আলমগীর কবির (ডিসেম্বর ২৬, ১৯৩৮ রাঙামাটি জেলায় – জানুয়ারি ২০, ১৯৮৯) স্বনামধন্য বাংলাদেশী চলচ্চিত্র পরিচালক এবং সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি বাংলাদেশের চলচ্চিত্র ইতিহাসে বেশ কিছু প্রভাবশালী চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন।[২] তার তিনটি চলচ্চিত্র ব্রিটিশ ফিল্ম ইন্সটিটিউটের "বাংলাদেশের সেরা ১০ চলচ্চিত্র" তালিকায় স্থান পেয়েছে।[৩]
প্রাথমিক জীবন ও কর্ম জীবন
তিনি ১৯৩৮ সালের ২৬শে ডিসেম্বর রাঙামাটিতে জন্মগ্রহণ করেন। তার পৈতৃক বাসস্থান ছিল বরিশাল জেলায় অবস্থিত বানারিপাড়া উপজেলায়। আলমগীর কবির তার শিক্ষা জীবন শুরু করেন হুঘলি কলেজিয়েট স্কুল থেকে। তিনি ১৯৫২ সালে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল থেকে ম্যাট্রিক এবং ১৯৫৪ সালে ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় পাশ করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞান বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি গ্রহণের পরে, তিনি অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে ইলেক্ট্রিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং বিষয়ে উচ্চতর শিক্ষা লাভের উদ্দেশ্যে ইংল্যান্ড চলে যান। এই সময়ে তিনি ইংগনমার বার্গম্যানেরসেভেনথ সিল সম্পর্কে জানতে পারেন। তিনি চলচ্চিত্রটি বেশ কয়েকবার দেখেন এবং চলচ্চিত্র নির্মাণের প্রতি আকৃষ্ট হন। তিনি এ সময়ে চলচ্চিত্রশিল্পের ইতিহাস, চলচ্চিত্র পরিচালনা এবং কলাশাস্ত্রের উপর বেশ কয়েকটি প্রশিক্ষণ কোর্স সম্পন্ন করেন।
তিনি ইংল্যান্ডের কম্যুনিস্ট পার্টিতে যোগ দেন এবং কম্যুনিস্ট পার্টির খবরের কাগজ, ডেইলি ওয়ার্কারের প্রতিবেদক হিসেবে কাজ শুরু করেন। কম্যুনিস্ট দৈনিকের প্রতিবেদক হিসেবে, তিনি কিউবার রাষ্ট্রপতি ফিডেল ক্যাস্ত্রোর সাক্ষাৎকার গ্রহণ করেন[৪]। তিনি প্যালেস্টাইন এবং আলজেরিয়ার স্বাধীনতাযুদ্ধেও কাজ করেন। আলমগীর লন্ডনে ইস্ট পাকিস্তান হাউস এবং ইস্ট বেঙ্গল লিবারেশন ফ্রন্ট নামের সংগঠন গড়ে তোলেন এবং জাতিগত বৈষম্যের বিরুদ্ধে বিভিন্ন কার্যক্রমে সক্রিয় হন।
১৯৬৬ সালে আলমগীর স্বদেশে ফিরে আসেন। বামপন্থী আন্দোলনে জড়িত থাকার কারণে আইয়ুব সরকার তাকে গ্রেফতার করে। পরবর্তীতে, তিনি একজন সাংবাদিক হিসেবে তার পেশাজীবন শুরু করেন এবং খুব অল্প সময়ের মধ্যেই একজন চলচ্চিত্র সমালোচক হিসেবে জনপ্রিয়তা লাভ করেন। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতার যুদ্ধ নির্মাণ শুরু সময়ে, তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগে প্রধান হিসেবে যোগ দেন। তিনি নির্বাসিত বাংলাদেশ সরকারের প্রধান প্রতিবেদক হিসেবেও কাজ করেন। এ সময় তিনি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের মাধ্যমে তার পরিচালক জীবন শুরু করেন।[১] চলচ্চিত্র নির্মাণ ছাড়াও তিনি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তমঞ্চের স্থাপত্য নকশা করেন।[৫]
স্বাধীনতার যুদ্ধের পরে, তিনি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ শুরু করেন। তার চলচ্চিত্রগুলো বেশ সমালোচিত এবং জনপ্রিয়তা লাভ করে।[১]
চলচ্চিত্র জীবন
আলমগীর কবির ১৯৭৩ সালে নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র ধীরে বহে মেঘনা। এই চলচ্চিত্রটির নির্মাণশৈলী বাংলাদেশে নির্মিত যেকোনো মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক চলচ্চিত্র থেকে আলাদা। এটিতে কবির যুক্ত করেছেন মুক্তিযুদ্ধের ফুটেজ ও ফিকশন যেমন- মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ, মুক্তিযোদ্ধাদের যুদ্ধযাত্রা, ১৬ ডিসেম্বর ট্রাকভর্তি মুক্তিযোদ্ধাদের জয়ধ্বনি এবং ঘরে ফেরার দৃশ্য। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (বাচসাস) এবং জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এটি ছিল কবির পরিচালিত প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র।[১]
