংলাদেশ দলকে জয়ের দ্বারপ্রান্তে এগিয়ে নিয়ে যান। কিন্তু মনি'র দ্রুতগতিতে চূড়ান্ত ওভারে তোলা ১৭* রান বাংলাদেশকে মাত্র ২ বল বাকী থাকতে দলকে জয়ের নির্দিষ্ট লক্ষ্যে নিয়ে যায়। বল হাতে নিয়ে তিনি তার নির্ধারিত ১২ ওভারের কোটায় ২৬ রানে ২ উইকেট পান। তার এই অল-রাউন্ডার নৈপুণ্যে নিশ্চিতভাবেই ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হন। এ সাফল্যগাঁথার বিপরীতে তার স্মরণীয় ব্যর্থতা ছিল স্বাগতিক কেনিয়ার বিরুদ্ধে নাইরোবিতে ফেব্রুয়ারি, ১৯৯৪ সালে। বাঁচা-মরার লড়াইয়ে স্বাগতিক দল প্রথমে ব্যাট করে ২৯৫/৬ রান করে ৫০ ওভারে। মরিস ওদুম্বে ১১৯ রান করেছিলেন। জবাবে বাংলাদেশ শুরুতে বেশ ভালভাবে অগ্রসর হয়। উদ্বোধনী জুঁটিতে জাহাঙ্গীর আলম ও আমিনুল ইসলাম ১৩৯ রান করেন। এরপর মিনহাজুল আবেদীন নান্নু ৬৮ রান করেন। কিন্তু খেলার চূড়ান্ত পর্যায়ে দুঃখজনকভাবে এনামুল হক শূন্য বা ডাক রান করেন। এরফলে ম্যাচটি বাংলাদেশের হাত থেকে ছিটকে যায় ও কেনিয়া ১৩ রানের নাটকীয় জয় পায়।[১]
স্মরণীয় ইনিংস
ঢাকায় ফেব্রুয়ারি, ১৯৯২ সালে মনি তার স্মরণীয় ইনিংস খেলেন সফররত পশ্চিমবাংলা দলের বিরুদ্ধে ৩দিনের খেলায়। এতে তিনি ১৩১ রান করেছিলেন। প্রথমে সফরকারী দল ৩৮৪/৫ (ডিক্লেয়ার) করে। এতে ৩নং ব্যাটসম্যান বামহাতি রাজা ভেঙ্কট ১৫৪ এবং অন্য বামহাতি ব্যাটসম্যান সৌরভ গাঙ্গুলী ১২৯ রান করেছিলেন। এর জবাবে স্বাগতিক দল ৭৭/৪ খুঁইয়ে ভীষণ চাপের মধ্যে পড়ে। ঐ মুহুর্তে মনি মাঠে প্রবেশ করেন। আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাথে ৫ম উইকেট জুটিতে ১০৪ করেন। নিচের সারির ব্যাটসম্যান হয়েও তারা দু'জন বেশ সাবলীল ভঙ্গীমায় সঙ্কট মোকাবেলা করেন। আমিনুল ইসলাম ৫৫ রান করলেও মনি বিপক্ষের বোলিং আক্রমণকে তুলোধুনো করে ছাড়েন। মনি'র ১৩১ রানের উপর ভিত্তি করেই বাংলাদেশ সম্মানজনক ৩০২ রান করে। স্লো বোলারদের বলগুলোকে সিক্সে রূপান্তর করেন। বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে উপস্থিত দর্শকেরা রৌদ্রোজ্জ্বল বিকেলে উচ্চমানের ব্যাটিং প্রদর্শনী দেখে মুগ্ধ হয়েছিলো মূলতঃ মনি'র ক্রীড়াশৈলী দেখে।[২]
সফলতম জুটি
খেলোয়াড়ী জীবনের শুরুতে এনামুল হক মনি সফলতম জুটি হিসেবে আরেক অল-রাউন্ডার আমিনুল ইসলাম বুলবুলের সাথেই স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতেন বেশি। ফলে বুলবুল ব্যাটিং অর্ডারের উপরের দিকে অগ্রসর হওয়ায় পরিবর্তিত হয়ে যায়। ব্যাটিংয়ে ব্যাপকভাবে মনোযোগী হওয়ায় বুলবুল বোলিংয়ে কম গুরুত্ব দিতে শুরু করেন। এরপর ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালে বাংলাদেশ জাতীয় দলে নুতন অল-রাউন্ডার মোহাম্মদ রফিক আবির্ভূত হন।
২য় সার্ক ক্রিকেট প্রতিযোগিতায় মনি-বুলবুল বোলারদ্বয় স্বাগতিক দলকে ফাইনালে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। ডিসেম্বর, ১৯৯৪ সালে অনুষ্ঠিত ঐ প্রতিযোগিতায় শ্রীলঙ্কা-এ দলের বিরুদ্ধে মনি ৩/২৫ এবং মোহাম্মদ রফিক ভারত-এ দলের বিরুদ্ধে ৩/২৫ পেয়েছিলেন।[৩]
এ দু'জন ১৯৯৭ সালের আইসিসি ট্রফিতে বাংলাদেশ দলের অবিস্মরণীয় বিজয়ে অসামান্য ভূমিকা রাখেন। তারা দু'জন একত্রে ৩১ উইকেট লাভ করেন। রফিক ১৯ উইকেট নেন ১০.৬৮ গড়ে এবং মনি ১২ উইকেট নেন ১৮ রান গড়ে। এছাড়াও, রফিক চূড়ান্ত খেলাঢ চমৎকার ব্যাটিংশৈলী প্রদর্শন করেন। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ২ ছয় ও ২ চারে মাত্র ১৫ বলে ২৬ রান করেছিলেন।[৪]
অবশেষে তারা ১৯৯৮ সালে কেনিয়ার বিরুদ্ধে প্রথমবারের মতো জয়ী হওয়া একদিবসীয় খেলায় অংশ নিয়েছিলেন। এতে রফিক ৭৭ রান এবং ৩/৫৬ নিয়ে ম্যান অব দ্য ম্যাচ নির্বাচিত হয়েছিলেন। সেখানে মনি ১০ ওভারের বিনিময়ে মাত্র ৪৫ রান দেন ও ২টি উইকেট লাভ করেন।[৫]
আন্তর্জাতিক আম্পায়ার
৩ ডিসেম্বর, ২০০৬ সাল থেকে এনামুল হক মনি আন্তর্জাতিক আম্পায়ার হিসেবে একদিনের আন্তর্জাতিক খেলায় বিচারকের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। পরবর্তীতে ২৬-২৮ জানুয়ারি, ২০১২ সালে ন্যাপিয়ারে অনুষ্ঠিত নিউজিল্যান্ড বনাম জিম্বাবুয়ে - এ দু'টি বিদেশী দু'দলের মধ্যেকার টেস্ট খেলায় বাংলাদেশের পক্ষ থেকে প্রথমবারের মতো আম্পায়ার হবার বিরল মর্যাদার অধিকারী হন। উইকেটের অপর প্রান্তে থেকে তাকে সহযোগিতা করেন অস্ট্রেলীয় আম্পায়ার আর.জে টাকার।