এরপর ১৯৭৫ সালে কবির নির্মাণ করেন তার দ্বিতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সূর্য কন্যা। এই চলচ্চিত্রে কবির উপস্থাপন করেছেন ব্যক্তি, সমাজ ও ইতিহাসে নারীর অবস্থানের সাহসী ব্যাখ্যা। তার সূর্যকন্যা'র একটি স্বপ্নের সাহসী চরিত্র ছিল লেনিন। এই চলচ্চিত্রের দক্ষ নির্মাণ শৈলীর জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ পরিচালক ও শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্যকার হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন। এছাড়াও লাভ করেন জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার।[১]
কবির ১৯৭৭ সালে নির্মাণ করেন তার তৃতীয় পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র সীমানা পেরিয়ে। এটি নির্মাণ করা হয় মূলত ১৯৭০-এর ভয়াবহ জলোচ্ছ্বাসের একটি সত্যি ঘটনাকে কেন্দ্র করে। সেই সময় এই জলোচ্ছ্বাসের ধ্বংসলীলার প্রায় তিন মাস পর একজোড়া মানব-মানবীকে বরিশালের দক্ষিণের একটি সামুদ্রিক চরে আদিম পরিস্থিতিতে কোনো রকমে বেঁচে থাকতে দেখা গিয়েছিল। ঢাকার তৎকালীন সংবাদপত্রে ঘটনাটির বিবরণ কবিরের দৃষ্টি আকর্ষণ করে এবং তিনি এর বেশ কয়েক বছর পর সীমানা পেরিয়ে নামের এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেন। সুদক্ষতার সাথে এই চলচ্চিত্র নির্মাণের জন্য স্বীকৃতি স্বরূপ শ্রেষ্ঠ সংলাপ ও চিত্রনাট্য রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার লাভ করেন।[১]
এরপর ১৯৭৯ সালে নির্মাণ করেন রূপালী সৈকতে এটি ছিল কবিরের চতুর্থ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। রূপালী সৈকতে চলচ্চিত্রটিও সেই সময় দারুণ আলোচিত হয়, বিশেষ করে সংবাদ মাধ্যমে। এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতি পুরস্কার (বাচসাস) লাভ করেন।[১]
১৯৮২ সালে কবির নির্মাণ করেন মোহনা চলচ্চিত্রটি, এটি তার পরিচালিত পঞ্চম পূর্ণদৈর্ঘ্য্য চলচ্চিত্র। এই চলচ্চিত্রের জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ চিত্রনাট্য রচয়িতার হিসেবে একটি পুরস্কার লাভ করেন। এটি আন্তজার্তিকভাবেও বেশ প্রশংসিত হয়। ১৯৮২ সালের মস্কো আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব-এ মোহনা চলচ্চিত্রের জন্য কবির ডিপ্লোমা অফ মেরিট লাভ করেন।[১]
কবির তার ষষ্ঠ পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেন ১৯৮৪ সালে। পরিণীতা নামের এই চলচ্চিত্রটি শ্রেষ্ঠ চলচ্চিত্র হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার-এ ভূষিত হয়।[১] ১৯৮৫ সালে তিনি নির্মাণ করেন তার সপ্তম ও সর্বশেষ পূর্ণদৈর্ঘ্য্য চলচ্চিত্র মহানায়ক। এটি প্রযোজনা করেছিলেন বুলবুল আহমেদ।
কবির তার দেড় যুগের চলচ্চিত্র জীবনে সর্বমোট সাতটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন। এছাড়াও কবির নয়টি স্বল্প দৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র। প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণ করেছেন, এগুলো হলো- লিবারেশনফাইটার, পোগ্রম ইন বাংলাদেশ, কালচার ইন বাংলাদেশ, সুফিয়া, অমূল্য ধন, ভোর হলো দোর খোল, আমরা দুজন, এক সাগর রক্তের বিনিময, মনিকাঞ্চন ও চোরাস্রোত।[১]
২০০৮ সালে পরিচালক কাওসার চৌধুরী আলমগীর কবিরের কর্মজীবন নিয়ে গুণী চলচ্চিত্র ব্যক্তিদের সাক্ষাৎকার, তার নির্মিত চলচ্চিত্রের পর্যালোচনা এবং তার লাইভ ফুটেজ যুক্ত করে প্রতিকূলের যাত্রী নামের একটি প্রামাণ্য চিত্র নির্মাণ করেন।[১]
১৯৬৮ সালে তিনি মনজুরা ইব্রাহিমকে বিয়ে করেন। তার সাথে বিবাহবিচ্ছেদের পরে ১৯৭৫ সালে তিনি অভিনেত্রী জয়শ্রী রায়কে বিয়ে করেন। তিনি ২ কন্যা ও ১ পুত্রের জনক ছিলেন। তিনি বগুড়া জেলায় একটি চলচ্চিত্র বিষয়ক অণুষ্ঠানে যোগ দিয়ে ঢাকা ফিরে আসার পথে ২০ জানুয়ারি ১৯৮৯ সালে নগরবাড়ি ফেরি ঘাটে এক দুর্ঘটনায় নিহত হন।
পুরস্কার ও সম্মাননা
শিল্পকলায় অসাধারণ অবদানের জন্য ২০১০ সালে বাংলাদেশের “সর্বোচ্চ বেসামরিক পুরস্কার”[৬][৭][৮] হিসাবে পরিচিত “স্বাধীনতা পুরস্কার” প্রদান করা হয় তাকে।[৯] এছাড়াও তিনি